বাবা, মা আর ২ ভাই এক স্কুটারে ৪ জন। জায়গার হয়তো টানাটানি ছিল, কিন্তু ইচ্ছে আর সঙ্কল্পের জ্বালানি একটু বেশিই ছিল দু’চাকার ওই বাহনে। তাই চেন্নাইয়ের অতি সাধারণ ২কামরার ফ্ল্যাট থেকে যাত্রা শুরু করলেও, সিলিকন ভ্যালির আগে তা থামেনি। আর গুগ্লের মতো এক ডাকে চেনা সংস্থার সিইও হয়েও তাকে রূপকথা মনে হতে দেননি বাড়ির বড় ছেলে ‘পিচাই সুন্দররাজন’। তথ্যপ্রযুক্তির তামাম দুনিয়া যাঁকে সুন্দর পিচাই নামে চেনে। গতকাল মঙ্গলবারই তার হাতে গুগ্লের রাজ্যপাট তুলে দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছেন সংস্থাটির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ল্যারি পেজ।
সকলকে চমকে দিয়ে এ দিন পেজ জানান, চোখ ধাঁধানো সাফল্য সত্ত্বেও গুগ্লের ব্যবসা ঢেলে সাজছেন তাঁরা। এ বার থেকে মূল সংস্থার নাম হবে ‘অ্যালফাবেট’। তার নেতৃত্ব দেবেন তিনি এবং অন্য প্রতিষ্ঠাতা সের্গেই ব্রিন। আর সেই অ্যালফাবেটের প্রধান শাখা হবে গুগল। যার আওতায় থাকবে অ্যান্ড্রয়েড, সার্চ, অ্যাড (বিজ্ঞাপন), ইউটিউব, ম্যাপের মতো ব্যবসা। এই ছিপছিপে, মেদহীন গুগল সামলানোর দায়িত্ব বর্তাবে সুন্দরের উপর। যাঁকে ওই কাজে পেয়ে নিজেকে ভাগ্যবান মনে করছেন পেজ! পেজের কথায়, ‘আমি ভাগ্যবান যে, সুন্দরের মতো মেধাবী, পরিশ্রমী আর গুগ্লের প্রতি দায়বদ্ধ লোক সংস্থা চালাবেন।’
মেদহীন, কারণ এই নতুন গুগ্লই আসলে অ্যালফাবেটের প্রধাণ রাজকোষ। বছরে প্রায় ৬,৬০০ কোটি ডলারের ব্যবসা করে মার্কিন তথ্যপ্রযুক্তি বহুজাতিকটি। মুনাফা প্রায় ১,৬০০ কোটি। আর এর প্রায় পুরোটাই আসে সেই সমস্ত ব্যবসা থেকে, যার দায়িত্ব যাচ্ছে সুন্দরের হাতে। যেমন, অ্যান্ড্রয়েড, সার্চ, অ্যাড, ইউটিউব, আর গুগ্ল ম্যাপ। পেজের দাবি, গত কয়েক মাসে সুন্দর যে ভাবে সব সামলাচ্ছিলেন, তাতে এই ঘোষণা স্রেফ সময়ের অপেক্ষা ছিল। কোনও রূপকথা নয়।
পিচাইয়ের উঠে আসা:
বিজনেস ইনসাইডার ম্যাগাজিনের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৮ সালে গুগলের যে দলটি ক্রোম ব্রাউজার নিয়ে কাজ করছিল, সে দলের সদস্য ছিলেন পিচাই। এ সময় তিনি গুগল টুলবার, ডেস্কটপ সার্চ, গ্যাজেটস, গুগল গিয়ার অ্যান্ড গ্যাজেটসের মতো বিভিন্ন সার্চ ইঞ্জিন সংক্রান্ত পণ্য নিয়ে কাজ করেছিলেন। ২০০৪ সালে পণ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে গুগলে যোগ দেওয়ার আগে অ্যাপ্লাইড ম্যাটেরিয়ালস নামের একটি পণ্য নির্মাতা প্রতিষ্ঠানে প্রকৌশলী হিসেবে কাজ করেছিলেন। পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ম্যাকেনসি অ্যান্ড কোম্পানিতেও কাজের অভিজ্ঞতা রয়েছে তাঁর।
মাত্র ৪৩ বছর বয়সে গুগলের ক্ষমতা হাতে এল। অথচ ১২ বছর বয়স হওয়ার আগে টেলিফোনেও হাত দেননি পিচাই। বাড়িতে ছিলই না। ছিল না টিভি। ভারতের চেন্নাইয়ে চলাফেরা করতেন বাদুড় ঝোলা বাস ও স্কুটারে।
সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবার। বাবা কারখানার ইঞ্জিনিয়ার। সুন্দরের জন্ম হওয়ার আগে মা কাজ করতেন স্টেনোগ্রাফারের। সুন্দরকে বিদেশে পড়াতে পাঠানোর জন্য ঋণ জোগাড় করতে পারেননি বাবা। তবু হাল ছাড়েননি তিান। নিজের অ্যাকাউন্ট প্রায় খালি করে তুলে দিয়েছেন সব টাকা। যা কিনা তখন তার এক বছরের বেতনের থেকেও বেশি ছিল।
স্কুলে বরাবর ভাল রেজাল্ট করা সুন্দর ছিলেন ক্রিকেট ক্যাপ্টেন। ফুটবলের অত্যন্ত ভক্ত।
সুন্দর পিচাইয়ের জন্ম ভারতের তামিলনাড়ুতে। ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি (আইআইটি) খড়গপুর থেকে প্রযুক্তিতে স্নাতক সম্পন্ন করেছেন তিনি। পরে স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞান বিষয়ে স্নাতকোত্তর শেষ করেন, যা কিনা ছিল গুগলের জন্মস্থান। বিজ্ঞান বিষয়ে পড়াশোনা করার পর তিনি পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়ার্টন স্কুল থেকে এমবিএ শেষ করেন।
২০০৪ সালে গুগলের সদর দফতরে প্রথম পা। চাকরির ইন্টারভিউ চলাকালীন সময়ে তাকে বলা হয়েছিল, সে দিনই নাকি জি-মেইল বাজারে আনতে যাচ্ছে গুগল।
গুগলের এই প্রধান নির্বাহীর তৈরি কয়েকটি সেবা আপনার খুবই পরিচিত। গুগলের ক্রোম ব্রাউজার ও অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল অপারেটিং সিস্টেম তৈরিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রয়েছে তার।
আমেরিকায় এসে ৬০ ডলার দিয়ে ব্যাগ কিনতে পারেননি। আজ ৬,৬০০ কোটি ডলারের সংস্থা তাঁর কাঁধে!