সাদেক হোসেনকে হটিয়ে মির্জা আব্বাস মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক পদটি দখল করলেও সাংগঠনিক কার্যক্রম স্থবির। শুরু থেকেই সদস্যসচিব হাবিব–উন–নবী খানের সঙ্গে তাঁর বনিবনা হচ্ছিল না। সিটি নির্বাচনের আগমুহূর্তে মির্জা আব্বাস ‘হঠাৎ প্রকাশিত’ হয়ে আবার অন্তরালে চলে গেছেন। সে সময় তিনি নিজে কেন উচ্চ আদালতে জামিনের শুনানি পিছিয়ে দিয়েছিলেন, তা রহস্যজনক। গত জানুয়ারি থেকে দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর কারাগারে। কিন্তু চেয়ারপারসন ভারপ্রাপ্তের অনুপস্থিতিতে কাউকে ‘ভার’ দেননি। তাঁর মুক্তির দাবিতে দলের তেমন কর্মসূচিও দৃশ্যমান নয়। অবৈধ প্রবেশের দায়ে মেঘালয়ে বন্দী সালাহ উদ্দিন আহমদকে দেখতেও দলের গুরুত্বপূর্ণ কোনো নেতা সেখানে যাননি। এ কারণেই বলা হয়, বিএনপিকে এখন বাঁচিয়ে রেখেছেন খন্দকার মাহবুব হোসেনের নেতৃত্বে একদল আইনজীবী। এর বাইরে ম্যাডামের ইফতার অনুষ্ঠান ছাড়া কোনো তৎপরতা নেই।
৫ জানুয়ারি-পরবর্তী ‘নিষ্ফল’ অবরোধ কর্মসূচির দায় এখন কেউ নিতে চান না। দলের কোনো কোনো জ্যেষ্ঠ নেতার দাবি, এ কর্মসূচি নেওয়ার আগে কোনো দলীয় ফোরামে আলোচনা হয়নি। আনুষ্ঠানিক কর্মসূচি ঘোষণাও করা হয়নি। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া বলেছেন, ‘অবরোধ চলবে।’ যতদূর জানি বিএনপির লাগাতার অবরোধ কর্মসূচিটি এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে প্রত্যাহার করা হয়নি। ঢাকা ও চট্টগ্রাম সিটি নির্বাচনের সময় বিএনপির নেতারা এই দুই শহরের বাসিন্দাদের জন্য অবরোধ শিথিল করার ঘোষণা দিয়েছিলেন। এরপর কোনো বার্তা নেই।
স্বভাবতই প্রশ্ন ওঠে, যদি বিএনপির দলীয় ফোরামে ‘সরকারের পতন না হওয়া পর্যন্ত অবরোধ চলবে’ সিদ্ধান্ত না-ই হয়ে থাকে, তাহলে সিদ্ধান্তটি কে নিলেন? খালেদা জিয়া এককভাবে নিয়েছেন, না লন্ডনপ্রবাসী তারেক রহমান? না চেয়ারপারসনের কার্যালয়ের অতি উৎসাহী কর্মকর্তারা? দুই বছর ধরে তারেক রহমান লন্ডনে বসে বেলাগাম কথাবার্তা বলে যাচ্ছেন, আর দেশের ভেতরে বিএনপির কর্মীরা সরকারের দমন-পীড়নের শিকার হচ্ছেন। অথচ দলীয় নীতি-পরিকল্পনা ও কর্মসূচি সম্পর্কে বিএনপির অধিকাংশ নেতা-কর্মী অন্ধকারে। এভাবে কোনো গণতান্ত্রিক আন্দোলন চলতে পারে কি না, সেই প্রশ্ন তুলেছেন খোদ বিএনপির নেতারাই। তাহলে কি আমরা ধরে নিতে পারি, একতরফা নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের দেশ শাসনের পাশাপাশি বিএনপির লাগাতার অবরোধও চলছিল ব্যক্তিবিশেষের খেয়ালখুশিমতো। কর্মসূচির যৌক্তিকতার চেয়েও সামনে যে প্রশ্নটি বড় হয়ে দেখা দিয়েছে, তা হলো, দেশব্যাপী লাগাতার অবরোধ চালানোর জন্য কোনো প্রস্তুতি কি বিএনপির ছিল? না জামায়াত-শিবিরের ক্যাডারদের ওপর নির্ভর করেই এই কর্মসূচি দিয়েছিলেন বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব? দুই দলের এজেন্ডা বা লক্ষ্য এক নয়।
