গম খাওয়ার উপযোগী কিনা পরীক্ষাই হয়নি

গম খাওয়ার উপযোগী কিনা পরীক্ষাই হয়নি

gomঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টিবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট এবং বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদের পরীক্ষায় ব্রাজিল থেকে আমদানীকৃত গম অত্যন্ত নিম্নমানের প্রমাণিত হলেও খাদ্য মন্ত্রণালয় সেই গমকে ভালো বলছে। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের নিজস্ব পরীক্ষার বরাত দিয়ে মন্ত্রণালয় বলছে, এই গম খাওয়ার উপযোগী। তবে আমদানি করা গম নিয়ে প্রশ্ন ওঠার পর তিনটি পরীক্ষাগারে পরীক্ষা করা হলেও গম খাওয়ার যোগ্য কি-না বা এর মধ্যে কোনো বিষাক্ত পদার্থ আছে কি-না দেশে সেই ধরনের পরীক্ষা করা হয়নি।

সবচেয়ে জরুরি পরীক্ষা না করেই খাদ্য মন্ত্রণালয় বলছে, এ গম সম্পূর্ণ খাবার উপযোগী। বিষয়টি নিয়ে সুষ্ঠু তদন্ত, পূর্ণাঙ্গ পরীক্ষা এবং আমদানি করা গম বাজারে না ছাড়ার পরামর্শ বিশেষজ্ঞ মহলের। দেশের বিশিষ্ট পুষ্টি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ব্রাজিল থেকে আমদানি করা গম খাওয়ার উপযোগী বা নিরাপদ কি-না সে পরীক্ষাই এখন পর্যন্ত করা হয়নি। ওই পরীক্ষা ছাড়া এই গমকে নিরাপদ বলা যাবে না। ব্রাজিলের গম নিয়ে তিনটি সরকারি প্রতিষ্ঠানের ভিন্ন ভিন্ন রিপোর্ট ও মন্ত্রণালয়ের বক্তব্যে মানুষ বিভ্রান্তিতে পড়েছে। গত রোববার খাদ্য মন্ত্রণালয়ের বক্তব্যে এ গম খাবার উপযোগী বলে দাবি করা হয়। মন্ত্রণালয় মনে করে, আমদানি করা গমের ‘মান ভালো’।

এদিকে নিম্নমানের গম ফেরত নেওয়ার জন্য গতকালও পুলিশের পক্ষ থেকে খাদ্য অধিদপ্তরকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। এটা নিয়ে সিলেটেও পুলিশের সঙ্গে বাদানুবাদ হয়েছে। বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদের (বিসিএসআইআর) খাদ্যবিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ইনস্টিটিউটের পরীক্ষায় গমের মান খারাপ বলে প্রমাণিত হয়েছে। গমের মান নিয়ে প্রশ্ন ওঠার পর ২৫ জুন এসব নমুনা পরীক্ষা করার জন্য খাদ্যবিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ইনস্টিটিউটে পাঠায় খাদ্য মন্ত্রণালয়। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে জেলা প্রশাসকদের তত্ত্বাবধানে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের মাধ্যমে পাঠানো ৫৭টি জেলার খাদ্যগুদামে গমের নমুনা পরীক্ষা করে এই ফলাফল পেয়েছে সরকারি সংস্থাটি। একই গমের নমুনা সংগ্রহ করে নিজস্ব পরীক্ষাগারেও পরীক্ষা করেছে খাদ্য অধিদপ্তর। তবে তাদের পরীক্ষায় খাদ্যগুদামে রক্ষিত ব্রাজিলের গমের মান সঠিক পাওয়া গেছে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, খাদ্য বিভাগের পরীক্ষাগারে ‘টক্সিলজিক্যাল টেস্ট’ করানোর সুযোগ নেই। এই পরীক্ষার মাধ্যমে মূলত খাদ্যপণ্যে মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর উপাদানের অস্তিত্ব নিরূপণ করা হয়। পুষ্টিবিজ্ঞানীদের অভিমত, যে খাদ্যপণ্যে আর্দ্রতা ও পুষ্টিগুণ বেশি থাকবে তাতে দ্রুত পোকায় ধরবে। পরীক্ষাগারের সূত্র জানায়, ব্রাজিলের গমে আর্দ্রতা ও প্রোটিন দুটোই বেশি পাওয়া গেছে। খাদ্য বিভাগ তাদের গমে প্রোটিন বেশি থাকার বিষয়টি ফলাও করে প্রচার করছে।

