মহাসমাবেশে দেয়া খালেদার বক্তৃতায় নতুন কিছু নেই। তত্ত্বাবধায়ক ইস্যুতে ৯০ দিনের যে আলটিমেটামের কথা বলা হয়েছে তা বিরোধী দলের নেত্রী একাধিকবার আগেও তা নানাভাবে বলেছেন। বক্তৃতা বেশি লম্বা হওয়াতে তা মাঝে মাঝে ঝুলে পড়েছে। ছবিতে দেখলাম, নেতাদের অনেকে ঝিমুচ্ছিলেন! ভবিষ্যতে ক্ষমতায় গেলে কী করবেন না করবেন, এ ব্যাপারে যে সব গুচ্ছ প্রস্তাবে যা বলা হয়েছে, সে সবও বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নতুন নয়। ডিগ্রি পর্যন্ত অবৈতনিক শিক্ষা জাতীয় এর অনেক কিছু এখনই বাংলাদেশে কমবেশি আছে। খালেদা সেগুলোর কিছু এক্সটেনশন বলেছেন মাত্র। দু`বার প্রধানমন্ত্রী থাকার সময় এসব করেননি কেন, সে প্রশ্নও আসতে পারে। খালেদা জিয়া যদি শেয়ারবাজারে ক্ষতিগ্রস্তদের টাকা ফেরত দেবার কথা বলতেন, তবে সেটি নতুন কিছু হতো। শেয়ারবাজারে ক্ষতিগ্রস্ত একজনের বক্তব্য দিয়ে মহাসমাবেশ শুরু করা হয়েছে। কিন্তু এর ক্ষতিগ্রস্তদের ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব না থাকায় স্পষ্ট, তারা আসলে ইস্যুটি নিয়ে শুধু রাজনীতি করছেন।
‘আমরাও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাই’ একথা নানা সময়ে বললেও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে মহাসমাবেশে এক ঘণ্টার বেশি বক্তৃতা দিলেও এ নিয়ে তার কোনো বক্তৃতা বা প্রতিশ্রুতি নেই। উল্টো গ্রেফতারকৃত জামায়াত-বিএনপি নেতাদের মুক্তি দাবি করেছেন। যুদ্ধাপরাধীদের দলটিকে জোটে রেখে তিনি তাদের বিচারের কথা বলবেন, এমনটি অবশ্য কেউ আশাও করেনি। এসবের মাধ্যমে দিনে দিনে যে সত্যটি আরও বেশি উজ্জ্বল হয়ে প্রকাশিত তা হলো, খালেদা আবার ক্ষমতায় যেতে পারলে এ বিচার বন্ধ হয়ে যাবে। আটক যুদ্ধাপরাধীদের গাড়িতে তিনি আবার স্বাধীনতার পতাকা দেবেন। তাদের নিয়ে আবার গঠন করবেন মন্ত্রিসভা! বিজেবি নিয়ে তিনি যে বক্তব্য দিয়েছেন, তাও উস্কানিমূলক। তিনি তাদের আইনানুগ নির্দেশ দিতে বলেছেন। এর মানে খুন কা বদলা খুন! খালেদা জিয়া ক্ষমতায় থাকতে থাকতেও সীমান্তে হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। তিনি কি তখন পাল্টা হত্যাকাণ্ডের নির্দেশ দিয়েছেন? না, এমনটি বাস্তব? না উল্টো ভারতকে খুশি করতে ভারতীয় নিম্নমানের গাড়ির একচেটিয়া বাজার গড়তে জাপানি রি-কন্ডিশনড গাড়ির আমদানি বন্ধ করেছিলেন? এই যে ঢাকার রাস্তায় এত ভারতীয় সবুজ অটোরিকশা, এগুলো বাংলাদেশে সয়লাব করিয়েছে কে? অথবা মুড়ির টিন মার্কা কালো সব ট্যাক্সিক্যাব? বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এসেও এসবের যথেচ্ছাচার বন্ধ করেনি।
নতুন নেতৃ্ত্বকে ক্ষমতায় বসাবেন খালেদা জিয়া, এটি আবারও বলেছেন। তা কী তার তারেক অথবা তারেকের স্ত্রী? তারেক কী গেলবার আনঅফিয়ালি বাংলাদেশের ক্ষমতায় ছিলেন না? হাওয়া ভবনের নামে প্যারালাল কেবিনেট চালাননি তারেক? হাওয়া ভবনের কী অভিজ্ঞতা দেশের মানুষের? হাওয়া ভবনের নেতৃ্ত্ব যদি তরুণ নেতৃ্ত্বের মডেল হবে তাহলে গত নির্বাচনে হারার পর কেন সেই গণধিকৃত ভবনটি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল? সিঙ্গাপুরের ব্যাংকে জব্দ টাকাগুলা কার? একবারও কী জোর গলায় বলার সাহস হয়েছে, যে ওই টাকাগুলা তারেক-কোকোর না। আমেরিকানরা প্রতিহিংসাবশত ওই বদনাম দিয়েছে। বর্তমান সরকারি লোকজনের দুর্নীতি-স্বেচ্ছাচারিতা নিয়ে দেশের মানুষ বিক্ষুব্ধ। কিন্তু এদের বিকল্প কী বিদেশে টাকা পাচারকারী তারেক রহমান? আবার কী লুৎফুজ্জামান বাবরের মতো ব্যক্তিকে দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়া হবে? পুরনো সব দুর্নীতি-ভুল স্বীকার না করলে দেশের মানুষ শুধু ‘এই চোরের চেয়ে ওই চোর ভালো’ ভাববে, এমন গ্যারান্টি কে দিয়েছে?
