হরিদাসের চুল কাটার দোকান সোবহানবাগে , ধানমন্ডি ৩২ নাম্বারের কাছেই। দোকানের বাইরে সাইনবোর্ড টাঙ্গিয়ে রেখেছে
“ শেখের বাড়ি যেই পথে, আমার সেলুন সেই পথে”
তবে সে কাস্টমারের দৃষ্টি আকর্ষনের জন্য এই সাইনবোর্ড লাগায় নাই। তার মনে ক্ষিন আশা এই সাইনবোর্ড একদিন বঙ্গবন্ধুর নজরে আসবে। তিনি গাড়ি থামিয়ে নেমে আসবেন। গম্ভির গলায় হাক ছাড়বেন – কি সব ছাতা মাথা লিখেছিস, কি নাম তোর? দে আমার চুল কেটে দে। তারপর বিনা তেলে মাথা মালিশ।
বঙ্গবন্ধুর পক্ষে এ ধরনের কথা বলা মোটেই অসাভাবিক না, বরং সাভাবিক। সাধারন মানুষের সাথে তিনি এমন আচরন করেন বলেই তার নাম বঙ্গবন্ধু।
১৫ আগস্ট ৭৫। শেষ রাতে ভীষন শব্দে হরিদাসের ঘুম ভেঙ্গে গেল। তার মনে হল ভুমিকম্প হচ্ছে। দৌড়ে দোকান থেকে বের হয়ে হতবাক। এ কি? তার দোকানের সামনে আলিশান এক ট্যাঙ্ক। ট্যাঙ্ক পেছনের দিকে রিভার্স করছে মুখ ঘুরানোর জন্য, তার দোকানের দিকেই আসছে। কঠিন কিছু কথা বলার জন্য নিজেকে রেডি করল। কিন্তু একটু পরেই ট্যাঙ্কের পেছনের ধাক্কায় তার দোকান তার উপরেই ভেঙ্গে পরল। ১৫ আগস্ট হত্যাকান্ডের সুচনা হল হরিদাসের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে।
……………………………………………………………………….
ঢাকা মসজিদের শহর। সব মসজিদেই ফজরের আজান হয়। সেই আজানের ধনির সাথে নিতান্তই বেমানান কিছু কথা বঙ্গবন্ধুকে বলছে এক মেজর, মহিউদ্দিন। এই মেজরের হাতে স্টেনগান। শেখ মুজিবের হাতে পাইপ। তার পরনে সাদা পাঞ্জাবি আর ধূসর চেক লুঙ্গি।
শেখ মুজিব বললেন, তোমরা কি চাও? মেজর বিব্রত ভঙ্গিতে আমতা আমতা করতে লাগল। শেখ মুজিবের কঠিন ব্যাক্তিত্তের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা তার পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। শেখ মুজিব আবার বললেন, তোমরা চাও কি?
মেজর মহিউদ্দিন বলল, স্যার, একটু আসুন।
কোথায় আসব?
মেজর আবারও আমতা আমতা করে বলল, স্যার, একটু আসুন।
শেখ মুজিব বললেন, তোমরা কি আমাকে খুন করতে চাও? পাকিস্তানি সেনাবাহিনী যে কাজ করতে পারে নাই, সে কাজ তোমরা করবে?
এই সময় অটোমেটিক স্টেংগান হাতে ছুটে এল মেজর নূর। শেখ মুজিব তার দিকে ফিরে তাকানোর আগেই সে ব্রাশফায়ার করল। সময় ভোর পাচটা চল্লিশ। বঙ্গপিতা সিড়িতে লুটিয়ে পড়লেন। তার হাতে ছিল প্রিয় পাইপ।
……………………………………………………………………
সকাল ৭ টা, ১৬ আগস্ট ১৯৭৫। বেতারে ঘন ঘন একটি বিজ্ঞপ্তি প্রচার করা হচ্ছে। উল্লসিত গলায় একজন বলছে “আমি ডামিল বলছি। সৈরাচারী মুজিব সরকারকে এক সেনা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে উৎখাত করা হয়েছে। সারা দেশে মার্শাল ল জারি করা হলো।“
মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধু হত্যার খবর শুনে বির্বিকার ভঙ্গিতে বললেন, president is dead, so what? Vice president is there. Uphold the constitution.
