বাঙালির আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন : শেখ মুজিবের অবদান কতটুকু

বাঙালির আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন : শেখ মুজিবের অবদান কতটুকু

জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে গতকাল শনিবার বাংলা একাডেমি আয়োজিত বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিনের একক বক্তৃতা প্রদান অনুষ্ঠানে প্রদত্ত বক্তৃতাটি এবিনিউজের সম্মানিত পাঠকদের জন্য হুবহু তুলে ধরা হলো-
বায়াত্তর সালে বাংলাদেশের জনসংখ্যা ছিল সাড়ে সাত কোটি; এখন তা সাড়ে ষোল কোটি। পরিসংখ্যানে সকল সত্য নির্ভুলভাবে হয়ত জানান দেয় না। তবে এ ক্ষেত্রে বিকল্প বিহনে এর উপর নির্ভর করে ঠকে যাবার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। বায়াত্তর থেকে পনেরঃ মাথাপিছু asdasdasdআয় সত্তর মার্কিন ডলার থেকে বেড়ে তেরশ চল্লিশ, গড় আয়ু তেতাল্লিশ থেকে বেড়ে একাত্তর বৎসর, শিশু মৃত্যুর হার হাজারে একশ সত্তর থেকে বত্রিশ, নারীর মোট প্রজনন প্রবণতা পাঁচ থেকে নেমেছে দুই এ, বার্ষিক জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার তিন দশমিক তিন থেকে এক দশমিক তিন, দারিদ্র সীমার নীচে অবস্থানকারী মানুষের অনুপাত শতকরা সত্তর ভাগ (সাড়ে সাত কোটিতে সোয়া পাঁচ কোটি) থেকে নেমে শতকরা চব্বিশ (সাড়ে ষোল কোটিতে চার কোটি), ‘বাসকেট কেইস’ থেকে উন্নয়ন বিস্ময়- নেক্সট ইলেভেন, ফ্রন্টিয়ার ফাইভ এবং থ্রিজি। তেতাল্লিশ বছরের এই কঠিন ও অনিশ্চিত পথচলায় ট্যানেল শেষ হলেই আলোকবর্তিকা শুরু হল কখন, কিভাবে, কোন দর্শনে, কোন প্রেক্ষিতে, কার অকুতোভয়, উদ্ভাবনী ও অবিসংবাদিত নেতৃত্বে তা জানতে হবে বৈকি!
প্রতি বছর আগস্ট এলেই শোকের মাতম হয়। শোককে শক্তিকে পরিণত করার শপথের প্রতিযোগিতা হয়। যারা গুণতির মধ্যে ঃ বিশিষ্টজন, বিত্তবান, নীতিনির্দ্ধারক, নীতি সমালোচক, বুদ্ধিজীবি ও পন্ডিত এবং রাষ্ট্র ও সমাজপতিগণ যদি প্রতিদিন “দুখী মানুষের মুখে হাসি ফুটিয়ে সোনার বাংলা গড়ার” ইস্পাত কঠিন শপথ বাক্যটি এবং সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী বঙ্গঁবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুখাবয়ব স্মরণ করি তাহলে অনেক অন্যায়, অপচয়, শোষণ, বৈষম্য ও দুর্নীতি হ্রাস পেত নিঃসন্দেহে। বিগত কয়েক বছরে আর্থ-সামাজিক পরিমন্ডলে অগ্রগতির যে শক্তিশালী ইতিবাচক ধারা চলমান হয়েছে তা আরো বেগবান হতে পারত। তবে কি মহান স্বাধীনতা অর্জনের অর্থনৈতিক পটভূমি স্মরণ করিয়ে বর্তমান প্রজন্মের একাংশ যারা আওয়ামী লীগের অঙ্গঁ সংগঠনে অনুপ্রবেশ করেছে তাদের সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজী, টেন্ডার ছিনতাই, ছলে বলে কৌশলে আধিপত্য বিস্তার ও ব্যক্তি স্বার্থ হাসিলে খুন খারাবিতে লিপ্ত থাকা থেকে পথে এনে এবং আইনের সুশাসন প্রতিষ্ঠা করে দেশকে আরো মজবুত করতে প্রশাসনকে সাহায্য করা যাবে। কিভাবে সজ্ঞান ও সাহসিক অনুসন্ধানে বঙ্গঁবন্ধু হত্যার আন্তর্জাতিক ও জাতীয় ষড়যন্ত্রের স্বরূপ উন্মোচনে বজ্রকন্ঠ উচ্চারণ আসবে। জানা যাবে ১৫ই আগষ্ট সরকারের সেনাপ্রধানের ভূমিকা কেন এমন ছিল।
বাংলাদেশ, বঙ্গঁবন্ধু ও অর্থনৈতিক মুক্তি নিশ্চিতভাবেই এক ও অভিন্ন। সুতরাং বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পটভূমি, স্বাধীনতার স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমানের একজন মহানায়ক হিসাবে গড়ে উঠা এবং স্বাধীন বাংলাদেশে আর্থ-সামাজিক মুক্তি কেন মুখ্য সে সব বিষয়ে খুব সংক্ষেপে অনেকটা রূপরেখার মত করে কিছু আলোচনা প্রাসংগিক হবে। স্মরণ করা যেতে পারে যে, অতীতে সুজলা, সুফলা, শস্য শ্যামলা বাঙলার সমৃদ্ধি সর্বজনবিদিত ছিল। চীন পর্যটকরা, ইবনে বতুতা প্রমুখেরা এটি প্রত্যক্ষ করেন এবং তাদের ভ্রমণ কাহিনীতে ইহার উল্লেখ করেন। মার্কেন্টিলিস্ট বহির্বাণিজ্য মাধ্যমে রাতারাতি ধনসম্পদ, বৈদেশিক মুদ্রা ও মূল্যবান হীরা জহরত (কোহিনুর মণিসহ), সোনাদানা কুক্ষিগত করার অভিপ্রায়ে ইউরোপীয় শক্তিসমূহ সপ্তদশ শতাব্দীতে ভারতবর্ষে বিশেষ করে বাংলার দিকে লোলুপ দৃষ্টি ফেলে। স¤্রাট জাহাঙ্গীরের নির্বুদ্ধিতা ও