লাগাতার অবরোধ কর্মসূচির পর খালেদা জিয়া একবারই দলের নেতাদের নিয়ে আনুষ্ঠানিক বৈঠক করলেন ৭ জুলাই, যেখানে স্থায়ী কমিটির সদস্য, কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য, ভাইস চেয়ারম্যান, যুগ্ম মহাসচিব, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মিলিয়ে ১৯-২০ জন উপস্থিত ছিলেন। ওই বৈঠকের আলোচনার বিষয় নিয়েও বিভ্রান্তি আছে। দলের কোনো কোনো সূত্র বলেছে, দল পুনর্গঠনের উদ্দেশ্যেই বৈঠকটি আহ্বান করা হয়। অন্যদের মতে, সন্দেহভাজন কয়েক নেতাকে সতর্ক করে দিতেই খালেদা জিয়া বৈঠকটি ডেকেছিলেন। বিএনপির সমর্থক বলে পরিচিত একটি দৈনিকের প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘খালেদা জিয়া নেতাদের এই বলে সতর্ক করে দিয়েছেন যে যদি কেউ সরকারের সঙ্গে হাত মেলাতে চায়, তাহলে যেন দল ছেড়ে দেয়।’ এই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ‘সম্প্রতি খালেদা জিয়ার কাছে দলে ভাঙন ধরানোর এমন একটি বিশ্বাসযোগ্য বার্তা পেয়েই তিনি নড়েচড়ে বসেন। তিনি জানতে পারেন, সৌদি আরবে ওমরাহ করতে গেলে এই তৎপরতা আরও বেড়ে যাবে। তাঁর অনুপস্থিতিতে চাপের মধ্যে থাকা ক্লিন ইমেজধারী সিনিয়র কয়েকজন নেতাকে সামনে এনে বিএনপির নতুন একটি প্ল্যাটফর্ম গঠন করার উদ্যোগ নেওয়া হবে, যাতে কমপক্ষে ৬০-৭০ জন নেতাকে অন্তর্ভুক্ত করা হবে।’ পত্রিকাটি আরও বলেছে, সদ্য কারামুক্ত একজনসহ আন্দোলনের সময় নিরাপদ দূরত্বে থাকা কয়েকজন নেতার ভূমিকা রহস্যজনক। (নয়া দিগন্ত, ১০ জুলাই, ২০১৫)
খালেদা জিয়া কারও নাম উল্লেখ না করলেও কয়েকজন সন্দেহভাজন নেতাকে উদ্দেশ করে বলেছেন, ‘আপনাদের কোনো কথা থাকলে দলীয় ফোরামে বলবেন। গণমাধ্যমে বলে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করবেন না। বিএনপি জিয়ার পথেই চলছে।’ উল্লেখ করা প্রয়োজন যে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মওদুদ আহমদ, মাহবুবুর রহমান ও মঈন খানের টেলিফোন কথোপকথন বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। ওই তিন নেতাই দলের বর্তমান হাল নিয়ে প্রচণ্ড হতাশা প্রকাশ করেছেন। তাঁদের কেউ কেউ এ কথাও বলেছেন যে, বর্তমান বিএনপিকে দিয়ে কিছু হবে না। বিএনপিকে জিয়াউর রহমানের ধারায় ফিরিয়ে আনতে হবে। একই কথা বলেছেন বিএনপির প্রতিষ্ঠাকালীন মহাসচিব ও বর্তমানে বিকল্পধারার সভাপতি অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরীও।
জামায়াতের সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলার পর থেকেই বিএনপিতে একধরনের অস্বস্তি লক্ষ করা যায়। বিশেষ করে যুদ্ধাপরাধের বিচারের বিষয়ে দলের অবস্থান অনেকে সহজভাবে নিতে পারেননি। কেননা, এই দলে এখনো অনেক মুক্তিযোদ্ধা আছেন। তাঁরা চান যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হোক। দলের একাংশ মনে করে, পশ্চিমা শক্তি ও ভারতের সঙ্গে বিএনপির আস্থার সম্পর্ক গড়ে তোলার ক্ষেত্রে জামায়াতে ইসলামীই প্রধান অন্তরায়। গত জুনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে খালেদা জিয়ার সাক্ষাতের পর গুঞ্জন উঠেছিল যে বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে দূরত্ব বাড়ছে এবং ভবিষ্যতে বিএনপি জামায়াতের সঙ্গ ত্যাগও করতে পারে। কিন্তু খালেদা জিয়া জামায়াতে ইসলামীর ইফতার অনুষ্ঠানে গিয়ে এই বার্তাই দিলেন যে দুষ্ট লোকেরা যা-ই বলুক না কেন, বিএনপি ও জামায়াতের বন্ধন অটুট থাকবে। এরপর নামসর্বস্ব কয়েকটি ডানপন্থী দলের ইফতার অনুষ্ঠানে গিয়ে তিনি নতুন করে শেখ হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের ডাক দেন। জবাবে আওয়ামী লীগের নেতা-মন্ত্রীরাও মাঠ গরম বক্তৃতা দিতে থাকেন। প্রধানমন্ত্রী জাতীয় সংসদে খালেদা জিয়ার বিচারের জন্য বিশেষ ট্রাইব্যুনাল করার কথা বলেন। খালেদা জিয়া কি সত্যি সত্যি গণ-অভ্যুত্থানের পদধ্বনি শুনতে পাচ্ছেন?
