জাতিসংঘের রায় বঙ্গোপসাগরের ২শ নটিক্যাল মাইল বাংলাদেশের

জাতিসংঘের রায় বঙ্গোপসাগরের ২শ নটিক্যাল মাইল বাংলাদেশের

বঙ্গোপসাগরের মালিকানা নিয়ে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে বিরোধ মামলায় অবশেষে বাংলাদেশের পক্ষেই রায় দিয়েছে সমুদ্র আইনবিষয়ক আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল (ইটলস)।

ইটলস জানিয়েছে, বঙ্গোপসাগরে ২০০ নটিক্যাল মাইল (১ লাখ ১১ হাজার বর্গ কিলোমিটার) পর্যন্তই বাংলাদেশের অর্থনৈতিক এলাকা ও সার্বভৌম অধিকারের অঞ্চল।

জার্মানির হামবুর্গ থেকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা, দীপু মনির পাঠানো এক বার্তায় বুধবার সন্ধ্যায় এ তথ্য জানানো হয়।

এর পরপরই টেলিফোনে দীপু মনি বাংলানিউজকে বলেন, ‘এটি বাংলাদেশের একটি বিশাল জয়।’

তিনি বলেন, এই মামলা থেকে বাংলাদেশ যা চেয়েছে তারচেয়েও বেশি পেয়েছে। আমাদের দাবি ছিল ১ লাখ ০৭ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকা অথচ জাতিসংঘের আদালতের রায়ে আমরা পেয়েছি ১ লাখ ১১ হাজার বর্গকিলোমিটার।

১৫১ পৃষ্ঠার ওই রায়ে ন্যায্যতাভিত্তিক সমুদ্রসীমার দাবিকে সমুন্নত রেখেছে বলেও দীপু মনি জানান।

দীপু মনি বলেন, ‘রায় অনুযায়ী মিয়ানমারের সঙ্গে জলসীমায় উপকূল থেকে ২০০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত সীমারেখাকে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক এলাকা এবং মহীসোপান এলাকায় বাংলাদেশের নিরঙ্কুশ আইনগত অধিকারের স্বীকৃতি দিয়েছে।’

বিশেষ বার্তায় দীপু মনি বলেন, ‘মিয়ানমারের প্রস্তাবিত সমদূরত্ব পদ্ধতি যা কিনা বাংলাদেশের সমুদ্র এলাকাকে ১৩০ নটিক্যাল মাইলের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে দেয়, তা প্রত্যাখ্যান করে ট্রাইব্যুনাল ইক্যুইটি (ন্যায্যতা)’র ভিত্তিতে দুই দেশের সমুদ্রসীমা চূড়ান্তভাবে নির্ধারণ করে দিয়েছে।’

জার্মানির হামবুর্গে অবস্থিত ওই ট্রাইব্যুনালের রায় শুনতে আদালতকক্ষে উপস্থিত ছিলেন ডা. দীপু মনি ও তার নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল।

দীপু মনি বলেন, ‘ট্রাইব্যুনালের এই রায়ের দিনটি বাংলাদেশের জনগণের জন্য অত্যন্ত গৌরবময় ও আনন্দের দিন।’

তিনি বলেন, ‘এ রায়ের মাধ্যমে বঙ্গোপসাগরের জলরাশি ও তলদেশের সম্পদে বাংলাদেশের সার্বভৌম অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।’

সমুদ্রসীমা নিয়ে বাংলাদেশে বিগত ৩৮ বছর কিছুই করা হয়নি উল্লেখ করে দীপু মনি বলেন, ‘মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমার বিষয়টি ৩৮ বছর অমীমাংসিত থাকায় আমরা সমুদ্র সম্পদ আহরণ করতে ব্যর্থ হয়েছি।’

তিনি বলেন, ‘বর্তমান সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নেয় এবং অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে স্বল্প সময়ের মধ্যে আন্তর্জাতিক আইনের আশ্রয় নেওয়া হয়।’

পররাষ্ট্রমন্ত্রী তার বার্তায় আরও বলেন, ‘২০০৯ সালের ৮ অক্টোবর মিয়ানমারের বিপক্ষে জার্মানির হামবুর্গে অবস্থিত সমুদ্র আইন ট্রাইব্যুনালে একটি মামলা দায়ের করা হয়। ২৩ সদস্যবিশিষ্ট ট্রাইব্যুনাল আজ এর ঐতিহাসিক রায় দিলো।’