স্যার টমাস রো কর্তৃক অভিনীত ছল চাতুরীর ফলশ্রুতিতে ধূর্ত ইংরেজগণ ভারতবর্ষে আপাতদৃষ্টিতে ‘নির্দোষ’ বাণিজ্য করার অনুমতি পায়। আর তাই হয়ে উঠে একশত নব্বই বছরের শোষণ ও লুন্ঠনের ছাড়পত্র। কবিগুরুর ভাষায় “বণিকের মানদন্ড দেখা দিল রাজদন্ডরূপে”। ২৩শে জুন ১৭৫৭ তারিখে মীরমদন, মোহন লালের অসাধারণ শৌর্য বীর্য এবং আত্মত্যাগ সত্ত্বেও মীরজাফরীয় বিশ্বাসঘাতকায় স্বাধীনতার সুর্য অস্তমিত হয়ে গেল এই বাংলায় পলাশীর আ¤্রকাননে বেনিয়া ইংরেজদের কাছে। তারপর ড্যান্ডিতে তৈরী কাপড় আমাদের মসলিনের কাছে প্রতিযোগিতায় অক্ষম হওয়াতে মসলিন বস্ত্রবয়ন শিল্পীদের হাত কাটা ও নীল চাষীদের উপর সীমাহীন অত্যাচারে সোনার বাংলা শ্মশান হয়ে গেল। পূর্ব বাংলা তখন ব্যবহৃত হচ্ছিল পশ্চাতভূমি হিসাবে; এখনকার অধিবাসীগণ শোষিত হতে হতে অর্থনৈতিকভাবে নিঃশেষ হয়ে যান। অবস্থা পরিবর্তনে বঙ্গঁভঙ্গ হল ১৯০৫ সনে। অতঃপর বঙ্গঁভঙ্গ রদ ১৯১১ সনে। অনেকেরই মূল্যায়ন ঃ ১৯২১ সনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা বঙ্গঁভঙ্গঁরদের আংশিক ক্ষতিপূরণ তথা পশ্চাতপর পূর্ব বাংলার মানুষের ভাগ্য উন্নয়নে শিক্ষাকে মাধ্যম হিসাবে ব্যবহার করার প্রয়াসেই।
১৯৪০ সনে শেরে বাংলা উত্থাপিত লাহোর প্রস্তাবে (ইন্ডেপেন্ডেন্ট স্টেট্স অব পাকিস্তান) পূর্ববাংলাসহ পূর্বাঞ্চঁলের স্বায়ত্তশাসন প্রদান মাধ্যমে অর্থনৈতিকভাবে বাঙালীর উঠে দাঁড়ানোর ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ মুসলীম লীগের পরবর্তী অধিবেশনে দিল্লীতে বেআইনীভাবে লাহোর প্রস্তাব সংশোধন করে “স্টেটস”কে “স্টেট” বানিয়ে ভবিষ্যতের মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তান থেকে বাংলাকে বাদ দেয়ার ষড়যন্ত্র করেন। সোহরাওয়ার্দী কিরণশংকর শরৎ বসু গ্রেটার বেঙ্গঁল পরিকলল্পনা ও হালে পানি পেল না। স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপসের নেতৃত্বাধীন কেবিনেট মিশন প্ল্যানেও কিন্তু তুলনামূলকভাবে দুর্বল কেন্দ্র শাসিত কনফেডারেশনে স্বায়ত্বশাসিত পূর্বাঞ্চলে বাংলার জনগণের নিজ ভাগ্য গড়ে তোলার ব্যবস্থা ছিল। কেবিনেট মিশন প্ল্যান প্রত্যাখাত হল। একটি মজার ব্যাপার হল, ১৯৩৫ সনে দ্য গভর্ণমেন্ট অব ইন্ডিয়া অ্যাক্টের অধীনে ১৯৪৬ সনে সারা ভারতবর্ষের প্রদেশগুলিতে যে নির্বাচন হয় তাতে বেঙ্গলই একমাত্র রাজ্য যেখানে স্বাধীনতার পক্ষে নিরঙ্কুশ গরিষ্ঠ ভোট পড়ে। আর স্যার সেকেন্দার হায়াৎ খানের নেতৃত্বে পাঞ্জাবের ইউনিয়নিস্ট পার্টি “কন্টিনিউয়েশন অব ব্রিটিশ রাজ” এর পক্ষে ভোট দেয়। সুতরাং ১৯৪৭ সনের আগষ্টে ব্রিটিশ শোষকদের বিদায় হলেও ধর্মের ভিত্তিতে দ্বিজাতি তত্ত্বের মেকী পাকিস্তান রাষ্ট্রটির জন্ম হল। কিন্তু প্রচন্ড দাপটে সেই পাঞ্জাবীরাই সারা পাকিস্তানের শতকরা ছাপ্পান্ন ভাগ জনসংখ্যা অধ্যুষিত পূর্ব বাংলার উপর শাসন শোষনের খড়গ চাপিয়ে দিল। ধর্ম ভিত্তিক পাকিস্তানে ভাষা, সংস্কৃতি ও আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে পূর্ব বাংলাকে মুক্ত করার মানসেই ১৯৪৮ সনে ছাত্রলীগ ও ১৯৪৯ সনে আওয়ামী লীগের জন্ম হয়। শেখ মুজিব প্রথমে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হিসাবে যাত্রা শুরু করলেও ধীরে ধীরে বাংলার আশা আকাঙ্খা ধারণ করে জনগণের অবিসংবাদিত নেতা হিসাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন সংগ্রামে, সাহসে এবং সবশেষে সম্মোহনী শক্তিতে। স্মরণ করা যেতে পারে যে, ধর্মভীরু মুসলমান হওয়া সত্বেও শেখ মুজিব একজন নিবেদিতপ্রাণ খাঁটি অসাম্প্রদায়িক ব্যক্তি ছিলেন; ১৯৫৩ সনে আওয়ামী মুসলীম লীগ সরবে আওয়ামী লীগে পরিণত হয়ে যৌথ নির্বাচনের নীতি গ্রহণ করে তারই নেতৃত্ব ও প্রেরণায়। উল্লেখ্য যে, মুসলিম বাংলার অবাস্তব ও ভ্রান্ত ধারণা তখন যেমন ছিল, এখনও তা অনেককেই বিভ্রান্ত করছে।
