রোববার ১১ মার্চ ভূমিকম্প আর সুনামির প্রথম বর্ষপূর্তি পালন করলো জাপান। ঠিক এক বছর আগে এই দিনে প্রলয়ঙ্করী দুর্যোগ জাপানের বিস্তীর্ণ উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় সমুদ্র উপকূলকে লণ্ডভণ্ড করে পরিণত করেছিল প্রায় বিরাণভূমিতে।
ভূমিকম্পের সঙ্গে সুনামিজনিত জলোচ্ছ্বাস সেদিন ভাসিয়ে নিয়ে যায় হাজার হাজার উপকূলবাসীকে। ধ্বংস করে জনবসতি আর শিল্প কারখানা। সুনামিতে নিহতের সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় ১৬ হাজারে। এছাড়া এখনো নিখোঁজ রয়েছে প্রায় তিন হাজার মানুষ।
রিখটারস্কেলে ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল নয়। প্রলয়ঙ্করী একটি ভূমিকম্পের তীব্রতা বোঝাতে শুধু এই সংখ্যাটিই যে যথেষ্ট নয়, তা প্রত্যক্ষ করেছে জাপানসহ সমগ্র বিশ্ববাসী। জাপানের এই ভূমিকম্প শুধু তাৎক্ষণিকভাবে ধ্বংসযজ্ঞই ঘটায়নি বরং ভয়াবহ পারমাণবিক বিপর্যয় ঘটিয়ে জাপানবাসীর মনে গেঁথে দিয়েছে স্থায়ী আশঙ্কার ছাপ।
ভূমিকম্প আর সুনামিতে প্রত্যক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত না হলেও ফুকুশিমা পারমানবিক কেন্দ্রের বিপর্যয়ের কারণে তেজস্ক্রিয়তার আশঙ্কায় ফুকোশিমার হাজারো অধিবাসী অনেকটা চিরকালের জন্যই বাস্তুচ্যুত হয়। ফুকোশিমা বিপর্যয়ের ধকল এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেনি জাপানবাসী। তেজস্ক্রিয়তার প্রভাবে সেখানকার অধিবাসীদের মধ্যে দেখা দিয়েছে বিভিন্ন রোগ বালাই।
প্রকৃতি সেদিন যেন খেলা করেছিল জাপানিদের সঙ্গে। জ্ঞান-বিজ্ঞান আর প্রযুক্তিতে পৃথিবীতে অগ্রগামী জাপানিরা ভূমিকম্পের সঙ্গে অনেকটা খাপ খাইয়ে নিয়েছিল। সেখানকার মানুষ ভূমিকম্পের সঙ্গে এতটাই অভ্যস্ত আর পরিচিত হতে দেখা গেছে- ৬ মাত্রার ভূমিকম্প হচ্ছে অথচ ফুটবল মাঠে জাতীয় লিগের খেলা চলছে এবং সেই খেলা মাঠভর্তি দর্শক উপভোগও করছে। ভূমিকম্প হচ্ছে বোঝার পরও দর্শক, খেলোয়ার বা রেফারি তাতে তেমন ভ্রূক্ষেপই করছে না।
কিন্তু, সুনামির প্রবল পরাক্রম প্রকৃতির বিরুদ্ধে তাদের সকল মানসিক আর স্থাপনাগত প্রতিরোধ গুঁড়িয়ে দেয়।
ভূমিকম্পের ভয়ে জাপানের বাড়িঘরগুলো সাধারণত হালকা করে বানানো হয়। ভূমিকম্পের ঝাঁকুনি সহ্য করার ক্ষমতাসম্পন্ন বাড়িগুলোর ভিত্তি খুব একটা গভীরে গ্রথিত হয় না। এই পদ্ধতি ভূমিকম্পের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে খুব কার্যকর হলেও সুনামির বিরুদ্ধে প্রতীয়মান হয় সম্পূর্ণ অকার্যকর। সুনামির ঢেউয়ের তোড়ে জাপানের এই বাড়িগুলো অনেকটা খেলনা বাড়িঘরের মতো ভেসে যেতে থাকে। বিভিন্ন গণমাধ্যমে সারাবিশ্ব যা প্রত্যক্ষ করে বিস্ময়ে হতবাক হয়েছে।
