তৈরি পোশাক খাতের উৎসে কর কমানো হয়েছে। উচ্চশিক্ষার বিকাশ ধরে রাখতে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ ও ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ওপর মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাটও কমিয়ে আনা হয়েছে। শুল্ক সম্পূর্ণ প্রত্যাহার করা হয়েছে বই আমদানিতে। প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে ক্যান্সার চিকিৎসার ওষুধ তৈরিতে ব্যবহৃত কাঁচামালের শুল্ক-কর। তুলে নেওয়া হয়েছে ইউনানি, আয়ুর্বেদ ও ভেষজ ওষুধের ওপর মূল্য সংযোজন কর। তবে বাড়ানো হয়েছে শহরের করদাতাদের নূ্যনতম কর, কমানো হয়েছে উপজেলা পর্যায়ে। কিছুটা কমানো হয়েছে কম দামের সিগারেটের কর।
গতকাল সোমবার ২০১৫-১৬ অর্থবছরের বাজেটে আরও কয়েকটি কর প্রস্তাবে সংশোধনী এনে অর্থবিল-২০১৫ জাতীয় সংসদে পাস হয়েছে। সংসদে প্রস্তাবিত বাজেটের ওপর আলোচনায় অংশ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এসব প্রস্তাবের সংশোধনী আনতে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতকে অনুরোধ জানান। পরে প্রধানমন্ত্রীর এসব প্রস্তাব গ্রহণ করেন অর্থমন্ত্রী। এর মধ্য দিয়ে বাজেটের কর প্রস্তাবগুলো কার্যকর হলো। আজ পাস হবে নতুন অর্থবছরের বাজেট। কাল থেকে শুরু হবে বাস্তবায়ন।
অর্থমন্ত্রী তার নিজের দেওয়া বাজেটের ওপর সমাপনী বক্তৃতায় বলেন, প্রস্তাবিত বাজেটের ওপর প্রধানন্ত্রী যেসব বিষয়ে পরিবর্তনের কথা বলেছেন সেগুলো অবশ্যই নির্দেশ। তার নির্দেশ প্রতিপালন করা হলো। এই বাজেটে ছয়টি কর প্রস্তাবের সংশোধনী আনেন প্রধানমন্ত্রী। সবই গৃহীত হয়। পরে স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিরোধীদলীয় নেতা রওশান এরশাদের উপস্থিতিতে অর্থবিল পাস হয়। গত ৪ জুন জাতীয় সংসদে ২০১৫-১৬ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটের সঙ্গে এই অর্থবিল উত্থাপন করেছিলেন অর্থমন্ত্রী। ব্যবসায়ীসহ সংশ্লিষ্টদের মতামতের ভিত্তিতে কর প্রস্তাবগুলোর সংশোধনী আনেন তিনি। ৫ শতাংশ ঘাটতি ধরে আগামী অর্থবছরের বাজেটের আকার ধরা হয়েছে ২ লাখ ৯৫ হাজার ১০০ কোটি টাকা।
অর্থমন্ত্রী বলেন, নতুন বাজেটে বিনিয়োগ বাড়ানোর পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এডিপির কাজের গতি বৃদ্ধি ও পাইপলাইনে আটকে থাকা বিদেশি সাহায্য ছাড় করাতে নানামুখী উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এসব প্রচেষ্টার ফলে ৬ শতাংশের প্রবৃদ্ধির বৃত্ত ভেঙে প্রাক্কলিত ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করা যাবে। মুহিত বলেন, বিশ্বব্যাংকসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের ক্ষেত্রে একটি বাধাকেই বড় করে দেখছে। তা হলো রাজনৈতিক সুস্থিতি। দেশের আপামর জনগণের বৃহত্তর কল্যাণে রাজনৈতিক সুস্থিতির ধারাবাহিকতা বজায় থাকবে বলে প্রত্যাশা করছি। কাজেই ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করা বর্তমান বাংলাদেশের জন্য অলীক স্বপ্ন নয়।
কর প্রস্তাবের সংশোধনী :বাজেট ঘোষণায় সব ধরনের পণ্যে রফতানির ওপর ১ শতাংশ উৎসে কর কাটার প্রস্তাব করেছিলেন অর্থমন্ত্রী। এখন তা কমিয়ে শূন্য দশমিক ৬ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছে। অর্থাৎ ১০০ টাকা রফতানি আয় হলে তার বিনিময়ে ৬০ পয়সা কর দিতে হবে গার্মেন্ট মালিকদের। এ প্রসঙ্গে সংসদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির পর থেকে দেশের পোশাক খাত সংকটে পড়েছে। এ অবস্থা বিবেচনা করে এ খাতের কর কিছুটা কমানো দরকার। অর্থমন্ত্রীকে উদ্দেশ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আবার যখন অবস্থা ভালো হবে, তখন কর বাড়িয়ে দেবেন। তখন প্রধানমন্ত্রীর এ প্রস্তাব গ্রহণ করেন অর্থমন্ত্রী। পোশাক খাতের বাইরে অন্যান্য রফতানি খাতে ৮০ পয়সা করে কর দিতে হবে।