খাদ্য অধিদপ্তরের নিজস্ব পরীক্ষাগারে গমে কোনো বিষাক্ত পদার্থ আছে কি-না তা পরীক্ষার যন্ত্রপাতি নেই। তবে বিসিএসআইআরের পরীক্ষাগারে এ সুবিধা থাকলেও সেখানে গমের এ পরীক্ষাটি করানো হয়নি। গম কেনাবেচার সময় সাধারণত ১০টি গুণাগুণের পরীক্ষা করা হয়। কিন্তু খাদ্য মন্ত্রণালয় বার বার কম গুরুত্বপূর্ণ আটটি বৈশিষ্ট্যের পরীক্ষা করে দাবি করছে গম ভালো, এতে বিষাক্ত কিছু নেই। এ বিষয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার সমকালকে বলেন, ব্রাজিল থেকে আমদানি করা গম খাবার উপযোগী কি-না তা নিয়ে দেশজুড়ে তোলপাড় হওয়ার পরও পরীক্ষা না করায় বোঝা যাচ্ছে- খাদ্য মন্ত্রণালয় কিছু গোপন করতে চাচ্ছে।

তারা নিজেদের প্রতিষ্ঠানে পরীক্ষা করে গম ভালো বলে দাবি করছেন। এটা মানুষকে বিভ্রান্ত করা ছাড়া আর কিছু না। এ বিষয়ে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান সমকালকে বলেন, বিসিএসআইআরের পরীক্ষাগারে গমের মান নিম্নমানের বলে রিপোর্ট এসেছে। তার পরও কেউ কেউ গমকে ভালো বলে দাবি করছেন, এটা অযৌক্তিক। এতে সরকারের ঝুঁকিই বাড়ছে। কারণ এ গম খেয়ে মানুষ অসুস্থ হলে দায় কিন্তু সরকারকেই নিতে হবে। তাই নিরপেক্ষ দেশি বা বিদেশি প্রতিষ্ঠান দিয়ে এ গমের একটি পরিপূর্ণ পরীক্ষা করানো দরকার।

খাদ্যমন্ত্রী যা বলেন: খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম গতকাল সন্ধ্যায় সমকালের সঙ্গে আলাপকালে বলেন, চার মাস আগে যেসব প্যারামিটারের (মানদ ) ভিত্তিতে ব্রাজিলের গম নেওয়া হয়েছিল, পরীক্ষা করে দেখা গেছে এখনও তেমন আছে। এ গম সম্পূর্ণ খাবার উপযোগী। তবে খালাসের চার মাস পর এ গমে ভাঙা দানার পরিমাণ কিছুটা বেশি পাওয়া গেছে। অথচ গমের খাদ্যমূল্য সাড়ে ১০ শতাংশ ও আর্দ্রতার পরিমাণ ১১ শতাংশের নিচে পাওয়া গেছে। এ গম খাবার উপযোগী কি-না তার সনদ দিয়েছে সুইজারল্যান্ডের এসজিএস।

খাদ্যের মান পরীক্ষায় এ প্রতিষ্ঠানটি বিশ্বের সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠান। এ প্রতিষ্ঠান সার্টিফিকেট দেওয়ার পর আর পরীক্ষার দরকার নেই। এ ছাড়া আমাদের নিজস্ব পরীক্ষায় গমের পুষ্টিমান সঠিক পাওয়া যাচ্ছে। গম পচা বা খাবার উপযোগী নয় বলে যে প্রচার চালানো হচ্ছে, তা সঠিক নয় বলে তিনি দাবি করেন। তিনি বলেন, একটি মহল সরকারকে বিব্রত করতেই গমকে ইস্যু করছে। তিনি বিসিএসআইআর পরীক্ষার ফলাফল সম্পর্কে বলেন, তাদের আটটি পরীক্ষার মধ্যে ৭টিতেই আমদানির চুক্তির শর্ত অনুযায়ী মান সঠিক পাওয়া গেছে। ভাঙা দানা হলেই গম খারাপ তা ঠিক নয় বলে মন্তব্য করেন তিনি। যেসব গুদামে গমে পোকা ধরেছে সেসব গুদামে ওষুধ দিয়ে পোকা মারা হবে। ভালো গম না হলে পোকায় ধরত না বলেও মন্তব্য তার। মন্ত্রী বলেন, ২ লাখ টন গমের মধ্যে ইতিমধ্যে ১ লাখ ৪০ হাজার টন বিতরণ করা হয়েছে। অথচ কোথাও থেকে তো গম পচা এমন প্রশ্ন ওঠেনি।

এর আগে পুলিশ বাহিনীসহ কয়েকটি বিশেষ বাহিনী চিঠি দিয়ে বলেছে, এ গমের আটা খাওয়ার পর পেটের পীড়া হয়। ওএমএস কর্মসূচির মাধ্যমে বিক্রি করা এ আটা সম্পর্কে ডিলাররা বলছেন, এ আটা এতটাই দুর্গন্ধযুক্ত যে, কেউ নিতে চাচ্ছে না। এ গম ছত্রাকসমৃদ্ধ। এ আটার রুটি বা অন্য কোনো খাদ্যপণ্য তৈরি করলে তাতে সাদা রঙের ছত্রাক পড়ছে। কয়েকজন গবেষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, এ গমে আফলা টক্সিন নামে এক ধরনের তেজস্ক্রিয়তা থাকতে পারে। যা পরমাণু শক্তি কমিশনে পরীক্ষা করে নিশ্চিত হওয়া যায়।

