ফেসবুকে সিগারেট ঠোঁটে ছবি দিয়েছিলেন উঠতি এক মডেল। আর তা নিয়েই আপত্তি তুলেছেন এক চিকিৎসক। ধূমপানের ‘বিজ্ঞাপন’ করায় ওই মডেলের বিরুদ্ধে বিধাননগর সাইবার থানায় লিখিত অভিযোগও জানিয়েছেন তিনি। পুলিশ অবশ্য এখনও এই ঘটনায় মামলা রুজু করেনি। তবে এই অভিযোগকে কেন্দ্র করে তৈরি হয়েছে বিতর্ক।
প্রশ্ন উঠেছে, ফেসবুকের মতো সোশ্যাল নেটওয়ার্ক সাইটে ধূমপান কিংবা তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহারের ছবি দেওয়া যায় কি? অনেকেই বলছেন, প্রকাশ্যে বা জনবহুল এলাকায় (পাবলিক প্লেস) ধূমপানে নিষেধ রয়েছে। কারণ, প্রকাশ্যে ধূমপান করলে যাঁরা ধূমপায়ী নন, তাঁরাও তামাকের ক্ষতির শিকার হন। অনেক ক্ষেত্রেই যা সরাসরি ধূমপানের চেয়ে বেশি ক্ষতিকর। এই আইনের কোপে পড়েছেন খোদ শাহরুখ খানও। কিন্তু ফেসবুকে ছবি দিলে তো তেমন কোনও ক্ষতি নেই!
তামাকবিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের অবশ্য দাবি, ফেসবুকের মতো সোশ্যাল মিডিয়া একটি ‘পাবলিক ফোরাম’। সেখানে ধূমপানের ছবি দিলে তা অনেককে উৎসাহিত করতে পারে। যেটাও সমান ক্ষতিকর।
ফেসবুক ব্যবহারকারী এবং আইনজীবীদের অনেকে বলছেন, কোনও ব্যক্তির সোশ্যাল মিডিয়ার প্রোফাইল তাঁর ব্যক্তিগত সম্পত্তি। ফলে তিনি সেখানে কী ছবি দেবেন, সেটা ঠিক করে দেওয়া মানে তাঁর ব্যক্তিগত স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা। সিগারেট ঠোঁটে ছবি দেওয়া নিয়ে অভিযোগ করা হলে সেটাও ব্যক্তিগত স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ। এই প্রশ্ন উস্কে দিয়ে আইনজীবী শিল্পা দাস বলছেন, ‘‘ফেসবুকে ধূমপানের ছবি দেওয়ায় সরাসরি ক্ষতি নেই। ফলে পাবলিক প্লেসে বা প্রকাশ্যে ধূমপানরোধী আইন সামনে রেখে যে যুক্তি এখানে দেওয়া হচ্ছে, তা কিন্তু পুরোপুরি খাটে না।’’
ব্যক্তিগত স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ নিয়ে পাল্টা যুক্তিও দিচ্ছেন অনেকে। তাঁরা বলছেন, ফেসবুক প্রোফাইল ব্যক্তিগত সম্পত্তি হতে পারে। কিন্তু সেটা যদি সমাজের বড় একটি অংশ দেখতে পায়, তা হলে তা আর শুধু ব্যক্তি স্বাধীনতার গণ্ডীতে সীমাবদ্ধ থাকে না। সাইবার আইনের শিক্ষক বিভাস চট্টোপাধ্যায়ের মতে, প্রকাশ্যে ধূমপান করা যতটা অপরাধ, ধূমপানের প্রচার করাটাও ততটাই। তাই ফেসবুকের মতো সোশ্যাল মিডিয়ায় এ ধরনের ছবি দিলে তা কার্যত প্রোমোশন বা উৎসাহ দেওয়ারই সামিল। এ যুক্তি অবশ্য মেনে নিয়েছেন শিল্পাও।
ফেসবুকে ধূমপানের ছবি দেওয়ার বিরোধিতা করেছেন ক্যান্সার-শল্য চিকিৎসক গৌতম মুখোপাধ্যায়ও। তিনি বলছেন, পাবলিক প্লেস বলতে যা বোঝায়, ফেসবুক ঠিক তা নয়। একে পাবলিক ফোরাম হিসেবে দেখা উচিত। এ ধরনের ফোরামে ধূমপানের ছবি দিলে তার প্রভাব অনেক বেশি লোকের মধ্যে ছড়ায়। গৌতমবাবুর কথায়, ‘‘এক জন চিকিৎসক এবং বেঙ্গল অঙ্কোলজি সংগঠনের সচিব হিসেবে এ ধরনের ছবি প্রকাশের তীব্র বিরোধিতা করছি।’’
তামাক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত অনেকেই বলছেন, পাবলিক প্লেস হোক বা ফোরাম— তামাকের কুপ্রভাবের বিরুদ্ধে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (হু) নির্দেশিকা বলছে, যে মাধ্যমে সাধারণ মানুষের নিয়ন্ত্রণ রয়েছে, সেখানে এ ধরনের ছবির প্রদর্শনী নিষিদ্ধ। এ দেশে সিনেমা, বিজ্ঞাপন কিংবা সিরিয়ালের ধূমপানের দৃশ্যে বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ বার্তা দেওয়া হয়। কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়ার ক্ষেত্রে তেমন কোনও বিধিনিষেধ এখনও দেখা যায়নি। যদিও বিভাসবাবুর মতে, হু-এর নির্দেশিকা এবং এ দেশে এই সংক্রান্ত যে আইন রয়েছে তা সোশ্যাল মিডিয়ার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ অবশ্য কতটা কার্যকর তা নিয়েও রয়েছে প্রশ্ন। অনেকেই বলছেন, দিনরাত সিনেমা-সিরিয়ালে ধূমপানের দৃশ্য দেখানো হচ্ছে। তার তলায় খুদে অক্ষরে সতর্কতা থাকলেও সেই সব দৃশ্যে মজে থাকা দর্শক প্রায়শই তা খেয়াল করেন না। ‘‘এমন বিধিবদ্ধ সতর্কতায় কতটা লাভ হয়, তা নিয়েও কিন্তু প্রশ্ন উঠতে পারে,’’ বলছেন শিল্পা।