বাজেট ঘোষণায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ ও প্রকৌশল কলেজে টিউশন ফির ওপর ১০ শতাংশ ভ্যাট আরোপের প্রস্তাব করা হয়। এ খাতে ভ্যাট হার কমিয়ে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। ব্যাপক কর্মসংস্থান ও উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যে পোল্ট্রি ও মৎস্য শিল্পে অর্জিত আয়ে সর্বোচ্চ ২০ লাখ টাকা পর্যন্ত কর ছাড় দেওয়া হয়। এর বেশি আয় হলে প্রযোজ্য হারে কর দিতে হবে। অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতায় এ খাতে সর্বোচ্চ ১০ লাখ টাকা অর্জিত আয়ে ৩ শতাংশ হারে করারোপের প্রস্তাব করা হয়। এ প্রসঙ্গে গতকাল সংসদে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এটি বর্তমান সরকারের অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত খাত। এখানে ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টির সুযোগ আছে। তাই প্রস্তাব করছি, এ খাতে করমুক্ত সীমা আরও বাড়ানো হোক। পরে প্রধানমন্ত্রীর এ প্রস্তাব গৃহীত হয়।
বর্তমানে বিদেশি প্রত্রিকা, জার্নালসহ সব ধরনের বই আমদানিতে ৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ আছে। জ্ঞানের প্রসারে অবদান রাখার লক্ষ্যে এসব পণ্যের আমদানি শুল্ক প্রত্যাহার করা হয়েছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাজার স্থিতিশীল রাখার লক্ষ্যে চাল, চিনি, ভোজ্যতেল, সয়াবিন তেলের ওপর থেকে আমদানি পর্যায়ে ২ শতাংশ অগ্রিম কর তুলে নেওয়া হয়েছে। বাজেট ঘোষণায় ওই সব পণ্যের ওপর উলি্লখিত হারে অগ্রিম কর আরোপের প্রস্তাব করা হয়। বাজেট ঘোষণায় ইন্টারনেট ব্যবহারের ওপর ৫ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আরোপের প্রস্তাব করা হয়। এটি কমিয়ে ৩ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়। এ ছাড়া ই-কমার্স সেবার ওপর আরোপিত ৪ শতাংশ মূল্য সংযোজন কর সম্পূর্ণ প্রত্যাহার করা হয়।
দেশীয় শিল্প সুরক্ষায় ডিশ অ্যান্টেনা কেবলের সম্পূরক শুল্ক ২০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৩০ শতাংশ করা হয়। এলইডি বাল্ব আমদানিতে মিথ্যা ঘোষণা রোধে ডেকোরেশন লাইট, ঝাড়বাতি আমদানিতে ৪৫ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক ও ২৫ শতাংশ আমদানি শুল্ক আরোপ করা হয়। দেশীয় মোটরসাইকেল সংযোজন শিল্পের সুরক্ষায় আমদানি করা পূর্ণাঙ্গ মোটরসাইকেলের সম্পূরক শুল্ক ৪৫ থেকে বৃদ্ধি করে ৬০ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়। শুল্ক বাড়ানো হয়েছে ৯০ হাজার থেকে দুই লাখ টন ক্ষমতাসম্পন্ন এয়ার কন্ডিশনারের।
ব্যক্তিশ্রেণী করদাতার নূ্যনতম কর কাঠামোয় পরিবর্তন আনা হয়। ঢাকা ও চট্টগ্রাম সিটি কপোরেশন এলাকায় বসবাসরত করদাতার জন্য এই কর ধার্য করা হয় ৫ হাজার টাকা। অন্যান্য সিটি করপোরেশনে ৪ হাজার এবং সিটি করপোরেশন ব্যতীত উপজেলা করদাতার জন্য এই কর নির্ধারণ করা হয় ৩ হাজার টাকা। বাজেট ঘোষণায়, শহর-উপজেলায় সকল করদাতার জন্য একই হারে ৪ হাজার টাকা নূ্যনতম নির্ধারণ করা হয়। বর্তমানে নূ্যনতম কর যথাক্রমে ৩ হাজার টাকা, ৪ হাজার টাকা ও ১ হাজার টাকা। এ ছাড়া নতুন প্রজন্মের ব্যাংকের জন্য করপোরেট হার ৪০ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে।