দুই দেশের মানুষকে কাছে এনেছে সীমান্ত হাট

দুই দেশের মানুষকে কাছে এনেছে সীমান্ত হাট

বাংলাদেশ ও ভারত, দুদেশের পারস্পরিক সমঝোতায় সীমান্ত এলাকার মানুষের জন্য কয়েকটি সীমান্ত হাট চালু করা হয়েছে। ২০১১ সাল থেকে এপর্যন্ত মোট চারটি সীমান্ত হাট চালু হয়েছে, যেখানে দুদেশের সীমান্ত এলাকার মানুষজন প্রতি সপ্তাহে অন্যদেশের পণ্য কেনার সুযোগ পান।

বাংলাদেশের ফেনীর ছাগলনাইয়া আর ভারতের শ্রীনগর সীমান্তে প্রতি মঙ্গলবার বসছে এরকম একটি সীমান্ত হাট। দুই দেশের সীমান্তের ঠিক মাঝে তৈরি করা হয়েছে সীমান্ত হাটের কাঠামো। dfgvdrdfvযদিও সপ্তাহে মাত্র একদিন এখানটা সরগরম হয়ে ওঠে।

চারদিকে ধানক্ষেত, তার মাঝে কয়েকটি আধাপাকা ঘর। একপাশে বাংলাদেশী বিক্রেতারা বসেছেন, অন্যপাশে ভারতীয় বিক্রেতারা। বিজিবি বা বিএসএফকে পাস বা পরিচয়পত্র দেখিয়ে বাজারে প্রবেশ করছেন ক্রেতারা।

বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা থেকে প্রায় চার ঘণ্টার গাড়ি পথের দূরত্ব পার হয়ে ফেনীর ছাগলনাইয়া আর ত্রিপুরার শ্রীনগরে এই সীমান্ত হাটটি বসে মঙ্গলবার সকাল ১০টা থেকে বিকাল পাঁচটা পর্যন্ত। হাটের পাঁচ কিলোমিটার এলাকার মানুষের ওই হাটে নিয়মিত কেনাকাটা করার অনুমতি রয়েছে।

স্থানীয় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কাজী শহীদুল ইসলাম জানালেন, শুধু কেনাকাটা নয়, দুই দেশের মানুষের যোগাযোগের জন্যও, শুরু থেকেই হাটটি মানুষের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।

তিনি বলছেন, স্থানীয় মানুষের মধ্যে ব্যাপক সাড়া রয়েছে।

প্রথমদিকে স্থানীয় মানুষজনই বেশি গেলেও, এখন অনেকেই বাইরে থেকে আসছেন। যারা দরকার মনে করে, তারা নিয়মিতই যাচ্ছে। তবে যাদের আত্মীয় স্বজন দুই দেশে রয়েছে, তাদের অনেকেই দুর দুর থেকে আত্মীয়দের সঙ্গে দেখা করার জন্যে এখানে আসছেন। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ২০১০ সালের একটি সমঝোতা অনুযায়ী ১০টি সীমান্ত হাট স্থাপনের কথা রয়েছে। এখন পর্যন্ত মোট চারটি হাট চালু হয়েছে। ২০১৫ সালের জানুয়ারি থেকে চালু হয়েছে ফেনী আর ত্রিপুরার সীমান্তের এই হাট।

দুই দেশের সমঝোতা অনুযায়ী, উভয় দেশ থেকে পঁচিশজন করে বিক্রেতা হাটে অংশ নেন। তবে ক্রেতাদের সংখ্যা নিয়ে নির্দিষ্ট কোনো সীমা নেই। হাটের আশেপাশে পাঁচ কিলোমিটার এলাকার বাসিন্দাদের স্থায়ী পরিচয়পত্র দেয়া হয়েছে, যেটি দেখিয়ে তারা সহজেই হাটে যেতে পারেন। তবে অন্যদেরও সাময়িক পাস নিয়ে হাটে প্রবেশের সুযোগ রয়েছে।