ইতিহাস বলে, আওয়ামী লীগ একটি পশ্চিমা উদার শাসন ব্যবস্থায় বিশ্বাসী দল হিসাবেই পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের শুরুতে শক্তি ও প্রসার লাভ করতে থাকে। ১৯৫৭ সনে আওয়ামী লীগ ভাগ হয়ে গেলে শেখ মুজিব সমাজতান্ত্রিক ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টিতে (মাওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে) না গিয়ে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে উদার গণতন্ত্রের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় শাসন ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের দৃশ্যমান পথে নিয়ে যান শেখ মুজিব। ষাটের দশকের শেষার্ধে সাম্যবাদ,সমতা ও অর্থনৈতিক ন্যায্যতা এবং সামাজিক ন্যায় বিচারের স্বার্থে সারা বিশ্বকে আলোড়িত করে প্রবল সমাজতান্ত্রিক ঢেউ সৃষ্টি হয়। তখন পর্যন্ত বাঙালীর আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক মুক্তি আন্দোলনের আদর্শে নিবেদিত প্রাণ ছাত্রলীগ এবং জনাব তাজউদ্দীন আহমেদের প্রভাবে শেখ মুজিব আওয়ামী লীগকে সমাজতান্ত্রিক ধারায় নিয়ে আসেন। একজন অকুতোভয় জাতীয়তাবাদি এবং শতভাগ গণতন্ত্রমনা শেখ মুজিব সাধারণ মানুষের জন্য কল্যাণ সাধনেই সর্বজনীন রাজনীতিতে বিশ্বাস করতেন। তাই তিনি ইংরেজ উপনিবেশ ও পাকিস্তানী আধাউপনিবেশ কালের শোষণে নিঃস্ব বাঙালী জাতিকে অর্থনৈতিক মুক্তির স্বাদ এনে দিতে বদ্ধপরিকর ছিলেন। কোন রকম অত্যাচার, নির্যাতন, জেল-জুলুম শেখ মুজিবকে তার অভীষ্ট লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি। পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা ঘোষণার পূর্বাভাস বলে গণ্য ১৯৬৬ সনের ৭ই জুন শেখ মুজিব ছয় দফা প্রস্তাব উত্থাপন করেন। ১৯৬২ সন থেকে স্বাধীনতার স্বপ্ন লালন করলেও শেখ মুজিব অগ্রসর হতে চান অতি সতর্কভাবে কেননা তিনি বিচ্ছিন্নতাবাদী অপবাদের দুর্নাম চাননি। এটি ছাড়াই তিনি স্বাধীনতা প্রত্যাশি ছিলেন। ছয় দফায় দুই প্রদেশে দুইটি ভিন্ন ভিন্ন মুদ্রা এবং স্বাধীন বহির্বাণিজ্যের অধিকার পাকিস্তানীরা কোনভাবেই মেনে নিতে পারত না। সেভাবেই তৈরী হল ৭ই মার্চ ১৯৭১ সনের প্রকৃত প্রস্তাবে স্বাধীনতার ঘোষণা “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম”। ইতিমধ্যে সর্বদলীয় ছাত্রজনতার এগার দফা ও আওয়ামী লীগের ছয় দফার প্রচন্ড শক্তিতে জেলের তালা ভেঙেই বাংলার নয়নমণি শেখ মুজিবকে মুক্ত করে “বঙ্গঁবন্ধু” ভূষণে গণমানুষের মনের মুকুরে প্রতিষ্ঠা করা হয়।
ছয় দফা, এগার দফা ও গণভভ্যুত্থানের অপ্রতিরোধ্য শক্তি, গতি ও তীব্রতর চলমানতায় ১৯৭০ সনের নির্বাচনে বঙ্গঁবন্ধুর শেখ মুজিবের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সারা পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের নির্বাচনে একক ও নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে বিজয়ী হয়। তিনশ আসনের মধ্যে একশ সাতষট্টি আসনে বিজয়ী হয় ছয় দফা বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতিবদ্ধ বাঙালী জাতীয়তাবাদী শক্তি। সমালোচকরা অবশ্য থেমে থাকেননি। শেখ মুজিব আবারও সমালোচনার সম্মুখীন হলেন। লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডার, এলএফওর অধীনে কেন নির্বাচনে গেলেন! তাদের কে বুঝাবে যে, ওয়ান ম্যান ওয়ান ভোট নীতিতে পাকিস্তানের শতকরা ছাপ্পান্ন ভাগ বাঙালী নির্বাচনে বিজয়ী হবে এ বিষয়ে শেখ মুজিব নিশ্চিত ছিলেন। তাই “দেব আর নেব” এ ভিত্তিতে এক মাথা এক ভোট ও লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্কের মধ্যে সমন্বয় সাধন করা হয়। প্রত্যাশিতভাবেই বঙ্গঁবন্ধুর আওয়ামী লীগ নির্বাচনে জয়ী হয় এং ততোধিক প্রত্যাশিতভাবেই একাত্তরের পহেলা মার্চ তারিখে ঢাকায় অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় পরিষদের অধিবেশন মুলতুবী করা হয়।
