না, গায়কের কল্পনার খেয়ালে নয়, বিজ্ঞানের সূক্ষ্ম-অতিসূক্ষ্ম হিসেবেই আজ থমকে যাবে সময়৷ পুরো এক সেকেন্ড৷ শুনে মনে হতে পারে, সে আর এমন কী? চোখের পলক ফেলার আগেই তো এক সেকেন্ড কেটে যায়৷ তার আবার চলা আর থমকে দাঁড়ানো! কিন্তু বৈজ্ঞানিক হিসেব-নিকেশ থেকে বিশ্বজোড়া কম্পিউটার সিস্টেমে ওলটপালট ঘটিয়ে দিতে পারে ওই এক সেকেন্ডই৷ সময়বিজ্ঞানের পরিভাষায় লিপ সেকেন্ড৷
কী এই লিপ সেকেন্ড? বিষয়টা অনেকটা লিপ ইয়ার বা অধিবর্ষের মতোই৷ পৃথিবীর সূর্য পরিক্রমণে আসলে যা সময় লাগে আর হিসেবের সুবিধার জন্য আমরা এক বছরের যা হিসেব ধরি, তার মাঝের ফাঁকটা ভরাতে চার বছর অন্তর ফেব্রুয়ারির শেষে একটি করে বাড়তি দিন যোগ করা হয়৷ ঠিক তেমনই, পরমাণু ঘড়ির হিসেবে নিখুঁত সময়ের সঙ্গে পৃথিবীর আহ্নিক গতির উপর নির্ভর করে সময়ের হিসেব পুরোপুরি মেলে না৷ কয়েক বছর পর পর পরমাণু সময় সৌর সময়ের চেয়ে সামান্য এগিয়ে যায়৷ সেই অসঙ্গতি দূর করতেই লিপ সেকেন্ড৷ অর্থাত, জুন বা ডিসেম্বরের শেষ দিনটিতে একটি বাড়তি সেকেন্ড যোগ করে দেওয়া হয়৷ যেমন হচ্ছে এ বছর৷ আন্তর্জাতিক পরমাণু সময় অনুযায়ী, আজকের দিনটির শেষ মিনিট হবে ৬১ সেকেন্ডে৷
দৈনন্দিন জীবনে আমরা যে সময় অনুযায়ী চলি, তা হল সৌর সময়৷ অর্থাত, পৃথিবীর আহ্নিক গতি ও বার্ষিক গতির উপর নির্ভর করে সময় বিভাগ৷ সেই সময়ও আবার দু’রকম৷ আপাত সময় এবং গড় সময়৷ সৌর ডায়ালের সাহায্যে সরাসরি সময় মাপলে সেটা হয় আপাত সময়৷ আর প্রতি ২৪ ঘণ্টায় পৃথিবীর সাপেক্ষে সূর্যের অবস্থান একই হয়, এটা ধরে নিয়ে যে সময় মাপা হয়, সেটা হল গড় সময়৷ এই গড় সময় অনুযায়ীই আমাদের যাবতীয় কাজকর্ম চলে৷ হাতঘড়ির কাঁটাও মেলানো হয় গড় সময় ধরেই৷ কিন্তু বাস্তবে প্রতি ২৪ ঘণ্টায় পৃথিবীর সাপেক্ষে সূর্যের অবস্থান একেবারে এক হয় না৷ কারণ, নিজের অক্ষের চারদিকে এক পাক ঘুরতে পৃথিবী ঠিক কতটা সময় নিচ্ছে, সেটা ভূকেন্দ্রের গতি, বায়ুমণ্ডল ও মহাসাগরের অবস্থার পরিবর্তন, ভৌম পানি, তুষার সঞ্চয়ের মতো বিভিন্ন বিষয়ের উপর নির্ভর করে৷ তাই আমাদের ঘণ্টা-মিনিট-সেকেন্ডের হিসেব নিখুঁত হয় না৷
আন্তর্জাতিক একক ব্যবস্থায় (ইন্টারন্যাশনাল সিস্টেম অফ ইউনিটস) সময় মাপা হয় সিজিয়াম পরমাণুর কম্পনের হিসেব অনুযায়ী৷ সে জন্য ব্যবহার হয় প্রায় ২৭০টি পরমাণু ঘড়ি৷ পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে থাকা এই পরমাণু ঘড়িগুলোর সঙ্কেত পৌঁছয় ফ্রান্সের সেভরে অবস্থিত আন্তর্জাতিক ওজন ও পরিমাপ সংস্থার দন্তরে৷ তার ভিত্তিতে ওই সংস্থা আন্তর্জাতিক পরমাণু সময় নির্ধারণ করে৷ এই পরমাণু ঘড়িগুলির হিসেব এতই নিখুঁত যে, পাঁচ কোটি বছরেও সময়ের হিসাবে এ দিক ও দিক হয় এক সেকেন্ডের কম৷ আর বিশ্ব জুড়ে ইন্টারনেট ও ওয়েব ভিত্তিক পরিষেবা এই সময় অনুযায়ীই চলে৷ তাই পরমাণু সময় এবং সৌর সময়ের মধ্যে ফারাক মেটাতে দরকার হয় লিপ সেকেন্ড৷
কিন্তু মুশকিল হলো, লিপ ইয়ার যেমন একটা নির্দিষ্ট সময় অন্তর হয়, লিপ সেকেন্ডের বিষয়টা তা নয়৷ কারণ, পরমাণু সময় আর সৌর সময়ের মধ্যে যে গরমিল সেটা কোনও নির্দিষ্ট ছক মেনে হয় না৷ ফলে লিপ সেকেন্ড যোগ করার দরকারটাও হয় অনিয়মিত ব্যবধানে৷ তাই কম্পিউটার এবং ইন্টারনেট পরিষেবা যেমন আগে থেকেই লিপ ইয়ারের কথা মাথায় রেখে প্রোগ্রাম করা যায়, লিপ সেকেন্ডের বেলায় সে সুবিধা নেই৷ ফলে থমকে যাওয়া সময়ের সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে হামেশাই হিসেব যায় গুলিয়ে৷ যেমনটা হয়েছিল ২০১২ সালে লিপ সেকেন্ড যোগ করার সময়৷ এবারও সেই একই সমস্যা হতে পারে বলে মনে করছেন বিজ্ঞানীরা৷ তেমনটা যাতে না-হয়, তার জন্য চলছে মরিয়া চেষ্টা৷