………………………………………………………………………………
৩২ নম্বরের বাড়িতে এসেছেন র এর পরিচালক কাও। তিনি এসেছেন পান বিক্রেতার ছন্দবেশে। শেখ মুজিব বিরক্ত গলায় বললেন, আমি আপনাকে চিনি। অনেকেই আপনাকে চিনে। আপনার ছন্দবেশ ধরার প্রয়োজন পড়ল কেন?
কাও বললেন, মাঝে মাঝে নিজেকে অন্য রকম ভাবতে ভাল লাগে। আপনাকে উৎখাতের ষড়যন্ত্র হচ্ছে। মেজর রশিদ, ফারুক, লে. কর্নেল ওসমানি এ বিষয়ে আলোচনায় বসেন জিয়াউর রহমানের বাসায়। এই বিষয়ে আপনাকে অবহিত করতে এসেছি।
শেখ মুজিব বলেন, আপ্নারা অতিরিক্ত সন্দেহপ্রবন। পান বিক্রেতার ছন্দবেশে যে আমার কাছে তথ্য দিতে আসে, তার কথায় আমার ভরসা নাই।
স্যার আপনার সামনে মহাবিপদ।
মহাবিপদ আমি পার করে এসেছি। পাকিস্তানের কারাগারে যখন ছিলাম, তখন বিপদ আমার ঘাড়ে বসে ছিল। এখন বিপদ নেমে গিয়েছে।
ঘাড় থেকে নামেনি স্যার!
শেখ মুজিব বললেন, যাদের কথা আপনি বলছেন, তারা আমার সন্তানসম। আমি এই আলোচনা আর চালাব না। শরীরটা ভাল না, যদি কিছু মনে না করেন তাহলে আমি ঘুমাতে যাব।
…………………………………………………………….
সিগারেটে টান দেওয়া মাত্র মেজর ফারুকের মাথায় আবার পরিকল্পনাটা খেলতে শুরু করল। শেখ মুজিবকে হত্যা করে দেশে একনায়কতন্ত্রের অবসান করতে হবে।
পরিকল্পনা এখন ঈগল পাখি। পাখির দুটি ডানা। একটি হলো সামরিক। হত্যা কিভাবে করা হবে? কারা করবে? দিতীয় ডানা হচ্ছে রাজনৈতিক। এত বড় ঘটনা রাজনৈতিকভাবে কিভাবে সামাল দেওয়া হবে? এই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে তার ভায়রা ভাই মেজর রশিদকে। সে ইতিমধ্যে কাজ শুরু করেছে। তার উপর ভরসা করা যায়।
খন্দকার মোসতাকের আগামসি লেনের বাড়ির দোতলায় মেজর রশিদ বসে আছেন। তার গায়ে সামরিক পোষাক না। তিনি আজ নকশীদার পাঞ্জাবি পরেছেন। মাথায় কিস্তি টুপি পরেছেন। তাকে দেখে মনে হবে, কিছুক্ষন আগে তিনি একবার নামাজ শেষ করে বন্ধুর বাড়িতে বেড়াতে এসেছেন।
রশিদ বললেন, দেশের মহাবিপদে যদি কখনো কিছু হয়, আমরা কি আপনাকে পাব?
মোসতাক জবাব দিলেন না। ফরাসি হুক্কা টানতে লাগলেন। মাথায় নেহেরু টুপি। তার আশা ছিল এই টুপি দেশে জনপ্রিয় হবে। তা হয়নি। মুজিবকোট জনপ্রিয় হয়েছে। কাল রংএর এই কোট পরলে নিজেকে পেঙ্গুইনের মত লাগে। তার পরেও কপালের ফেরে পরতে হয়।
রশিদ আবার জিজ্ঞাসা করলেন , আপনাকে একটা প্রশ্ন করেছি। আপনি জবাব দেন নি। জবাব জানা বিশেষ প্রয়োজন।
মোসতাক বললেন, আমরা মানে কারা?
সেনাবাহিনী।