নেতৃত্ব সংকটে জাপা

নেতৃত্ব সংকটে জাপা

japaচরম নেতৃত্ব সংকট দেখা দিয়েছে জাতীয় পার্টিতে। কয়েক দফায় ভাঙনের কারণে ক্ষয়িষ্ণু হয়ে পড়েছে দলটি। নানা কারণে অনেক নেতাই এখন নিষ্ক্রিয়, আবার কেউ কেউ দলে থাকলেও দায়িত্ব নিতে রাজি হচ্ছেন না। যে কারণে অনিচ্ছা সত্ত্বেও অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদে পরিবর্তন আনা যাচ্ছে না বলে বলে জানিয়েছে দলীয় সূত্র।

একদিকে চলছে নেতৃত্ব সংকট, অন্যদিকে দলীয় কোন্দল প্রকট হচ্ছে। খোদ পার্টি চেয়ারম্যানের সহধর্মিনী রওশন এরশাদের নেতৃত্বে দলের মধ্যে একটি বড় গ্রুপ সক্রিয়। যাদের অনেকবার ডেকেও সাড়া পাচ্ছেন না এরশাদ। দলে না ফিরলে তাদের পরিণতি ভালো হবে না, লাঙল পেতে হলে এরশাদের কাছে আসতে হবে বলেও তাদের সতর্ক করেছিলেন তিনি। কিন্তু কিছুতেই যেন কাজ হচ্ছে না।

দিন দিন ব্যবধান বাড়ছে এরশাদ ও রওশনপন্থি ধারায়। এরশাদের কর্মসূচিতে রওশন যান না। আবার রওশন নিজেও পৃথকভাবে বিভিন্ন ইস্যুতে সংবাদ সম্মেলন করেন। তাতেও এরশাদ উপস্থিত হন না। সম্প্রতি সংসদীয় দলের মিটিংও একই সময়ে ভিন্ন স্থানে করার খবর পাওয়া গেছে। আপন ভাই জিএম কাদেরও অভিমানে এরশাদের কাছ থেকে দূরে থাকছেন।

মাঠ পর্যায়ে কর্মী-সমর্থক কিছু থাকলেও তাদের সংগঠিত করার জন্য উপযুক্ত নেতা খুঁজে ‍পাচ্ছেন না এরশাদ। যে কারণে তার বিরোধিতাকারীদেরও দলে ভালো স্থান দিতে বাধ্য হচ্ছেন এরশাদ। যার ফলে বিগত উপজেলা পরিষদ ও সিটি করপোরেশন নির্বাচনে জাপার প্রার্থীদের ভরাডুবি হয়েছে বলে মনে করছেন দলটির শীর্ষ নেতারা।

আর দলটির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের দল ছাড়ার পেছনে সবচেয়ে বড় যে অভিযোগ তা হচ্ছে- হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ চরম স্বৈরাচার। নিজের খেয়ালখুশি মতো দল পরিচালনা করেন। যখন যাকে খুশি পদায়ন করেন। আবার কোনো রকম আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়ে দল থেকে বহিষ্কার করেন। এতে নেতাদের মধ্যে একটা নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়।

এরশাদের হাত থেকে রেহাই পাননি সহধর্মিনী রওশন এরশাদও। তাকেও একাধিক দফায় বহিষ্কার করেছিলেন বলে কথা চাউর আছে। আপন ভাই জিএম কাদেরকেও একাধিক দফায় শোকজ করে কর্মীদের মধ্যে মূর্তিমান আতঙ্কে পরিণত হয়েছেন এরশাদ।

শুধু বহিষ্কার নয়, পদায়ন নিয়েও রয়েছে চরম অসন্তোষ। অনেকে রয়েছেন যাদের দলীয় কোনো কর্মসূচিতে দেখা যায় না। কিন্তু এক বছরে দু’দফায় পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। আবার যোগ্য নন, এমন অনেকে রয়েছেন যাদের শীর্ষপদে বসিয়েছেন এরশাদ। কেবল এরশাদের বাসায় উপঢৌকন পাঠিয়েই একজন সাংগঠনিক সম্পাদক পদ বাগিয়ে নিয়েছেন বলেও আলোচনা আছে দলীয় পরিমণ্ডলে।