দেশ বিস্ফোরনমুখ হয়ে উঠে। শেখ মুজিবের নেতৃত্বে সকল মত ও পথের লোক বাংলাদেশের স্বাধীনতার পতাকাতলে একত্রিত হয়। অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়। বঙ্গঁবন্ধুর নেতৃত্বে পরিচালিত হতে থাকে দেশ। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি থাকে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে। অপরাধপ্রবণতা দূর হয়ে যায়। অস্থিরচিত্ত প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান আলোচনার প্রস্তাব (!) নিয়ে ঢাকায় আসেন। যা হবার তাই হয়। আলোচনা ভেঙে যায়। বঙ্গঁবন্ধু ৭ই মার্চের ধারাাবহিকতায় ২৫শে মার্চ দিবাগত রাতে স্বাধীনতার ঘোষণার পুনারাবৃত্তি করেন। সামরিক শাসক গোষ্ঠি কিন্তু তাদের দুরভিসন্ধি চরিতার্থ করে শেখ মুজিবকে কারাগারে প্রেরণ করে। তবে বন্দী বঙ্গঁবন্ধুকে ফাসির রজ্জুতে মৃতুদন্ড দিতে সাহস পায়নি। ইয়াহিয়া খানের তর্জ্জন গর্জন, “শেখ মুজিবস ট্রিজন শ্যাল নট গো আনপানিশড” অন্তঃসারশূণ্য হয়ে যায়। অশেষ শ্রদ্ধা, ভালোবাসা আর শুভকামনায় বিশ্বজনমত পাকিস্তানী শাসককুলকে বাধ্য করে শেখ মুজিবকে সসম্মানে মুক্তি দিতে। বঙ্গঁবন্ধু দেশে ফিরার পথে দিল্লীতে যাত্রা বিরতি করেন। প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর সাথে গঙ্গাঁর পানি বন্টন চুক্তি ও স্থলসীমান্ত নির্দ্ধারণের আলোচনার সুত্রপাত করেন বলেই অনেকে মনে করেন। তবে বাংলাদেশের স্বাধীন সার্বভৌম ভূমি থেকে ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর দেশে ফিরে যাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করে তবেই ১০ই জানুয়ারী বীর বেশে দেশে প্রত্যাবর্তন করেন তিনি। সকৃতজ্ঞ দেশবাসী তাকে জাতির জনক হিসাবেই স্বাগতম জানালেন। শুরু হল বাঙালীর ভাগ্য বিবর্তনের পালা।
শোকের মাস। ৪০ বছর আগে ১৫ই আগষ্ট ভোরের আলো দিগন্তকে উদ্ভাসিত করার আগেই ইতিহাসের এক বর্বরতম হত্যাকান্ডে সপরিবারে হত্যা করা হল সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী জাতির জনক বঙ্গঁবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। দৈব সৌভাগ্যক্রমে বঙ্গঁবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা বেঁচে রইলেন। বাংলাদেশের কৃষ্ণরজনীর দুই সপ্তাহ আগে ৩০ জুলাই ১৯৭৫ তারিখে স্বামী পরমানু বিজ্ঞানী এম. এ. ওয়াজেদ মিয়ার গবেষণাস্থল জার্মানীতে চলে যান শেখ হাসিনা- সঙ্গে পুত্র, কন্যা ও ছোট বোন শেখ রেহানা। ১৫ই আগষ্ট তারা দেশে থাকলে আজকের দিনে বিশ্বের নজর কাড়া আর্থ-সামাজিক অগ্রগতির যে গৌরব বাংলাদেশ অর্জন করে চলেছে তার হাল ধরার কেই বা থাকত। স্বাধীনতার আদর্শ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং দারিদ্র, অপুষ্টি, শোষণ, বঞ্চনা ও বৈষম্যহীন সোনার বাংলা গড়ার রূপকার ইতিহাসের মহানায়ক বঙ্গঁবন্ধুকে নির্মম ও পৈশাচিকভাবে হত্যা করে সেই আদর্শ এবং জাতিকে যারা নেতৃত্ব শূণ্য করতে চেয়েছিল তার বিচারই বা কোন সাহসে কে শুরু করতে পারতেন। বিচার হয়ে হন্তারকরা ক্রমে ক্রমে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলছে। জাতি আশা করছে সেই হন্তারকদের দায়মুক্তি দিয়ে করা অধ্যাদেশ এবং পরবর্তীতে সংসদে সেই দায়মুক্তিকে আইনী বৈধতা যে দু’জন দিয়েছিলেন, তাদেরও টোকেনভাবে হলেও মরনোত্তর বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে।
এ প্রসঙ্গে বঙ্গঁবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অর্থনীতি কিভাবে কেমন করে এবং কোন অগ্রাধিকারে গ্রথিত হয়েছিল তা স্মরণ করা যেতে পারে। রাজনীতিতে শেখ মুজিবুর রহমানের হাতেখড়ি তার শৈশবে মধুমতি বিধৌত টুংগীপাড়া গিমাডাঙ্গাঁ নদী কিনারে গ্রাম বাঙলার মাঠে ময়দানে। দুটো জিনিস তার মন মানসিকতায় অর্থনীতি সম্পর্কে রেখাপাত করে। প্রথমতঃ তিনি দেখেছিলেন দারিদ্র্যের কদর্য কষাঘাতে মানুষ কিভাবে দুর্দশার চরম শিখরে পৌঁছে সর্বস্বান্ত হয়। দ্বিতীয়তঃ তিনি উপলব্ধি করেন যে পিতা শেখ লুৎফর রহমান ও মাতা সায়েরা বেগম পরম মমতায় গরীব দুখীর পাশে দাঁড়াতেন, অন্ন বস্ত্রের সাহায্যের হাত প্রসারিত করতেন। তাইত বস্ত্রহীন পথচারীকে গায়ের জামা খুলে দিয়ে এলেও এবং পিতার অনুপস্থিতিতে পারিবারিক গোলা থেকে ক্ষুধার জ্বালায় জর্জরিত গরীব দুখীকে ধান বিতরণ করে শেখ মুজিবকে পিতার স্নেহ অনুমোদন পেতে কষ্ট হয়নি। এরপর ঘটনাবহুল দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের প্রতিটি পদে বাঁধা বিপত্তি প্রতিক্রিয়ার জাল চিহ্ন করে ১৯৬২ সন থেকে একটি স্বাধীন বাংলাদেশের চিন্তা। দুখী বাঙালীর অন্ন, বস্ত্র, আশ্রয় ও কর্মসংস্থানের কৃতসংকল্প ভাবনাই দৃপ্ত কন্ঠে উচ্চারণ করলেন শেখ মুজিব। শহর, বন্দর, নগর ছাপিয়ে গ্রাম বাংলার কোটি মানুষ বাঁশের লাঠি সজ্জিত হয়ে খান সেনাদের বিরুদ্ধে লড়াই করে দেশ স্বাধীন করতে রাস্তায় নেমে পড়েন – কারণ নেতা তাদের শেখ মুজিব ডাক দিয়েছেন স্বাধীনতার। পৃথিবীর ইতিহাসে নেতার নির্দেশে এভাবে স্বাধীনতার লড়াই করতে ঝাপিয়ে পড়ার নজির নেই। শহীদানের রক্তগঙ্গাঁয় বহু সাগর পেরিয়ে বহুমূল্যে এলো স্বাধীনতা।