সমুদ্রসীমা নিয়ে অতীতের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে দীপু মনি বলেন, ‘স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু সরকার এ অঞ্চলের প্রথম দেশ হিসেবে মাত্র তিন বছরের মধ্যে ১৯৭৪ সালে টেরিটোরিয়াল ওয়াটারস অ্যান্ড ম্যারিটাইম জোনস অ্যাক্ট পাস করে।’

তিনি বলেন, ‘এছাড়া ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নির্ধারণে আলোচনাও ১৯৭৪ সালে শুরু হয়। পরবর্তী সরকারগুলো সাগর ও সাগরের সম্পদে বাংলাদেশের জনগণের জন্য ফলপ্রসূ কোনো পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয়।’

পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ প্রসঙ্গে আরও বলেন, ‘২০০১ সালে এই আওয়ামী লীগ সরকারই জাতিসংঘ সমুদ্র আইন কনভেনশন অণুসমর্থন করে এবং ২০০৯ সালে আমাদের সরকারই এই আইনের অধীনে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা চূড়ান্তভাবে নির্ধারণের জন্য ভারত ও মিয়ানমারের বিপক্ষে আইনি প্রক্রিয়া শুরু করার সাহসী পদক্ষেপ গ্রহণ করে।’

১৫১ পৃষ্ঠার রায়:

বঙ্গোপসাগরের মালিকানা নিয়ে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে বিরোধ মামলায় ১৫১ পৃষ্ঠার একটি রায় দেয় সমুদ্র আইনবিষয়ক আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল (ইটলস)।

বাংলাদেশ সময় বুধবার বেলা সাড়ে পাঁচটার দিকে রায় পাঠ করা শুরু করেন আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালের প্রধান জোসে লুই জেসাস।

জার্মানির হামবুর্গে অবস্থিত ওই ট্রাইব্যুনালের রায় শুনকে আদালত কক্ষে উপস্থিত থাকেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনির নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল।

২০০৯ সালেল ১৪ ডিসেম্বর নিজেদের দাবির স্বপক্ষে ইটলসে মামলা করে বাংলাদেশ সরকার।

বঙ্গোপসাগরে উপকূল থেকে ২০০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত ন্যায্য ও সমতার ভিত্তিতে নিজেদের অধিকার চায় বাংলাদেশ।

মিয়ানমারের যুক্তি থাকে ‘সম-দুরত্ব’র ভিত্তিতে এ সীমা নির্ধারিত হতে হবে। তাদের এ তত্ত্ব অনুযায়ী রেখা টানা হলে বাংলাদেশ বঙ্গোপসাগরে ২০০ নটিক্যাল মাইলের বদলে উপকূল থেকে ১৩০ নটিক্যাল মাইল সমুদ্র পেত। যদিও তা শেষ পর্যন্ত ধোপে টিকলো না।

মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমার বিরোধ নিষ্পত্তিতে ২০০৯ সালের অক্টোবরে আন্তর্জাতিক আদালতে যাওয়ার সিদ্ধান নেয় বাংলাদেশ। সে অনুযায়ী ১৪ ডিসেম্বর ইটলসে ১৬তম মামলা হিসেবে বাংলাদেশের মামলাটি অন্তর্ভুক্ত হয়।

মিয়ানমার কর্তৃপক্ষও অবশ্য ইটলসের রায় মেনে নিতে রাজি হয়ে বিচারিক কার্যক্রমে অংশ নেয়।

ট্রাইব্যুনালে ২০১০ সালের ১ জুলাই বাংলাদেশ ও ১ ডিসেম্বর মিয়ানমার নিজের পক্ষে প্রথমবারের মতো নথিপত্র উপস্থাপন করে।

এরপর মিয়ানমারের যুক্তি খ-ন করে ২০১১ সালের ১৫ মার্চ বাংলাদেশ তাদের যুক্তি তুলে ধরে এবং মিয়ানমার গত বছরের ১ জুলাই বাংলাদেশের যুক্তি খ-ন করে পাল্টা যুক্তি উপস্থাপন করে।

এরই ধারাবাহিকতায় ২০১১ সালের ৮-২৪ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ ও মিয়ানমার দুই দফায় মৌখিক শুনানিতে অংশ নিয়ে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করে।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী সেসমময়ও হামবুর্গে উপস্থিত ছিলেন।

বাংলাদেশ