বাতজ্বরে বরাভয়
ডাঃ মোঃ বজলুল করিম চৌধুরী
ছোটভাই ইশতিয়াক সেদিন মুখ ভার করে এলো আমার কাছে। সদা হাসিখুশি ছেলেটিকে দেখে হঠাৎই কিছুটা ভিত হলাম। মন খারাপের কারণ জানতে চাইলে মুখ আরো গম্ভির হয়ে গেল তার, বললো, ভাইজান আর বলবেন না, আমার ছেলেটির বাতজ্বর হয়ে গেছে…। কথা আর সরছিল না তার মুখ থেকে। অন্য সময় কথার ফুলঝুড়ি ছোটায় যে ছেলেটি, এখন তার কি অবস্থা! আমি আশ্বস্থ করে বললাম, আরে বাবা বিস্তারিত খুলেই বলো না, তারপর দেখা যাক কি করা যায়।
আমার শেষের কথায় কিছুটা আশ্বস্থ হলো সে। বললো, ভাইজান আমার ছেলে অনিকেতকে তো চেনেনই। বেশ ক’দিন ধরে তার পায়ে ব্যথা হচ্ছিল। দুই-তিন দিন আগে ওকে এলাকার একজন ডাক্তার দেখালাম। উনি রক্ত পরীক্ষা করে জানালেন, অনিকেতের বাতজ্বর হয়েছে।
ঃ তারপর? আমি বিষ্মিত হয়ে প্রশ্ন ছুড়ে দিলাম।
ঃ তারপর আর কি! চিকিৎসা চলছে। ডাক্তার ইনজেকশন দিয়ে দিয়েছে। বড় ব্যথার ইনজেকশনরে ভাই। প্রতি তিন সপ্তাহ পর পর নাকি দিতে হবে। এভাবে পাঁচ বছর নাকি চিকিৎসা চালাতে হবে। এক ইনজেকশন দেবার পরই যে অবস্থা হয়েছে ছেলেটির, কিভাবে যে পাঁচ বছর যাবে, আল্লাহ-ই জানেন। ইশতিয়াকের মুখে হতাশা।
ঃ এখনই এত দুশ্চিন্তা না করে তুমি আগামী কাল সব কাগজপত্রসহ ছেলেকে আমার কাছে নিয়ে আস, দেখা যাক।
পর দিন যথা সময়ের আগেই ইশতিয়াক চিকিৎসার কাগজপত্রসহ ছেলে অনিকেতকে নিয়ে হাজির। কৌতূহলের কারণে খুব একটা কথা না বাড়িয়ে কাগজপত্রগুলো পরীক্ষা করে জানতে চাইলাম গত কিছুদিনের ভিতর অনিকেতের গলায় কোনো ব্যথা হয়েছিল কিনা। অনিকেতের নিকট থেকে ”না” সূচক জবাব পাওয়ায় একই বিষয়ে জানতে চাইলাম ইশতিয়াকের কাছে। একই ধরনের জবাব পেলাম ওর কাছ থেকেও। ইশতিয়াক জানালো, অদূর ভবিষ্যতে তো বটেই, গলা ব্যথার কোনো ইতিহাস আজ পর্যন্ত ছেলের কাছ থেকে শুনেছে বলে ওর জানা নাই। আরো কিছু কথাবার্তা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর একটি রক্ত পরীক্ষার পরামর্শ দিয়ে এবং রোগের বিষয়ে আশ্বস্থ করে সেদিনের মত ওদের বিদায় দিলাম।
দুই দিন পর রক্তের নতুন রিপোর্টটি নিয়ে ইশতিয়াক আবার এলো। এবারের রিপোর্টসহ পূর্বেকার সকল বিষয়-আসয় বিশ্লেষণের পর আমি দৃঢ়ভাবে ইশতিয়াককে জানালাম ওর ছেলের মোটেও বাতজ্বর হযনি।
আমার কথায় আনন্দে চক্চক্ করে উঠলো ইশতিয়াকের চোখ। বললো, সত্যি বলছেন ভাইজান! তবে যে ওই ডাক্তার সাহেব বাতজ্বর কনফার্ম করে চিকিৎসা দিয়ে দিল। ওর রক্তে নাকি এএসও টাইটার বেশি।