২য় বিশ্বযুদ্ধের পর জাপানের ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ এই দিনটিকে তাই জাপানজুড়ে নাগরিকরা বিনম্র শ্রদ্ধার সঙ্গে পালন করল। গত বছর সুনামি তথা ভূমিকম্প আঘাত হেনেছিল ১১ মার্চ স্থানীয় সময় ২টা ৪৬ মিনিটে। ভূমিকম্পের এই মুহূর্তটিকে রোববার জাপানিরা স্মরণ করছে এক মিনিট নীরবতা পালনের মাধ্যমে।
প্রলয়ঙ্করী এই দুর্যোগে নিহত ও ক্ষতিগ্রস্তদের স্মরণে প্রধান অনুষ্ঠানটি হয় টোকিও’র ন্যাশনাল থিয়েটারে। জাপানের সম্রাট আকিহিতো ও সম্রাজ্ঞী মিচিকো এবং প্রধানমন্ত্রী ইউসিহিকো নোদার উপস্থিতিতে এতে যোগ দেয় হাজারো শোকার্ত জাপানি।
রোববার সকাল থেকেই অকূস্থলে আসা শুরু করে জাপানিরা। অনেকেই একটি করে ফুল এনে রাখে ধ্বংসস্তূপের ওপর, যেখানে হয়তো ছিল তাদের বসতঘর, এখন আর নেই, ভাসিয়ে নিয়ে গেছে সুনামির ঢেউ। ফুল দিয়ে তারা কিছুক্ষণ স্তব্ধ থাকেন, স্মরণ করেন এখানে তাদের হারিয়ে যাওয়া আত্মীয়-পরিজনের সঙ্গে কাটানো মধুর স্মৃতিকে।
রোববার ২টা ৪৬ মিনিটে সুনামির স্মৃতির স্মরণে সমগ্র উত্তর-পূর্ব উপকূল জুড়ে বিভিন্ন কেন্দ্র থেকে বিপদসংকেতগুলো আবারো বেজে উঠলো সেদিনকার মত। পাহাড়ে পাহাড়ে প্রতিধ্বনিত সাইরেনের আওয়াজ থেমে গেলে অবশেষে নেমে আসে নীরবতা। মানুষ স্তব্ধ হয়ে মগ্ন থাকে এক মিনিট।
‘দুর্যোগের স্মৃতিকে আমরা আমাদের মন থেকে কখনোই মুছে যেতে দেব না।’ দিনটি উপলক্ষে টেলিভিশনে প্রচারিত এক সংক্ষিপ্ত ভাষণে যেন অঙ্গীকার করলেন জাপানি সম্রাট আকিহোতো।
জাপানিদের এই দেবতুল্য অভিভাবক আরো বললেন ‘আমি মনে করি সবাই হারিয়ে যাওয়াদের তাদের হৃদয়ে ধারণ করে রাখবে আজীবন’।
প্রধানমন্ত্রী নোদার গলায় প্রতিধ্বনিত হল যেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ উত্তর জাপানিদের সেই দৃঢ় সংকল্পের সুর, ‘সবকিছু আবারো নতুন করে আগের থেকেও ভালোভাবে গড়ে তোলা হবে।’
উল্লেখ্য, জাপানে গত বছরের ১১ মার্চ ভূমিকম্প আঘাত হানে টোকিও থেকে ৪০০ কিলোমিটার উত্তর-পূর্ব সমুদ্র উপকূলে।
ভূমিকম্পের অল্প সময় পরেই হঠাৎ যেন পুরো মহাসাগর উঠে আসে উপকূলে। সুনামির ঢেউয়ের প্রবল তোড়ে ভেসে যায় জাহাজ, ঘর-বাড়ি, গাড়ি আর জীবন। সম্পূর্ণভাবে বিধ্বস্ত হয় উপকূলীয় জনপদ।
এই উপর্যুপরি প্রাকৃতিক দুর্যোগ সেদিন কেড়ে নেয় প্রায় ১৫ হাজার ৮শ’ মানুষের জীবন। এছাড়াও এখনও নিখোঁজ প্রায় তিন হাজার মানুষ। যারা হয়তো আর কোনোদিন ফিরে আসবে না।
প্রলয়ঙ্করী এই দুর্যোগ আবারো নতুন করে স্মরণ করিয়ে দিল প্রকৃতির ভয়াবহতা। জানিয়ে দিল পৃথিবীতে বাস করতে হলে প্রকৃতিকে সমঝে চলতে হবে। করতে হবে প্রকৃতির সঙ্গে সমঝোতা।