তত্ত্বাবধায়ক অথবা নির্দলীয় সরকার ইস্যুতে খালেদা জিয়ার দাবির প্রশ্নে আমিও একমত। বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশন বা প্রশাসন এমন কোনো মডেল আচরণ করেনি যে ভারতের মতো ইম্মেডিয়েট পাস্ট সরকারটি নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক দায়িত্ব পালনের সময় স্বাধীন-নিরপেক্ষ থাকবে, এমন ধারণা জনমনে স্পষ্ট-আস্থা পাবে। এই সরকারের অধীনে স্থানীয় সরকারের নির্বাচনসমূহ নজিরবিহীন সুষ্ঠু হয়েছে। কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না এসব নির্বাচনের সঙ্গে সরকার পরিবর্তনের বিষয় জড়িত ছিলো না। কাজেই ভবিষ্যত নির্বাচন প্রসঙ্গে একটি নিরপেক্ষ সরকারের রূপরেখা দ্রুত এই সরকারি দলকেই দিতে হবে। ভুলে গেলে চলবে না, খালেদা জিয়াকে আওয়ামী লীগ যখন তত্ত্বাবধায়ক ইস্যুতে বাধ্য করে তখনও তা সংবিধানে ছিল না। আন্দোলনের মাইরের ডরে খালেদা জিয়া সারারাত সংসদ চালিয়ে তা সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করেছেন। কাজেই সংবিধানে নেই, প্রস্তাব থাকলে সংসদে নিয়ে আসেন, এ জাতীয় কথাবার্তা যত বেশি বলা হবে, তত পরিস্থিতি ঘোলাটে হবে। এরশাদের শাহ মোয়াজ্জেম, মওদুদ সংবিধানে নেই জাতীয় কথাবার্তা কম বলেননি। এখন সেই সরকারের দাপুটে উপ-রাষ্ট্রপতি মওদুদ, উপ-প্রধানমন্ত্রী শাহ মোয়াজ্জেমের পক্ষে খালেদা জিয়ার পায়ের নিচে বসা ছাড়া কোনো জায়গা নেই।
এখন যে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা সংবিধানে নেই, এর দায়দায়িত্বও বর্তমান সরকারি দলের। কারণ সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশনা সত্ত্বেও সংবিধান সংশোধনের সময় তারা তা সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করেনি। তত্ত্বাবধায়ক ইস্যুতে খালেদা জিয়ার নিয়তও সফেদ না। তিনি শুধু আগামী নির্বাচন তত্ত্বাবধায়কের অধীনে চাইছেন। এর মানে আগামীতে ক্ষমতায় গেলে তিনিও এ ইস্যুতে নেতিবাচক অবস্থান নেবেন। যা তিনি আগে দেখিয়েছেন। কাজেই এ বিষয়টি নিয়ে পানি আরও ঘোলা হবার আগে আওয়ামী লীগের উদ্যোগী হয়ে বিষয়টির ফয়সালা করা উচিত। কারণ পানি যত ঘোলা হবে তা তত ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে যাবে। এটাই নিয়ম। আর বিএনপি কিন্তু সেই ঘোলা পরিস্থিতিতে বিঘ্নিত করতে চাইবে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার। বর্তমান সরকারের প্রতি যতটুকু প্রেম, তা কিন্তু যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ইস্যুতেই। একটা কথা বারবার লিখছি, তাহলে এই সরকার ক্ষমতায় থাকতে এ বিচার যতটুকু হবার হবে। এই সরকার ক্ষমতা থেকে বিদায়ের পর বিএনপি আসলে ভেস্তে যাবে এ বিচার। তত্ত্বাবধায়ক ইস্যুতে আওয়ামী লীগ যত টালবাহানা করবে, মানুষের ধারণা হবে, তত্ত্বাবধায়কের অধীনে নির্বাচনে যেতে আওয়ামী লীগ কনফিডেন্ট না, ভয় পাচ্ছে। এই ধারণা যত বদ্ধমূল হবে, আখেরে তাদের তত ক্ষতি হবে।