বিজিবি এবং বিএসএফের সদস্যরা জানালেন, সাধারণত প্রতিটি হাটে প্রত্যেক দেশ থেকে দুহাজার মানুষ এখানে কেনাকাটা করতে আসেন। এই হাটে টাকা ও রূপি, দুই মুদ্রাতেই লেনদেন হয়।

বাংলাদেশী দোকানগুলোয় বিস্কুট, মাছ, প্লাস্টিক ও লোহার তৈজসপত্র, চানাচুর, কাপড় বিক্রি করতে দেয়া যায়। তবে সবচেয়ে বেশি ভিড় চোখে পড়ে মাঝের সারিতে থাকা মাছের দোকানগুলোয়। সেখানে জ্যান্ত কই, মাগুরের পাশাপাশি রয়েছে শুটকি আর ইলিশ মাছও।

বাংলাদেশী বিক্রেতা বাবুল সাহা বলছিলেন, বাংলাদেশী একশ টাকা সমান ভারতীয় আশি টাকা ধরে তারা পণ্যের বিনিময় করেন। বাংলাদেশী যে পণ্যটির গায়ে একশ টাকা লেখা থাকে, সেটা তারা আশি ভারতীয় মুদ্রায় বিক্রি করেন।

ভারত থেকে যারা কেনাকাটা করতে আসেন, আগে তারা বিস্কুট বেশি কিনলেও, এখন নানা জিনিসের প্রতি তাদের আগ্রহ বেড়েছে। তবে বাংলাদেশী ক্রেতারা তাদের কাছে খুব একটা আসেন না। ভারতের বিশ্বমুখ থেকে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে এসেছেন দিলীপকুমার সেন।

তিনি বলছেন, এই হাটে ওঠা অনেক বাংলাদেশী পণ্যই ভারতের দোকানগুলোয় পাওয়া যায়। সেই তুলনায় দাম খুব একটা কম নয়। তবে মাছটা সস্তা। তবে তিনি পরিবারের সদস্যদের নিয়ে অনেকটা বেড়াতেই এখানে এসেছেন।

তবে সিন্ধা বৈদ্য অবশ্য বাজারে এসে খুবই খুশি। তিনি বলেন, ‘বাজারে এসে খুব ভালো লাগছে। অনেক কিছুই কিনেছি। এখান থাকা অনেককিছুই ভারতে পাওয়া যায়না। আজ বিস্কুট, দা, কুড়ল আর কিছু খাবার কিনেছি।

নিয়ম অনুযায়ী, একজন ক্রেতা স্ব স্ব দেশের মুদ্রায় সর্ব্বোচ্চ একশ ডলার মূল্য সমপরিমাণের কেনাকাটা করতে পারবেন। তবে কোন বিক্রি বা মজুদের উদ্দেশ্যে একাধিক পণ্য কেনা যাবে না। হাটের ঠিক মাঝে একটি ভবনে দুদেশের একটি সমন্বয় অফিস। সেখানে টাকা ও রূপি বিনিময়ের সুযোগও রয়েছে।

সেখানকার অর্থ বিনিময় কেন্দ্রের একজন কর্মকর্তা ইলিয়াস হোসেন জানালেন, তারা বাংলাদেশ টাকা ও ইন্ডিয়ান রূপি ক্রয় বিক্রয় করেন। এখানে প্রতিদিন প্রায় চার লাখ টাকার লেনদেন হয়। তবে সবটা তাদের হাতে আসে না। অনেক সময়ই বাংলাদেশী বিক্রেতা আর ভারতীয় বিক্রেতারা মিলে নিজেদের মধ্যে লেনদেন করে ফেলে।