দলে কোনো অবদান না রেখেও অনেকে ডাবল-ট্রিপল প্রমোশন পাওয়ায় ত্যাগী নেতাকর্মীরা হতাশ। আর হতাশা থেকেই অনেকেই নিষ্ক্রিয়। আবার বিগত নির্বাচনের সময় থেকে নির্বাচনপন্থি ও নির্বাচনবিরোধী দু’টি গ্রুপ সক্রিয় রয়েছে। গত সংসদ নির্বাচনে ঘোষণা দিয়ে নির্বাচন বর্জন করেন এরশাদ। আর রওশন এরশাদের নেতৃত্বে একাট্টা হয়ে নির্বাচনে অংশ নেন বেশিরভাগ নেতা।

দলের প্রেসিডিয়াম সদস্যদের মধ্যে শুধু জিএম কাদের ও অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেন খান শেষ দিন পর্যন্ত নির্বাচন থেকে দূরে ছিলেন। অন্যদিকে এরশাদের ঘোষণায় সারা দেশে ২ শতাধিক প্রার্থী মনোনয়ন ‍প্রত্যাহার করেছিলেন।

বর্তমানেও নির্বাচনপন্থি আর নির্বাচন বর্জনকারীরা দুই ধারায় বিভক্ত। নির্বাচন বর্জনকারীরা অংশগ্রহণকারীদের সুবিধাবাদী ও বেঈমান বলে আখ্যায়িত করেন। আর নির্বাচনে অংশগ্রহণকারীরা নির্বাচনকালে অনেক বক্তৃতা বিবৃতি দিয়েছেন বর্জনকারীদের বিরুদ্ধে। যে কারণে এক পক্ষ আরেক পক্ষকে সহ্য করতে পারছে না।

এমন এক বাস্তবতায় দলের মধ্যে সুবিধাবাদী বলে পরিচিত নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু পার্টির মহাসচিব পদে আসীন। এতে বেজায় ক্ষিপ্ত নির্বাচন বর্জনকারীরা। তারা এখন এরশাদকেও গোপনে দুয়ো দিচ্ছেন।

নির্বাচন বর্জনকারী এক নেতা জানিয়েছেন, এরশাদকে বাসা থেকে সিএমএইচ’এ নিয়ে যাওয়ার সময় বাধা দিতে গিয়ে তিনি মার খেয়েছিলেন। তার কথায় নির্বাচন বর্জন করেছেন। অথচ তার প্রকৃত বন্ধু কে, এরশাদ সেটাই বুঝতে চাইছেন না। এখন নির্বাচনপন্থিরা বর্জনকারীদের হয়রানি করছেন। অনেক এলাকায় কমিটি ভেঙে দিয়ে তাদের অনুসারীদের দিয়ে কমিটি গঠন করেছেন। কেন্দ্রের এই রেশ গ্রাম পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে।

ত্যাগী নেতারা অভিমানে আর দলের সঙ্গে সম্পর্ক রাখছেন না। যে ‍কারণে দায়িত্ব দেওয়ার মতো নেতা খুঁজে পাচ্ছেন এরশাদ। ঢাকা ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে সব ওয়ার্ডে কাউন্সিলর পদে মনোনয়ন দিতে ব্যর্থ হন তিনি। আর নামকাওয়াস্তে মেয়র পদে মনোনয়ন দিলেও তারা কেউই জামানত ফেরত পাননি।

সিনিয়র নেতারা জানিয়েছেন, এরশাদ নিজেও ‍সবকিছু বোঝেন। যে কারণে অনেক দিন ধরেই নাকি মহাসচিবকে সরিয়ে দিতে চাইছেন তিনি। কিন্ত যাদের এই পদে বসাতে চাইছেন, তারা কেউ রাজি হচ্ছেন না।