মান নিয়ে প্রশ্ন এবং পরীক্ষা: বিসিএসআইআরের পরীক্ষাগারে মোট আটটি বৈশিষ্ট্যের পরীক্ষা করা হয়। প্রতি ৭৫ কেজি গম ওজন করে তা আদর্শ মাপ অনুযায়ী পাওয়া যায়নি। আমদানির শর্ত অনুযায়ী, ৭৫ কেজির বস্তার ওজন যদি ৭২ কেজির কম থাকে তাহলে তা বন্দর থেকে খালাস করা যাবে না, ফেরত দিতে হবে। কিন্তু পরীক্ষায় অধিকাংশ বস্তার ওজন ৭১ কেজি পাওয়া গেছে। খাদ্য অধিদপ্তরের গম আমদানির শর্ত অনুযায়ী গমের নষ্ট দানার পরিমাণ সর্বোচ্চ ৪ শতাংশ এবং শুকনো দানা ৫ শতাংশ পর্যন্ত থাকার কথা। অথচ নষ্ট গমের দানা পাওয়া গেছে ১৬ শতাংশের বেশি এবং শুকনো দানা পাওয়া গেছে প্রায় ৯ শতাংশ।

চট্টগ্রাম বন্দরে এ গম খালাসের সময়ও এর মান নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। তখন খাদ্য মন্ত্রণালয়-বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদের (বিসিএসআইআর) খাদ্যবিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টিবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট এবং খাদ্য অধিদপ্তরের নিজস্ব ল্যাবে পৃথকভাবে পরীক্ষা করে ব্রাজিলের গমের পুষ্টি সঠিক আছে মর্মে সার্টিফিকেট নেয়। অভিযোগ উঠেছে, তখন ব্রাজিলের পচা গমের পরীক্ষা করা হয়নি, দেশের ভালোমানের নতুন গমের নমুনা সংগ্রহ করে এসব প্রতিষ্ঠান থেকে মন্ত্রণালয়ের পক্ষে রিপোর্ট করিয়ে নেওয়া হয়।

খাদ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ফয়েজ আহমদ সমকালকে বলেন, আমরা ৮টি গুণাগুণ পরীক্ষা করে ভালোমানের তথ্য পেয়েছি। চট্টগ্রাম বন্দরে আসার পর আমরা তখন যে পরীক্ষা করেছিলাম সে সময়ও গমের মান সঠিক ছিল। তবে গম আমদানি ও খালাসের সময় তিনি দায়িত্বে ছিলেন না বলে উল্লেখ করেন। বিসিএসআইআর খাদ্যবিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ইনস্টিটিউটের পরিচালক ড. জহিরুল হক একই গমের পরীক্ষায় দুই রকম ফল পাওয়া সম্পর্কে সমকালকে বলেন, আমাদের যে নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে তা পরীক্ষা করে যে ফল পেয়েছি, তাই জানানো হয়েছে। গমে বিষাক্ত কিছু আছে কি-না তা পরীক্ষা করতে মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়নি বলেও জানান তিনি।

গম আমদানির সময় খাদ্য বিভাগের তৎকালীন মহাপরিচালক সারওয়ার খান সমকালকে বলেন, ব্রাজিলের বিভিন্ন এলাকার ক্ষেত থেকে এ গম সরবরাহ করায় সব গম একই রকম বা একই মানের হয়নি।

গত জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে সরকারের গমের মজুদ তলানিতে নেমে যায়। তখন প্রায় সোয়া ৪০০ কোটি টাকা দামের দুই লাখ টন গম আমদানির কার্যাদেশ পায় ইমপেক্স ইন্টারন্যাশনাল এবং ওলাম ইন্টারন্যাশনাল নামের দুটি প্রতিষ্ঠান। সরকার সশস্ত্র বাহিনী বিভাগ, বিজিবি, পুলিশ, আনসার, কোস্টগার্ড, ফায়ার সার্ভিসসহ অন্যান্য সংস্থার সদস্যদের মধ্যে রেশন হিসেবে যে আটা সরবরাহ করে তা এ গম থেকে প্রস্তুত করা হয়। এসব গম দিয়ে টিআর-কাবিখার প্রকল্পও চালানো হয়। প্রথমে পুলিশ ও পরে বিভিন্ন সংস্থা থেকে লিখিতভাবে এ আটা গ্রহণে অসম্মতি জানানো হয়। এ নিয়ে খাদ্য অধিদপ্তরের সঙ্গে বিভিন্ন বাহিনীর সদস্যের মধ্যে অপ্রীতিকর ঘটনাও ঘটে। সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা এ নিয়ে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তারা বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীকে অবহিত করেন। প্রধানমন্ত্রী খাদ্য সচিবকে ডেকে পোকায় খাওয়া গম দেখিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন বলেও জানা গেছে।

প্রধানমন্ত্রী এ ঘটনায় কারা জড়িত তা তদন্ত করে বের করার নির্দেশ দিয়েছেন।

বাংলাদেশ