রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিকই ভোক্তা। একজন ভোক্তা হিসেবে রয়েছে তার ‘ভোক্তা অধিকার’। কিন্তু ভোক্তার অধিকার কি, তা জানে না ভোক্তাই। প্রতারিত হলে কি করতে হবে, কোথায় যেতে হবে তাও ভোক্তাদের অজানা। ভোক্তা অধিকার নিয়ে যেসব সংগঠন কাজ করছেন, সেসব সংগঠনের কার্যক্রম দেখা যায় শুধু ভোক্তা অধিকার দিবসেই। দিনব্যাপী আলোচনা, র্যালি, মানব বন্ধনের মধ্যেই যেনো চাপা পড়ে থাকে ভোক্তার প্রকৃত অধিকার। দু’বছর আগে সরকার ভোক্তাদের অভিযোগ দেওয়ার জন্য ‘জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর’ নামে নতুন একটি অধিদপ্তর খুললেও দু’বছরে সেখানে অভিযোগ এসেছে মাত্র নয়টি! ভোক্তা, সংশ্লিষ্ট মহলের সঙ্গে কথা বলে ও তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে এখানে ভোক্তা অধিকারের বিভিন্ন দিক তুলে ধরা হয়েছে।
ডায়াবেটিসের ওষুধ ‘ডায়াট্রল’ এর কোম্পানি নির্ধারিত মূল্য প্রতি পাতা ৭০ টাকা। কিন্তু বৃহস্পতিবার রাতে শাহবাগের একটি ফার্মেসি থেকে ডায়াবেটিস রোগী আমিনুল ইসলাম তা কিনেছেন ৭৫ টাকায়। পরিপাকতন্ত্রের ওষুধ ‘সেকলো’ এর কোম্পানি নির্ধারিত মূল্য প্রতিটি ৪টাকা আর তা তিনি কিনেছেন সাড়ে ৪ টাকা দিয়ে। বিক্রেতা দাম বেড়েছে বলায় তিনি ওষুধের প্যাকেটের গায়ের মূল্য দেখতে চাননি। ঘটনার সময় ক্রেতার সামনে এ প্রতিবেদক ওষুধের প্যাকেটের মূল্য দেখতে চাইলে আপত্তি জানায় ফার্মেসির বিক্রেতা। এক সময় প্যাকেটের মূল্য দেখায়। সেখানে দেখা যায় দাম বাড়েনি। কিন্তু বিক্রেতারা বাড়তি দামে বিক্রি করছেন। এমন চিত্র প্রায়ই দেখা যায়। যা ভোক্তা অধিকার আইনে দণ্ডনীয় অপরাধ।
ভোক্তাদের অধিকারের জন্য যে ২০০৯ সালে আইন প্রণয়ন করা হয়েছে তাও জানা নেই আমিনুল ইসলামের। ‘ভোক্তা অধিকার’ শব্দটির সঙ্গে পরিচিতও নন এ ক্রেতা। শব্দটি নতুন শুনছেন বলে তিনি জানান।
শুধু আমিনুল নন। অনেকেই জানেন না, ভোক্তা অধিকার আইন কি? নির্ধারিত মূল্যের বেশি দাম রাখা হলে তার জন্য যে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরে অভিযোগ করা যায়, তা গুটি কয় মানুষ ছাড়া সবারই অজানা।
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. আকবর আলী খান বলেন, ‘ভোক্তা হিসেবে প্রায় প্রতিটি মানুষের তিক্ত অভিজ্ঞতা আছে। আইন থাকলেও তারা এর সুফল পান কি-না এটাই প্রশ্ন।’
তিনি বলেন, ‘রাষ্ট্র শুধু আইন করলেই হবে না; এ আইন জানাতেও হবে। কারণ জনগণের জন্যই আইন। এখন জনগণ যদি সে আইন সম্পর্কে না জানে, তাহলে সে আইন জনকল্যাণ বয়ে আনতে পারে না।’
তিনি জানান, ভোক্তার যে অধিকার রয়েছে, তা তৃণমূল পর্যায়েও জানিয়ে দিতে হবে।
অর্থনীতির ভাষায় প্রতিটি নাগরিকই ভোক্তা। জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরে ভোক্তার সংজ্ঞায় বলা হয়েছে-‘নিম্নোক্ত ব্যক্তিগণ ভোক্তা: বাণিজ্যিক উদ্দেশ্য ব্যতীত-যিনি সম্পূর্ণ মূল্য পরিশোধ করে বা সম্পূর্ণ বাকিতে পণ্য অথবা সেবা ক্রয় করেন; আংশিক মূল্য পরিশোধ করে বা আংশিক বাকিতে পণ্য অথবা সেবা ক্রয় করেন; কিস্তিতে পণ্য অথবা সেবা ক্রয় করেন।’
ভোক্তার অধিকার কী?
বাজারে নকল, ভেজাল, মানহীন, মেয়াদ উত্তীর্ণ পণ্যের উপস্থিতির পাশাপাশি ওজনে কম দেওয়া, নির্ধারিত পরিবর্তনে অন্য পণ্য সরবরাহ করা ছাড়াও পণ্যমূল্যের উর্ধ্বগতি প্রায়ই ঘটছে। এ বিষয়ে অনেকের তিক্ত অভিজ্ঞতা থাকলেও এর প্রতিকারের ব্যবস্থা কার্যত এখনও দেখা যাচ্ছে না। প্রতিনিয়ত প্রতারণার স্বীকার হচ্ছেন ভোক্তারা।
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইনে ভোক্তার অধিকার সম্পর্কে উল্লেখ রয়েছে। ভোক্তার অধিকার হচ্ছে-‘নিরাপদ পণ্য বা সেবা পাওয়া, কোনো পণ্য বা সেবা ব্যবহারে ক্ষতিগ্রস্ত হলে ক্ষতিপূরণ পাওয়া, ভোক্তা অধিকার ও দায়িত্ব সম্পর্কে শিক্ষা লাভ, লিখিত অভিযোগ দায়ের করা। পণ্যের উপাদান, মেয়াদ উত্তীর্ণের তারিখ, সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য ইত্যাদি সম্পর্কে জানা। নির্ধারিত মূল্যের অধিক মূল্য প্রদান না করা, পণ্য যথাযথ ওজন বা পরিমাপে পাওয়া, প্রতিশ্রুত পণ্য বা সেবা যথাযথভাবে পাওয়া।’
কারওয়ান বাজারে বাজার করতে আসা গৃহিনী আনজুমান আরা জানান, ভোক্তার অধিকারে কি আছে তা তিনি জানেন না। শব্দটিও তিনি নতুন শুনছেন।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নওশাদ জামাল বলেন, ‘ভোক্তার অধিকার জানার খুব বেশি কি দরকার। দু’চার টাকা হয়তো বেশি নিবে নয়তো কম।’
সংগঠনগুলোর তৎপরতা শুধুই একদিন
যেহেতু প্রত্যেক নাগরিকই ‘ভোক্তা’, তাই জীবনের এই মৌলিক অধিকার সম্পর্কে প্রত্যেক জনগণের উচিত সচেতন হওয়া। ভোক্তা অধিকার বিষয়ে কর্মরত সংগঠনসগুলোর ব্যর্থতার কারণে ভোক্তারাও তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন নয়। সংগঠনগুলো শুধু একদিন (ভোক্তা অধিকার দিবসে) রাজধানী/শহরকেন্দ্রিক সেমিনার, সিম্পোজিয়াম নিয়ে ব্যস্ত। জনবিচ্ছিন্ন এ সকল সংগঠন ভোক্তাদের অধিকার সুরক্ষায় কার্যকর ভূমিকা পালনে ব্যর্থ হয়েছে। ২০০৯ সালে এ সংক্রান্ত একটি আইন হলেও ওই আইনের কোনো কার্যকারিতা বা সুফল ভোক্তারা পাচ্ছে না। ভোক্তা অধিকার সুরক্ষা আইনের আওতায় জেলা পর্যায়ে জেলা প্রশাসকের নেতৃত্বে গঠিত ‘ভোক্তা অধিকার কমিটি’ও কোনো কাজ করছে না।
অবশ্য এ ব্যাপারে ভিন্নমত পোষণ করে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর এর মহাপরিচালক মো. আবুল হোসেন মিঞা বলেন, ‘ভোক্তাদের অধিকারের জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর আন্তরিকভাবে কাজ করে যাচ্ছে। অভিযোগ পাওয়ার পর ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।’