সংকট কাটিয়ে উঠতে রওশন এরশাদের সঙ্গে দ্বন্দ্ব মিটিয়ে ফেলতে চেয়েছিলেন এরশাদ। কিন্তু বিরোধীদলীয় উপনেতা নিয়োগ ইস্যুতে দ্বন্দ্ব আবার চাঙ্গা হয়ে উঠেছে। রওশন চেয়েছিলেন কাজী ফিরোজ রশীদকে উপনেতা নিয়োগ করতে। কিন্তু এতে বাধ সাধেন এরশাদ। তিনিও পাল্টা চিঠি দিয়ে মহাসচিব জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলুর নাম প্রস্তাব করেন। পরে আর কোনোটিরই অনুমোদন দেননি স্পিকার।

পদায়ন ও বহিষ্কারের পাশাপাশি এরশাদের ঘন ঘন মত পরিবর্তনের কারণেও বড় ধরনের ভাঙন দেখা দিয়েছে দলে। আবার কখনও আওয়ামী লীগ, বিএনপির কূটচালের কারণে দল ভেঙে চারটি জাতীয় পার্টি সৃষ্টি হয়েছে।

এ বিষয়ে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ বলেন, যারা জাতীয় পার্টি ছেড়ে গেছেন তারা জিরো হয়ে গেছেন। নাম সর্বস্ব জাতীয় পার্টি গঠন করলেও জনগণ সেগুলো গ্রহণ করেনি। মাঠ পর্যায়ে একমাত্র লাঙ্গলের সমর্থন রয়েছে। সময় হলেই ঘুরে দাঁড়াবে জাতীয় পার্টি।

এদিকে মহাসচিব জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু দাবি করেছেন, দল যে কোনো সময়ের চেয়ে সংগঠিত। প্রতি সভায় অনেক লোকের জমায়েত হচ্ছে। কাউকে বাদ দেওয়া হচ্ছে না। যারা দীর্ঘদিন ধরে নিষ্ক্রিয় তাদের সরিয়ে সক্রিয়দের নেতৃত্বে আনা হচ্ছে।

সিটি করপোরেশন নির্বাচনে জাপার প্রার্থীদের ফল বিপর্যয়ের কারণ খুঁজে দেখা হচ্ছে বলেও জানান তিনি।

সভাসমাবেশে লোকসমাগম প্রশ্নে বাবলু বিরোধীদের বক্তব্য হচ্ছে- এখন লোক ভাড়া করে আনা হচ্ছে। কিন্তু জাতীয় পার্টিকে কোনো দিন লোক ভাড়া করে আনতে হয়নি। লোকজন আসতো স্বেচ্ছায়। এখন ভাড়া করে আনা লোকজন এরশাদের বক্তব্য শেষ হওয়ার আগেই চলে যায়।

এখনই যখন দলে একাধিক ধারা বহমান, তখন এরশাদের অবর্তমানে দলটির হাল কে ধরবেন, তা নিয়ে চলছে ব্যাপক আলোচনা। একাধিক সভায় এরশাদের সামনেই এই প্রসঙ্গ এনেছেন নেতারা। তারা খোদ এরশাদের কাছে জানতে চাচ্ছেন, আপনার উত্তরসূরি কে হবেন। জবাবে এরশাদ বলছেন, তোমরা হবে আমার উত্তরসূরি।

কিন্তু এরশাদের এই জবাবে সন্তুষ্ট হতে পারছেন না নেতারা। তারা বলেছেন, এরশাদের বর্তমানেই দলেই মধ্যে একাধিকধারা বিরাজ করছে, তাহলে তার অবর্তমানে একাধিক উপদলে বিভক্ত হয়ে পড়বে দল। যে কারণে নেতারা তাদের নিজেদের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত। যোগদানের জন্য গোপনে তাই অনেকেই অন্য দলের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন বলেও জানা গেছে।

রাজনীতি