অধিক যাত্রী দ্রুত পারাপার, সাশ্রয়ী, পরিবেশ বান্ধব ও আরামদায়ক সেবা নিশ্চিত করে রাজধানী ঢাকাকে যানজট মুক্ত করতে সরকারের নতুন প্রকল্প বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি)। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে সংরক্ষিত আলাদা লেনের মাধ্যমে প্রতি ঘণ্টায় ৩০ হাজার যাত্রী পারাপার হবে। স্টেশন থেকে প্রতি তিন মিনিট পর পর ছেড়ে যাবে অধিক গতিসম্পন্ন অত্যাধুনিক বাস। রাজধানীর যানজট নিরসন ও গণপরিবহন ব্যবস্থার আধুনিকায়নে গৃহীত প্রকল্পটিতে অর্থায়ন করবে বিশ্বব্যাংক। উন্নত বিশ্বে এ ব্যবস্থাটি পুরোনো হলেও বাংলাদেশে এই প্রথম।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের নির্মল বায়ু এবং টেকসই পরিবেশ (কেইস) প্রকল্প এবং ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষের (ডিটিসিএ) আওতায় বাস্তবায়িত প্রকল্পটি রাজধানীর উত্তরের গাজীপুর থেকে দক্ষিণের কদমতলী চত্বর পর্যন্ত বিস্তৃত হবে। এর দৈর্ঘ্য হবে ৪২ দশমিক ৫ কিলোমিটার এবং যাত্রী সাধারণের উঠা নামার জন্য ৪১টি স্টেশন থাকবে। এসব স্টেশন থেকে প্রতি তিন মিনিট পরপর নির্ধারিত লেনে অধিক যাত্রী বহনে সক্ষম দ্রুত গতির বাস ছেড়ে যাবে।
দুই ভাগে বিভক্ত এ প্রকল্পটির লাইন-৩ এর দক্ষিণাংশ ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) কেইস প্রকল্পের অধিনে বাস্তবায়ন করবে ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ ডিটিসিএ। এটি হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে কুড়িল ইন্টারচেঞ্জের নিচ দিয়ে ও বনানী রেল ওভারপাসের ওপর দিয়ে মহাখালী, সাতরাস্তা, মগবাজার, কাকরাইল, পল্টন, গুলিস্তান, নয়াবাজার ও বাবুবাজার দ্বিতীয় বুড়িগঙ্গা সেতু হয়ে কেরানীগঞ্জ পর্যন্ত বিস্তৃত হবে। এর দৈর্ঘ্য হবে ২২ কিলোমিটার এবং যাত্রী সাধারণের উঠা নামার জন্য ১৬টি স্টেশন, দু’টি বাস ডিপো এবং মহাখালী ও কাকরাইলে দু’টি ফ্লাইওভার নির্মাণ করা হবে।
প্রকল্পের উত্তরের অংশ গাজীপুর টার্মিনাল থেকে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতি বিমানবন্ধর পর্যন্ত বিস্তৃত হবে। জিডিএসইউটিপি প্রকল্পের অধীনে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর এ অংশ নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে। এর দৈর্ঘ্য ২০ দশমিক ২ কিলোমিটার। স্টেশন থাকবে ২৫টি। বাস স্টপেজে প্রবেশ-বাহির ও পথচারীদের পারাপারের জন্য ৩০টি আন্ডারপাস তৈরি করা হবে। ১৮ মিটার দীর্ঘ ১০০টি আর্টিকুলেটেড বাস চলাচল করবে এ পথে।
এতে উন্নত সংযুক্তি হিসেবে বাস নেটওয়ার্ক সংস্কার, নতুন ফিডার বাস সার্ভিস, সম্পূর্ণ করিডোরের সৌন্দর্যবর্ধন, ট্রাফিক সিগন্যাল নিয়ন্ত্রণ ও উন্নয়ন এবং অযান্ত্রিক যানের ব্যবহারে শৃঙ্খলা আসবে। ট্রাফিকেও আসবে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। ২০২০ সালে বিআরটি-৩ নির্মাণ সম্পন্ন হওয়ার কথা রয়েছে।
প্রকল্পটি চালু হলে জনবহুল শহর রাজধানী ঢাকার অনেকাংশে যানজট ও জ্বালানি খরচ কমবে এবং কম সময়ে দ্রুত গন্তব্যে পৌঁছা যাবে। একই সঙ্গে যাত্রী সুবিধার্থে নির্দিষ্ট স্থানে বাস স্টপেজসহ যাত্রী ছাউনি এবং আধুনিক ব্যবস্থাসহ টিকিট কাউন্টার নির্মাণ করা হবে। থাকবে আধুনিক স্টপেজ ও ই-টিকিটিংয়ের ব্যবস্থা। বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হবে। এর প্রতিটি আর্টিকুলেটেড বাসের দৈর্ঘ্য হবে ১৮ মিটার এবং এর যাত্রী ধারণক্ষমতা হবে ১৪০ জন। ৫০০ মিলিয়ন ডলার ব্যয়ে এ প্রকল্পের কাজ নকশা অনুমোদনের পরপরই শুরু হওয়ার কথা রয়েছে।
যেমন পাবেন সেবা:
এ প্রকল্পের বাসগুলো নির্দিষ্ট সংরক্ষিত লেনে চলাচল করবে। নির্ধারিত স্থান থেকে যাত্রী উঠা নামা করবে ও অল্প সময়ে পরপর বাস চলবে।
যানবাহন:
অধিক যাত্রী ধারণক্ষমতাসম্পন্ন অর্টিকুলেটেড বাস ব্যবস্থা। বাসের স্বয়ংক্রিয় দরজা, স্টেশন এবং বাসের ডেকের উচ্চতা সমান থাকবে। ফলে যাত্রীদের উঠা নামায় কষ্ট হবে না। প্রতিবন্ধীদের জন্য থাকবে র্যাম্প অথবা হুইল চেয়ারের ব্যবস্থা।
স্টেশন:
এ প্রকল্পের বাসগুলো থামানোর জন্য আরামদায়ক, নিরাপদ ও সহজে প্রবেশযোগ্য স্টেশনের ব্যস্থা থাকবে। টিকেট ব্যবস্থায় থাকবে স্বয়ংক্রিয় ও ই-টিকেটিং পদ্ধতি। থাকবে যাত্রীদের বিশ্রামেরও ব্যবস্থা।
এ প্রসঙ্গে বিআরটি দক্ষিণের প্রকল্প পরিচালক আনিসুর রহমান বাংলামেইলকে বলেন, ‘এমনিতেই রাজধানীতে দীর্ঘসময় অপেক্ষা করেও গণপরিবহনে উঠা যায় না। এরপর ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজটে আটকা পড়তে হয়। একই রুটে একাধিক বাস চলাচলের কারণে যানজটেরও সৃষ্টি হয়। তাছাড়া শিশু, বৃদ্ধ এবং প্রতিবন্ধীদের বাসে উঠা ও নামার জন্য ব্যবস্থা না থাকায় নানান সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। বিআরটির মাধ্যমে এসব মোকাবেলা করা যাবে।’
প্রকল্পের নকশা নিয়ে তিনি বলেন, ‘বিআরটির নকশা প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। চলতি মাসেই তা অনুমোদন হবে। দাতা সংস্থা বিশ্বব্যাংক অর্থায়ন করলেই কাজ শুরু হবে।’
তিনি আরো জানান, ‘যানজট নিরসন ও নির্বিঘ্ন যাতায়াতে বিশ্বজুড়ে জনপ্রিয় ব্যবস্থা বিআরটি। অন্যান্য পদ্ধতির মতো খুব বেশি অবকাঠামো তৈরিরও প্রয়োজন হয় না এতে। বিদ্যমান সড়কের দুই পাশের সড়ক বিভাজক দিয়ে পৃথক লেন করেই চলে এই বিআরটি। বাসে ওঠানামার জন্য কিছু স্টপেজ তৈরি করতে হয়। আর মাটি থেকে দু-তিন ফুট উঁচুতে তৈরি করতে হয় ছাউনি। স্টপেজের সামনে বাস থামার পর সোজা হেঁটে বাসে উঠেতে পারবে যাত্রীরা। আর চলাচলের রুটের প্রতিটি মোড়ে থাকে স্বয়ংক্রিয় সিগন্যাল ব্যবস্থা। বাস মোড়ের কাছাকাছি আসার আগেই সিগন্যাল বাতিগুলো জ্বলে। এতে মোড়ে অন্যান্য যানবাহন বন্ধ করে বিআরটির বাসকে আগে যাওয়ার সুযোগ দেয়া হয়।’
প্রকল্প পরিচালক আনিসুর রহমান জানান, বাস স্টপেজে প্রবেশ-বাহির ও পথচারীদের পারাপারের জন্য ৩০টি আন্ডারপাস নির্মাণ করা হবে। ১৮ মিটার দীর্ঘ ১০০টি আর্টিকুলেটেড বাস চলাচল করবে এ পথে। বিআরটির মাধ্যমে ঘণ্টায় ৩০ হাজার যাত্রী কেরানীগঞ্জ থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত যাতায়াত করতে পারবে। বাসগুলোয় ভাড়া আদায়ের জন্য থাকবে ইলেক্ট্রনিক স্মার্ট কার্ড সিস্টেম, যা যে কোনো সময় সুবিধাজনক স্টোর থেকে রিচার্জ করা যাবে।
এদিকে রাজধানী ঢাকার যানজট নিরসনে ২১ হাজার ৯৮৫ কোটি ৭ লাখ টাকা ব্যয়ে মেট্রোরেল প্রকল্প ও ২৫ কোটি টাকা ব্যয়ে অত্যাধুনিক কাউন্টডাউন টাইমার স্থাপন প্রকল্প হাতে নেয়া হয়। এর মধ্যে মেট্রোরেল প্রকল্প নির্মাণাধীন থাকলেও কাউন্টডাউন টাইমার ইতোমধ্যে যানজন নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়েছে। এরপর আবার নতুন করে এ প্রকল্পটি নিয়ে যানবাহন বিশেষজ্ঞদের রয়েছে নানা আপত্তি।
এ বিষয়ে ডাব্লিউবিবি ট্রাস্টের ন্যাশনাল অ্যাডভোকেসি অফিসার ও ট্রাফিক বিশেষজ্ঞ মারুফ রহমান বাংলামেইলকে বলেন, ‘আমাদের দেশে যানবাহন ও ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের জন্য যেসব প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে তা বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিয়ে করা হয় না। মূলত কিছু কর্মকর্তার ইচ্ছানুযায়ী প্রকল্পগুলো হাতে নেয়া হয়। যে কারণে সব প্রকল্পই ব্যর্থ হয়।’
তিনি বলেন, ‘দীর্ঘ পরিকল্পনায় বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে প্রকল্পটি হাতে নিলে এর সুফল পাওয়া যাবে। তবে যেহেতু প্রতি তিন মিনিট পর পর এর নির্ধারিত লেনে গাড়ি ছেড়ে যাবে সেহেতু ট্রাফিক মোড়গুলোতে পর্যাপ্ত আন্ডারপাস লাগবে। না হয় অন্য সড়কের যানবাহন চলাচল করতে পারবে না। তাতে করে প্রকল্পটি পুরোই ব্যর্থ হবে।’