কাজীর গরু কেতাবে আছে
ভোক্তার অধিকার লঙ্ঘিত হলে ঘটনার ৩০ দিনের মধ্যে ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদফতরে লিখিত, এসএমএস, ফ্যাক্স, ই-মেইল যেকোনো মাধ্যমে অভিযোগ করা যায়। অভিযোগ প্রমাণিত হলে পণ্য মূল্যের ৫ গুণ জরিমানা করার এবং সে অর্থের শতকরা ২৫ ভাগ অভিযোগকারীকে প্রদানের বিধান রয়েছে।
তবে এতসব নিয়ম থাকলেও তা বাস্তবে অনেকেই জানে না। রাজধানীতে অর্ধশতাধিক ব্যক্তিকে ভোক্তা অধিকার লঙ্ঘনের এসব বিধান জানা আছে কি-না জিজ্ঞেস করতেই সবাই একবাক্যে বলেছেন ‘না’।
মোড়কজাত বিধিমালা ২০০৭এর ২০(৪) উপধারায় বলা হয়েছে, মোড়কজাত পণ্যের দাম বাড়ানোর আগে দুটি দৈনিকে বিজ্ঞাপন দিতে হবে। পাশাপাশি বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশনের (বিএসটিআই) পরিচালক মেট্রোলজিকে বিষয়টি অবহিত করতে হবে। নির্ধারিত ফি দিয়ে নতুন মোড়কের অনুমোদনও নিতে হবে। কার্যত এ আইন মানা হচ্ছে না।
আইনে আরো বলা হয়েছে, মূল্য পরিবর্তন করা হলে মোড়কেও পরিবর্তন আনতে হবে। কিন্তু হরহামেশাই কোনো ধরনের বিজ্ঞাপন বা বিএসটিআইকে না জানিয়েই কোম্পানিগুলো পণ্যের দাম বাড়াচ্ছে।
বাজারে এখনো ব্যবহার হচ্ছে সনাতনী পাল্লা। এসব পাল্লার বাটখারা নিয়মিত পরীক্ষা করার কথা থাকলেও বিএসটিআই সেটা করছে না। ফলে অহরহ ওজনে কম দেওয়া হচ্ছে, ক্রেতারা ঠকছেন।
বৃহস্পতিবার রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে বিশ্ব ভোক্তা অধিকার দিবসের অনুষ্ঠানে এফবিসিআই এর সভাপতি একে আজাদ আইনের প্রচারণা ও বাস্তবায়ন না থাকা সম্পর্কে বলেন, ‘এতসব আইন থাকলেও বাস্তবায়ন দূরে থাক; তার প্রচারণাও নেই। ভোক্তাদের যে অধিকার রয়েছে, প্রতারিত হলে সহজপন্থায় অভিযোগ করার সুযোগ আছে, এ বিষয়গুলোর ব্যাপক প্রচারণার প্রয়োজন। শুধু সুযোগ থাকলেতো হবে না।’ তিনি সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তর ও ভোক্তা-অধিকার সংগঠনগুলোকে মাঠ পর্যায়ে কাজ করার আহবান জানান।
ভোক্তা প্রতারিত হলেও অভিযোগ করছেন না
প্রতিদিনই ভোক্তারা প্রতারিত হলে তারা অভিযোগ করছেন না। প্রচারণা না থাকায় এবং কোথায় অভিযোগ করবেন এ সম্পর্কে ওয়াকিবহাল না থাকায় ভোক্তারা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরে অভিযোগ করছেন না। মূলত ভোক্তাদের অধিকার ও অভিযোগ দেওয়ার জন্যই সরকার দু’ বছর আগে ‘জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরণক্ষণ অধিদপ্তর’ খোলা হয়েছে। অথচ গত দু’বছর অভিযোগ এসেছে মাত্র ৯টি!
ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. আবুল হোসেন মিঞা বলেন, ‘গত দুই বছরে অধিদপ্তরে ৯টি অভিযোগ এলেও তার অধিকাংশ নিষ্পত্তি হয়েছে। ভোক্তারা সচেতন না হলে অধিকার আদায় করা কঠিন।’
ভেজাল পণ্য বিক্রয়ে তিন বছরের কারাদণ্ড
ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন ২০০৯ এর চতুর্থ অধ্যায়ে (ক্রম ৪১) উল্লেখ আছে-‘কোনো ব্যক্তি জ্ঞাতসারে ভেজাল মিশ্রিত পণ্য বা ওষুধ বিক্রয় করিলে বা করিতে প্রস্তাব করিলে তিনি অনূর্ধ্ব তিন বৎসর কারাদণ্ড, বা অনধিক দুই লক্ষ টাকা অর্থদণ্ড, বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হইবেন’।
এছাড়া খাদ্যপণ্যে নিষিদ্ধ দ্রব্যের মিশ্রণের দণ্ডে শাস্তির বিধানও একই।
নির্ধারিত মূল্যের বেশি দাম রাখলে এক বছর কারাদণ্ড
ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন ২০০৯ এর চতুর্থ অধ্যায়ে (ক্রম ৪০) উল্লেখ আছে-‘ধার্য্যকৃত মূল্যের অধিক মূল্যে পণ্য, ঔষধ বা সেবা বিক্রয় করিবার দণ্ড:-কোন ব্যক্তি কোন আইন বা বিধির অধীনে নির্ধারিত মূল্য অপেক্ষা অধিক মূল্যে কোন পণ্য, ঔষধ বা সেবা বিক্রয় বা বিক্রয়ের প্রস্তাব করিলে তিনি অনূর্ধ্ব এক বৎসর কারাদণ্ড, বা অনধিক পঞ্চাশ হাজার টাকা অর্থদণ্ড, বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হইবেন’।
এছাড়া এ আইনে মূল্যের তালিকা প্রদর্শন না করলে, পণ্যের মোড়ক ব্যবহার না করলে, ওজনে কারচুপি করলে, মেয়াদ উত্তীর্ণ কোনো ওষুধ বিক্রি করলে এক বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক পঞ্চাশ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হওয়ার বিধান রয়েছে।
ভোক্তাদের অধিকার রক্ষায় আইন থাকলেও কার্যত এসব আইনের বাস্তবায়ন দেখা যায় না।
এ বিষয়ে কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) এর সভাপতি কাজী ফারুক বলেন, আমাদের দেশে ভোক্তারা ক্ষতিগ্রস্ত হলেও অভিযোগ করছে না। এ কারণে আইনের বাস্তবায়ন চোখে পড়ার মতো নয়।’ তিনি জানান, ক্যাব তার সামর্থ্যের মধ্যে চেষ্টা করছে।
যেহেতু প্রত্যেক নাগরিকই ‘ভোক্তা’ তাই জীবনের এই মৌলিক অধিকার সম্পর্কে সচেতন থাকার প্রয়োজন থাকলেও অনেকেই জানে না ভোক্তার অধিকার কী। দেশে সু-সংগঠিত ভোক্তা আন্দোলন গড়ে না ওঠায় এই প্রতারণা-প্রবঞ্চনার বিরুদ্ধে কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে উঠছে না। সরকার ও বেসরকারিভাবে ভোক্তা অধিকার সম্পর্কে জনসচেতনতা না বাড়ালে ভোক্তা অধিকার আইন শুধু ‘কাগুজে আইন’ হয়ে থাকবে। কাজেই ভোক্তাদের যেমন ‘ভোক্তা অধিকার’ জানতে হবে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকেও এসব বিষয়ে সচেতন করতে হবে।