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের পথ পরিক্রমায় প্রথমেই যে সকল পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে বঙ্গঁবন্ধুর সরকার তার প্রত্যেকটিকেই চূড়ান্ত বিচারে অর্থনৈতিক মুক্তির পথ হিসাবে দেখা যেতে পারে। স্বাধীনতার দশ মাসের মাথায় বাংলা ভাষায় একটি চমৎকার, আধুনিক ও কার্যকর সংবিধান রচিত হল জাতির জনকের প্রত্যক্ষ দিক নির্দেশনায়। সংবিধানকে বলা যেতে পারে মাতৃ অবকাঠামো যার আলোকে সকল আর্থ-সামাজিক কর্মকান্ড পরিচালিত হবে। দেশের গৌরব শীর্ষ বিজ্ঞানী ডঃ কুদরই-ই-খুদার নেতৃত্বে রচিত হয়ে অনুমোদিত হল একটি বিজ্ঞানমনষ্ক, আধুনিক, দেশ ও যুগোপযোগী একীভূত ধারার এবং অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত মাতৃভাষায় শিক্ষার বিধান সম্বলিত শিক্ষানীতি- সূচিত হল মানব সম্পদ উন্নয়নের ভিত্তি যার মাধ্যমে দক্ষভাবে বাস্তবায়িত হবে অর্থনীতি বিকাশের পরিকল্পনা। এভাবে রাষ্ট্র, সমাজ, রাজনীতি, সংস্কৃতি ও সমাজ জীবনের সকল ক্ষেত্রেই বঙ্গঁবন্ধুর দিক নির্দেশনায় তৈরী হল নীতিমালা ও কৌশলপত্র যাতে আপামর জনসাধারণের অর্থনৈতিক সচ্ছলতায় গড়ে ওঠে কল্যাণ রাষ্ট্র বাংলাদেশ – গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, অসাম্প্রদায়িকতা ও সমাজতন্ত্রের চারটি স্তম্ভমূলে। তবে বাংলাদেশের সংবিধানে যে সমাজতন্ত্র নক্ষত্রের মতো আলো বিকিরণ করছে তা কিন্তু কেন্দ্রীভূত সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের চেয়ে ভিন্ন ধাঁচের। কেন্দ্রীভূত সমাজতান্ত্রিক দেশে সকল সম্পদ তথা উৎপাদনের সকল উপাদান থাকে রাষ্ট্রীয় মালিকানায় আর গণতান্ত্রিক বাংলাদেশে বঙ্গঁবন্ধুর সুস্পষ্ট ইচ্ছার প্রতিফলনে সম্পদের তিন ধরণের মালিকানা সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে – ব্যক্তি মালিকানা, সমবায়ী ও রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রনাধীন।
বাংলাদেশের প্রথম পঞ্চঁবার্ষিকী পরিকল্পনা (১৯৭২-১৯৭৬) প্রণয়ন করেন দেশের চারজন শীর্ষ অর্থনীতিবিদ অধ্যাপকবৃন্দ। এ দলিলে সুস্পষ্ট মুন্সিয়ানা ও আবেগে জ্বল জ্বল করছে কল্যাণ রাষ্ট্রে জনসাধারণের আর্থ-সামাজিক মুক্তির সনদ যা অবশ্যই ছয় দফা ও ৭ই মার্চের ঘোষণার সাথে সম্পূর্ণ সঙ্গতিপূর্ণ। পঞ্চঁবার্ষিকী পরিকল্পনায় সবচেয়ে বেশী গুরুত্ব ও অগ্রাধিকার বিষয়গুলো হচ্ছে অবকাঠামো পুনর্বাসন ও নির্মাণ (বন্দর, রাস্তাঘাট, কলকারখানা, সেতু কালভার্ট, স্কুল কলেজ ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকসহ ব্যাংকিং ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহ), শিক্ষা, পরিকল্পিত পরিবার সম্বলিত জনসংখ্যানীতি, দারিদ্র দূরীকরণ এবং আয় ও সুযোগ বৈষম্য হ্রাসকরণ। এখানে উল্লেখ রয়েছে যে দেশটির মালিক জনগণ যাদের অনেকেই বঞ্চঁনা ও দারিদ্রের কষাঘাতে জর্জরিত; তাদের আয় রোজগার যেন গড় সমষ্টিক অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির হারের চেয়ে বেশী হয়। প্রয়োজন বোধে বিত্তবানদের উপর অতিরিক্ত কর আরোপ করে অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর কল্যাণে অধিকতর জনকল্যাণমূলক কর্মকান্ড চালাতে হবে রাষ্ট্রীয় খাতে। তবে দেশীয় উদ্যোক্তাগণকে প্রণোদনা দিয়ে শিল্প প্রসারে পদক্ষেপ নিতে হবে যাতে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়। সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারের অন্য একটি ক্ষেত্র কৃষিকে প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়। তারই পরিপ্রেক্ষিতে কিষাণ কিষানীর বিরুদ্ধে লঘু দোষে রুজু করা লক্ষাধিক সার্টিফিকেট মামলা তুলে নেয়া হয়। কৃষি উপকরণ তথা বীজ, সার ও কীটনাশক উচ্চমূল্যে আমদানী করে গরীব চাষী ভাইদের মধ্যে বিতরণ করা হয় প্রায় বিনামূল্যে। সাশ্রয়ী সুদে কৃষি ঋণের ব্যবস্থা করা হয়। গভীর নলকুপ ও হালকা নলকুপের মাধ্যমে সেচের ব্যবস্থা করা হয়। কৃষকের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্য মুল্য নিশ্চিত করতে নির্দেশ দেয়া হয়। স্বাধীনতার শুরুতে খাদ্য ও নিত্য ব্যবহার্য পণ্যাদির তীব্র অভাব ছিল। ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশের মাধ্যমে এসব আমদানীর ব্যবস্থা করেন বঙ্গঁবন্ধু। কনজিউমার্স সাপ্লাইজ কর্পোরেশন, কসকর মাধ্যমে খাদ্য ও নিত্য ব্যবহার্য দ্রব্যাদি সাশ্রয়ী মূল্যে বিতরণ করা হয় সারা দেশে। বিধিবদ্ধ ও সংশোধিত রেশনের ব্যবস্থা করা হয়।