ভারতীয় অংশের বেশিরভাগ দোকানেই কাপড়, সাবান, মসলা, বাচ্চাদের জিনিসপত্র, গৃহস্থালি নানা জিনিসপত্র, তেল, হরলিক্স, ঘি, মশার কয়েল বিক্রি হচ্ছে। বিনিময় হার অনুযায়ী, পণ্যের গায়ের দামের সঙ্গে আরো কুড়ি শতাংশ যোগ করে প্রতিটি পণ্যের বিক্রয়মূল্য নির্ধারণ করা হচ্ছে।

এরকম একটি দোকানে ব্যস্ত সময় পাড় করছেন বেলা দেবনাথ। শ্রীনগর থেকে মালামাল নিয়ে এই হাটে এসেছেন তিনি। তিনি বলেন, আমাদের মুদি দোকান, তবে হরলিক্স, বাচ্চাদের জিনিসপত্র, প্রসাধনীও পাওয়া যায়। তবে দুধ, চকলেট, হরলিক্স, এগুলোয় মানুষ বেশি খোঁজ করে।

এই হাটের বিক্রেতাদের অনেকে নিয়মিত ব্যবসায়ী হলেও, অনেকেই আবার শুধুমাত্র শখে একদিনের জন্য এখানে বিক্রেতা বনে যান। ভারতের শ্রীনগরের নিজের দোকান থেকে মালামাল নিয়ে এসেছেন শিবপ্রসাদ বিশ্বাস। তবে পাশে বসে থাকা বিক্রেতাদের কয়েকজন একদিনের ব্যবসায়ী।

বাংলাদেশী কয়েকজন ক্রেতা জানালেন, এই হাটে আসা অনেক পণ্য বাংলাদেশে পাওয়া গেলেও, দামে অনেক সস্তা হওয়ায় তারা প্রায় নিয়মিতই এখানে আসেন। একজন ক্রেতা জানালেন, ভারতীয় যে পণ্যটা ট্যাক্স দিয়ে দেশে আসে, সেটা ট্যাক্স ছাড়াই পাওয়া যাচ্ছে। এতে দাম বেশ কম পড়ে। তাই কেনাকাটা করতে প্রায়ই তিনি এই হাটে আসেন।

হাটে এমন অনেকেরই দেখা পেলাম, যারা হাটে এসেছেন শুধুমাত্র আত্মীয়দের সঙ্গে দেখা করার জন্যই তারা এখানে এসেছেন। বহুদিন আগে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া পরিবারের সদস্যদের সাথে নির্বিঘ্নে দেখা করার একটি সুযোগ হিসাবে তাদের জন্য এসেছে এই সীমান্ত হাট। সেলফোনে যোগাযোগ করে আজ হাটে এসেছেন এমন কয়েকটি পরিবার।

বাংলাদেশের চট্টগ্রাম থেকে নিকটাত্মীয়ের সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন বাদল রায়। তিনি বলছেন, আমরা সহজে ইন্ডিয়া যেতে পারি না। তাই এখানে এলে সহজে দেখা করা যায়। শুনেছি এখানে বাজার হয়, দুই দেশ থেকে মানুষ আসতে পারে। তাই আজ আমি এখানে এসেছি।

ভারতের খোয়াই থেকে তার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন কুতু মনিক। তিনি বলছেন, ‘আমাদের পূর্বপুরুষ বাংলাদেশ থেকে চলে আসে। কিন্তু ওনারা থেকে গেছে। বহুদিন পর আবার আমাদের সঙ্গে মোবাইলে যোগাযোগ হয়েছে। আমরা খালাতো ভাই। ওখানে যাবার সুযোগ হয়না। তাই এখানে আসা।

বিকাল সাড়ে চারটা থেকেই হাট গোটানোর প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। দুদেশের ব্যবসায়ীরাই তাদের দোকানপাট গোছাতে শুরু করেছেন।র বিকাল পাঁচটা থেকে হাট আজকের মতো এখানে শেষ হবে। আবার বসবে আগামী মঙ্গলবার। -বিবিসি

Featured বাংলাদেশ