৫ জানুয়ারির পর থেকেই বিএনপির রাজনীতিতেও একধরনের অস্থিরতা চলছে। তারেক রহমান সেই অস্থিরতা আরও বাড়িয়ে দিয়েছেন বিভিন্ন সময়ে উসকানিমূলক কথাবার্তা বলে। দলের নেতা-কর্মীদের একাংশের অভিযোগ, ‘উনি লন্ডন থেকে আবোলতাবোল কথাবার্তা বলেন, আর সরকারের খড়্গটি পড়ে আমাদের ওপর।’ এর প্রতিকার কী—জানতে চাইলে দলের একজন জ্যেষ্ঠ নেতা বলেন, কোনো রাজনৈতিক দলেই অদৃশ্য শক্তি কাম্য নয়। বিএনপির প্রতি সহানুভূতিশীল একজন জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক আলোচনা প্রসঙ্গে বললেন, দলের সমর্থক পেশাজীবীরা যেভাবে চিন্তা করেন, দলের শীর্ষ নেতৃত্বের অবস্থান তার বিপরীতে। যাঁরা পেশাগত মর্যাদা বিকিয়ে দিয়ে জি হুজুর জি হুজুর করেন, খালেদা জিয়া তাঁদেরই ডাকেন। পেশাজীবীদেরও যে আলাদা একটি সত্তা আছে, সেটি তিনি মানতে চান না। হয়তো কোনো নেত্রীই মানেন না।
বিএনপির চেয়ারপারসনের সঙ্গে কেন্দ্রীয় ও মধ্যম পর্যায়ের নেতাদের দূরত্ব ক্রমে অনতিক্রম্য হয়ে পড়েছে। দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের কেউ কেউ মনে করেন, দলকে টিকিয়ে রাখতে হলে খালেদা জিয়ার গুলশান অফিসকে ঘিরে যে ‘অনুগত’ ও ‘সাবেক’ বলয় তৈরি হয়েছে, তা থেকে তাঁকে বের করে আনা প্রয়োজন। এই চক্রটির কারণেই নেতা-কর্মীদের সঙ্গে নেত্রীর দূরত্ব বাড়ছে। সন্দেহ-অবিশ্বাস ডানা মেলছে। সাধারণ কর্মী তো বটেই, কেন্দ্রীয় নেতারাও অনেক সময় গুলশান অফিসে গিয়ে তাঁর সাক্ষাৎ পান না। খালেদা জিয়ার সৌদি আরব সফর স্থগিত করার সিদ্ধান্ত সম্পর্কেও তাঁদের কিছু জানানো হয়নি। তাঁরা জেনেছেন গণমাধ্যম থেকে।
অবশ্য এবার খালেদা জিয়ার সৌদি বাদশাহর রাজকীয় মেহমান হওয়ার বিষয়টি খুব স্বস্তিদায়ক ছিল বলে মনে হয় না। তার আগেই প্রথম আলোয় উইকিলিকসের বরাত দিয়ে খবর প্রকাশিত হয় যে শেখ হাসিনা সরকার অসন্তুষ্ট হবে-এই আশঙ্কায় আরাফাত রহমান কোকোর চিকিৎসা কিংবা রাজনৈতিক সমঝোতার ব্যাপারে খালেদার প্রস্তাবে সাড়া দেয়নি সৌদি সরকার। বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান চীন ও মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে বিশেষ সম্পর্ক গড়ে তোলার যে পররাষ্ট্রনীতি নিয়েছিলেন, খালেদা জিয়া তাঁর ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে পারেননি। চীন ও আরব বিশ্ব—কেউ মনে করে না আওয়ামী লীগের চেয়ে বিএনপি তাদের ভালো বন্ধু।