অর্থনীতি সম্পর্কে বঙ্গঁবন্ধুর জীবদ্দশায় সর্বশেষ ঘোষণাটি আসে ২৫শে জানুয়ারী ১৯৭৫ সনের বক্তৃতায়। তিনি ব্যাপকভিত্তিক কৃষি সমবায়ের ঘোষণা দেন। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভূমিখন্ডের মালিকানা দলিলে অক্ষুণœ রেখেই সকল কৃষিভূমিকে সমবায়ের অধীনে একীভূত করে আধুনিক পদ্ধতিতে উন্নত চাষবাসের মাধ্যমে পাঁচগুণ ফসল ফলানোর প্রত্যয় ঘোষণা করা হয়। জমিতে যারা শ্রম দেবে সে কৃষকরা উৎপাদনের একটি বড় অংশ পাবেন। রাষ্ট্রের কাছেও যাবে একটি অংশ। এভাবে খেটে খাওয়া মানুষের ভাগ্য বিনির্মাণ করা হবে নিশ্চিতভাবে ও দ্রুতগতিতে। একই সাথে জাতির জনক প্রশাসনে আমূল সংস্কার এনে জেলা গভর্ণর পদ্ধতিতে সকল প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক কর্মকান্ডকে বিকেন্দ্রীকরণ করার বিরাট পরিকল্পনার ঘোষণা করেন। শুরু হয় ১লা আগস্ট ১৯৭৫ তারিখে জেলা গভর্ণরদের মাসব্যাপী প্রশিক্ষণ কর্মসূচী। সব মতামতের সমাহারে সরকার গঠন করার অভিপ্রায়ে বঙ্গঁবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সকল রাজনৈতিক দল বিলুপ্ত করে বাকশাল গঠন করেন। এটা যে একদলীয় শাসন তিনি তা মনে করতেন না; তার ধারণা ছিল যে এ পদ্ধতিতে সকল মত ও পথের মানুষকে এক ছায়াতলে আনা হল। বাকশাল, ইহার অন্তর্ভূক্ত অর্থনৈতিক মুক্তির প্রোগ্রাম ও প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের বিষয়টি ভালভাবে অনুধাবন না করেও অনেকে ইহার সমালোচনা করেন।
১৫ই আগষ্টের বিয়োগান্তক ঘটনাবলী সংগঠিত করে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শও মহান স্বাধীনতার চেতনাকে হত্যা করা হবে বলে যারা মনে করেছিল সেই কুচক্রীদের উদ্দেশ্য মোটেও সফল হয়নি। আজ বাংলাদেশের বলিষ্ঠ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও বিপুল সামাজিক অগ্রগতি সারা বিশ্বে নন্দিত. প্রশংসিত। আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে দৃষ্টিনন্দন সাফল্য ছাড়াও শিক্ষাক্ষেত্রে এসেছে বিপুল অগ্রগতি। বছরের প্রথম দিনে ৩৬ কোটি নতুন বই বিনামূল্যে ছাত্র ছাত্রীরা হাতে পায় উৎসবের আমেজে। শিক্ষার হার এখন শতকরা ষাট ভাগ ছাড়িয়ে। কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়–য়া ছাত্র ছাত্রীর সংখ্যা জনসংখ্যার প্রায় দুই শতাংশ। প্রাথমিকে এখন ভর্তির হার শতভাগের প্রায় কাছাকাছি এবং ঝরে পড়ার হার ত্রিশের কোটায়। বিদ্যুৎ সমস্যার এখন অনকটাই সমাধান হয়ে গেছে। বাংলাদেশের গর্বিত নাগরিকরা এখন এম.আর.পি নিয়ে বিদেশে ভ্রমণ করেন। অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে নারীর অংশগ্রহণ এখন শতকরা ৪০ ভাগ এবং গতি ঊর্ধমূখী। ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান, সমুদ্রসীমা বিজয় আর গতিময় পররাষ্ট্্রনীতিসহ একটি উদ্ভাবনী নীতিমালার সুফলে বাংলাদেশ আজ অর্থনীতির পরাশক্তিসমূহের বিশেষ সখ্যতার আহ্বান পাচ্ছে। বলতে দ্বিধা নেই, জাতির জনকের সম্মোহনী ক্ষমতার সমকক্ষ না হলেও নিজ সাহস, দক্ষতা ও অধিকারে রাজনৈতিক নেতৃত্বে আসীন হয়েছেন শেখ হাসিনা। ১৯৬৬ সনে আইয়ুব-মোনেমের প্রত্যক্ষ মদদপুষ্টদের হারিয়ে তখনকার ইডেন কলেজ তথা এখনকার বদরুন্নেসা কলেজের ছাত্র সংসদের সহ-সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন বেশ দাপটের সাথেই। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতির জনকের অর্থনীতির রূপরেখা অনুসরণ করেই সফলতার পথে অগ্রসর হচ্ছেন। তবে বঙ্গঁবন্ধুর কাঙ্খিত এবং অনেক দেশে সফল সমবায়ের শক্তিশালী মাধ্যমকে এখনও অর্থনীতিতে ধারণ, গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা হয়নি। বলতে দ্বিধা নেই, আজকের জটিল ও সমস্যাপ্রবণ বিশ্বে যুগের উপযোগী অর্থনীতি ও রীতিনীতি কৌশল গ্রহণ করেছেন শেখ হাসিনা- নি¤œ আয়ের দেশ থেকে বিশ্বব্যাংকের স্বীকৃতি অনুসারেই বাংলাদেশ আজ নি¤œমধ্যম আয়ের দেশ। বর্তমান প্রেক্ষিতে বুদ্ধিমত্তার সাথে নতুন করে প্রযুুক্তি নির্ভরতায় উৎপাদনসহ সকল কর্মকান্ডে দক্ষতা ও উৎকর্ষতা আনয়নের অত্যন্ত প্রশংসনীয় উদ্যোগ নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। আমরা অনেকেই পথ চেয়ে- কত শীঘ্র মধ্যম মানব সম্পদ সূচকে পদার্পন করবে কল্যাণ রাষ্ট্র বাংলাদেশ- ঘুচে যাবে দুখী মানুষের সকল অভাব, আপন মহিমায় প্রজ্জলিত হবে সোনার বাংলার সোনার মানুষ।
শেষ করার আগে জাতির জনক বঙ্গঁবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কথিত দুর্বলতার দিকগুলি দৃঢ়ভাবে খন্ডন করে কিছু বাস্তব তথ্য পেশ করতে চাই। তার প্রশাসনিক দক্ষতা কম ছিল বলে যে অপবাদ রয়েছে তা মেনে নেয়া যায় না। সদ্য স্বাধীন দেশে বড় ধরণের কোন বিশৃঙ্খলা হতে দেন নাই তিনি। সশস্ত্র সংগ্রামে স্বাধীনতা অর্জিত অন্যান্য দেশের ন্যায় বিপুল প্রাণহানী এখানে ঘটতে দেয়নি শেখ মুজিব সরকার। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশকে একটি কার্যকর ও সর্বজনে গ্রহণযোগ্য শাসনব্যবস্থায় নিয়ে আসেন জাতির জনক।
১৮৬০ সনের পুুলিশ রেগুলেশন অব বেঙ্গঁলে (পিআরবি) জেলা পুলিশ সুপারের বার্ষিক গোপনীয় প্রতিবেদন লেখার কর্তব্য জেলা প্রশাসকের উপর ন্যস্ত। স্বাধীনতার পর বঙ্গঁবন্ধুর ওপর প্রচন্ড চাপ সৃষ্টি হয় এ বিধান উঠিয়ে দিতে। তিনি রাজী হন নাই এ যুক্তিতে যে অস্ত্রসজ্জিত বাহিনীর নজরদারী বেসামরিক সিভিলিয়ানদের হাতে থাকাই উত্তম। মহান মুক্তিযুদ্ধের বীর সেনানীদের মধ্যে যারা সরকারী কাজে নিয়োজিত তাদের দু’বছরের অ্যান্টিডেটেড সিনিয়রিটি দিতে বঙ্গঁবন্ধু রাজী হন নাই কারণ এতে একজন মানুষের জন্মতারিখ দু’বছর আগে চলে যাবে। সৃষ্টি হতে পারে বিভেদ। তিনি বরং ভাবতে বলেন, মুক্তিযোদ্ধাদের কি কি উপায়ে আরো বেশী বেশী সম্মানিত ও উপকৃত করা যেতে পারে। উভয় বিষয়েই অবশ্য ১৯৭৭ সনে সরকারী আদেশ জারী হয়ে যায়।
বাংলাদেশে বিদেশী অর্থ সাহায্যের বিষয়ে বিশ্ব ব্যাংকের সাথে গোল বাঁধে। জাতির জনক শর্ত দেন যে, বিশ্বব্যাংকের নেতৃত্বে যে এইড কনসোর্টিয়াম হয়ে থাকে তার প্রথমটি যেন প্যারিসের বদলে ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয়। বিশ্বব্যাংক পাল্টা শর্ত দেয় যে এর আগে পাকিস্তান সরকারের বিদেশী দায়দেনার অংশবিশেষ যেন বাংলাদেশ স্বীকার করে নেয়। বঙ্গঁবন্ধু পরিকল্পনা কমিশনের পরামর্শ নেন। তবে অনড় থাকেন এ বলে যে আগে পাকিস্তান স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করুক তারপরে পূর্ব বাংলার যে সকল প্রকল্পে বৈদেশিক সাহায্য ব্যবহৃত হয় সেগুলোর দায় নেয়া যেতে পারে। তবে শুধু দায় নয়, সম্পদ ও দায় বিষয় দুটো একসঙ্গে আলোচনা করা যাবে। যে কারণে বাংলাদেশের সৃষ্টি বিশ্বব্যাংক যেন আবার সেই অন্যায় চাপিয়ে না দেয়। তেয়াত্তর সনে এইড কনসোর্টিমের সভা কিন্তু ঢাকাতেই অনুষ্ঠিত হয়।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, ১৯৫ জন পাকিস্তানীকে ছেড়ে দেয়া এবং সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার ব্যাপারে অন্যায্য প্রচার প্রচারণা আজও চলছে। প্রকৃতি চিত্রটি বর্ণনা করতে চাই। কোলাবরেটর আইনের অধীনে কয়েক হাজার যুদ্ধবন্দীকে গ্রেফতার করা হয়। মামলাও করা হয়। মামলায় কয়েকজনের সাজাও হয়। প্রফেসর গোলাম আজমসহ আট জনের নাগরিকত্ব বাতিল করে বঙ্গঁবন্ধু সরকার। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করার আইন শেখ মুজিব সরকারই পাস করে। আর সাধারণ ক্ষমার ঘোষণাতেই স্পষ্ট করে বলা আছে যে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে হত্যা, ধর্ষণ, লুন্ঠন ও অগ্নিসংযোগের হিংসাত্মক ঘটনায় যারা জড়িত ছিল তারা ছাড়া বাকীরা সাধারণ ক্ষমা পেতে পারে। ১৯৫ জন পাকিস্তানী যুদ্ধবন্দীর মুক্তির বিষয়ে ত্রিদেশীয় আলোচনায় বঙ্গঁবন্ধুর সরকার এ জন্য রাজী হয় যে অন্যথায় বাংলাদেশ বিশ্বসভায় একঘরে হয়ে যেত। অনেক দেশই তখন পর্যন্ত স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়নি। বাংলাদেশ তখনও জাতিসংঘের সদস্য হয় নাই। তাছাড়া অনেক বিশিষ্টজনসহ লক্ষাধিক বাংলাদেশী তখনও পাকিস্তানের কারাগারে; তাদের মুক্তির পথ খোলা রাখতেই হত।
চুয়াত্তর সনে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গঁবন্ধু এক রাষ্ট্রীয় সফরে ইরাক যান। সফর শেষে যে যৌথ ইশতেহার প্রকাশ করার কথা, ইহার খসড়া দেখে তিনি বিস্মিত। এতে উল্লেখ ছিল আরব উপসাগর। বঙ্গঁবন্ধু, পুরানো ম্যাপ পর্যালোচনা করতে বললেন কর্মকর্তাদের। কারণ ঐ সাগরের নাম পারস্য উপসাগর। ইরাকীরা তা মানতে চায়নি। বঙ্গঁবন্ধুর উপস্থিত বুদ্ধির ফলে দ্য গাল্ফ লিখতে রাজী হলেন। সে ভাবেই যৌথ ইশতেহার প্রকাশিত হল।
বঙ্গঁবন্ধু সতের দিনের সফরে রাশিয়ায় যান চিকিৎসার জন্য। সফরসঙ্গী এক মিডিয়া ব্যক্তি লোভ সামলাতে না পেরে হোটেল পরিচারিকার সাথে অশোভন আচরণ করে বসেন। আমার কাছে খবর আসে ঘটনার কয়েক মিনিটের মধ্যেই। বঙ্গঁবন্ধু সঙ্গেঁ সঙ্গেঁই ঐ ব্যক্তিকে দেশে পাঠানোর নির্দেশ দেন। রাশিয়ান কর্তৃপক্ষ যখন রাষ্ট্রপতির কাছে নালিশ নিয়ে আসে তখন তিনি জানলেন যে ঐ কর্মকর্তাকে চাকুরীচ্যুত করা হয়েছে; পরবর্তী ফ্লাইটে তাকে দেশে ফেরৎ পাঠানো হবে। ঘটনার সাথে জড়িত হোটের পরিচারিকারও এতে কোন ইন্ধন ছিল কি না তা যেন তারা অবশ্যই খতিয়ে দেখেন।
শেখ কামালের কথিত ব্যাংকলুট সম্পর্কে অত্যন্ত আপত্তির ও মিথ্যাচার করা হয়। একজন দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে শেখ কামাল দেশের নিরাপত্তা সম্পর্কে উদ্বিগ্ন থাকতেন। ১৯৭৪ সনের বিজয় দিবসের প্রাক্কালে ১৫ই ডিসেম্বর রাতে সন্ত্রাসী মনে করে পুলিশের এক গাড়ীর পিছনে ধাওয়া করেন। পুলিশও শেখ কামলকে সঠিকভাবে সনাক্ত করতে না পেরে দুষ্কৃতিকারী ভেবে গুলি চালায়। আহত হন শেখ কামাল। এতে ব্যাংক ডাকাতির কোন সম্পর্কই ছিল না।
১৯৭৫ সনের ২রা জানুয়ারী জাতির জনক মহামান্য রাষ্ট্রপতির উত্তরা গণভবন থেকে হেলিকপ্টারে ঢাকা ফিরে আসেন। ঢাকায় নামতেই তিনি অবহিত হন যে সর্বহারা নেতা সিরাজ সিকদার পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছেন। বঙ্গঁবন্ধুর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া “লোকটাকে তোরা মেরে ফেললি”। এ বিষয়ে তার যে পূর্বে কোন ধারণাই ছিল না স্বতঃস্ফুর্ত এ বক্তব্য তারই সাক্ষ্য বহন করে। পরে সংসদে, “কোথায় আজ সিরাজ সিকদার” বলে যে অভিমানী বক্তব্য দেন তার মাধ্যমে হঠকারী রাজনীতি থেকে মধ্যবিত্তদের দূরে সরে থাকার আর্তিই ফুটে ওঠে। আমার জানামতে সিরাজ সিকদারের বোন শামিম সিকদার বা তাদের পরিবারের অন্য কেউ সর্বহারা নেতার অস্বাভাবিক মৃত্যুর জন্য কখনও জাতির জনককে দায়ী করেননি।
১৮৬৬ সনে বৃটিশ শাসকরা একটি নিবর্তনমূলক আইন “দ্যা ড্রামা কন্ট্রোল অ্যাক্ট” চাপিয়ে দেয় ভারতীয়দের উপর। আতাউর রহমান সাজু ও আলী যাকের সেই আইন অগ্রাহ্য করে এবং পান্ডুলিপি থানায় জমা না দিয়েই ১৯৭৪ সনের নভেম্বরে একটি নাটকের আয়োজন করে। থানার দারোগা এসে নাটকের প্রদর্শনী বন্ধ করে দেয়। পরের দিন আব্দুল্লাহ আল মামুনের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল জাতির জনকের সাথে দেখা করে ঐ উপনিবেশিক আইন বাতিলের অনুরোধ করে। রাষ্ট্রপতি তাৎক্ষণিকভাবে ঐ কালাকানুন বাতিলের আদেশ দেন ও শিল্পকলা একাডেমীকে এ বিষয়ে সকল আইনী কর্মকান্ড সম্পন্ন করতে বলেন।
বঙ্গঁবন্ধুর শাসনামল তিন বছর সাত মাস চারদিন। তিনি মাঝে মধ্যে “চাটার” দলের কর্মকান্ডে বিব্রত ও বিরক্ত হতেন বটে। কিন্তু সে সময় কেনাকাটাসহ কোন বিষয়েই বড় কোন দুর্নীতির ঘটনা ঘটেনি। আজ ৪০ বছর পর জাতির পিতার স্মৃতির প্রতি সম্মান দেখিয়ে আমরা সবাই কি একটি দ্নর্ুীতি ও সন্ত্রাসমুক্ত সমৃদ্ধ সোনার বাংলা গড়ার সংগ্রামে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পাশে দাঁড়াতে পারি না। সকল বিরোধী শক্তি কি জাতির জনককে সকল বিতর্কের ঊর্ধে রেখে তাকে উপযুক্ত সম্মানের আসনে রেখে অন্ততঃ এই একটি ব্যাপারে একমত হতে পারিনা!

বাংলাদেশ