ঃ এখানেই তো সমস্যা ইশতিয়াক। অনেক পল্লী চিকিৎসকতো বটেই, কিছু কিছু পাস করা ডাক্তারও ভুল করেন বাতজ্বর নির্ণয়ে। শুধুমাত্র রক্তের এএসও (অঝঙ) টাইটার কিছুটা বেশি দেখেই বাতজ্বর কনফার্ম করে চিকিৎসা দিতে শুরু করে দেন, আর তার মাশুল দিতে হয় বাচ্চা-বাচ্চা ছেলে-মেয়ে এবং তাদের অভিভাবকদের। আমার কি মনে হয় জান, বাতজ্বরের ভুল ডায়াগনসিসের শিকার হন শতকরা প্রায় ৮০ ভাগ রোগীই।
ঃ আচ্ছা ভাইজান, আপনার কথায় আমি যার পর নাই আশ্বস্থ হলাম। মনে হচ্ছে যেন মাথার উপর থেকে বড় একটি বোঝা নেমে গেছে। কিন্তু ভাইজান, আমার খুবই জানতে ইচ্ছে হচ্ছে, আপনি কিসের ভিত্তিতে এতটা নিশ্চিত হলেন যে অনিকেত বাতজ্বর মুক্ত।
ঃ অর্থাৎ বাতজ্বরের ডায়াগনসিসের ব্যাপারে…?
ঃ শুধু তাই না, আপনি বাতজ্বরের পুরো বিষয়টি আমাকে একটু জানাবেন কি?
ঃ ঠিক আছে, তাহলে শুনো। বাতজ্বর রোগটি সাধারণতঃ ৫-১৪ বছর বয়সি শিশু-কিশোরদের মাঝে হতে দেখা যায়। এটি হচ্ছে একটি স্ট্রেপটোকক্কাস সংক্রমণোত্তর (চড়ংঃ ংঃৎবঢ়ঃড়পড়পপধষ) অটো ইমিউন রোগ, যা দেহের সমস্ত কোলাজেন টিস্যুকে আক্রান্ত করে। বুঝলে নাতো? আরেকটু বুঝিয়ে বলি। গ্রুপ-এ বিটা হিমোলাইটিক স্ট্রেপটোকক্কাই (এৎড়ঁঢ়-অ, β যবসড়ষুঃরপ ঝঃৎবঢ়ঃড়পড়পপর) নামক একধরনের রোগ জীবাণু দ্বারা সচরাচর আমাদের ফেরিংস কিংবা টনসিল আক্রান্ত হয়ে থাকে। যদি এই জীবাণুটির দ্বারা কারো টনসিলাইটিস (ঞড়হংরষরঃরং) বা ফেরেনজাইটিস (চযধৎুহমরঃরং) হয় তবে দেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা (ওসসঁহব ংুংঃবস) সক্রিয় হয়ে সেই জীবাণুটির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলে। তারই অংশ হিসেবে এই জীবাণুটির গাত্রাবরণে অবস্থিত এক ধরনের এন্টিজেন (অহঃরমবহ) যার নাম স্ট্রেপ্টোলাইসিন-ও (ঝঃৎবঢ়ঃড়ষুংরহ-ঙ) তার বিরুদ্ধে এক ধরনের এন্টিবডি (অহঃরনড়ফু) মানব দেহে উৎপন্ন হয়, যাকে সঙ্গত কারণেই এন্টিস্ট্রেপ্টোলাইসিন-ও (অহঃরংঃৎবঢ়ঃড়ষুংরহ-ঙ) সংক্ষেপে এএসও (অঝঙ) বলে। এছাড়াও জীবাণুটির বিরুদ্ধে আরো নানা ধরনের প্রতিরোধ ব্যবস্থা আমাদের দেহে সৃষ্টি হয়ে জীবাণুর বিরুদ্ধে সক্রিয় হয়। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো দেহে অবস্থানরত জীবাণুটির বিরুদ্ধে যে এন্টিবডিসমূহ তৈরি হয় সেই এন্টিবডি ওই জীবাণুর বিরুদ্ধাচরণ করা ছাড়াও দেহে অবস্থানরত সমস্ত কোলাজেন টিস্যুর বিরুদ্ধেও সক্রিয় হয়ে উঠে (অন্যান্য রোগের বেলা সচরাচর এমনটি হয় না)। তাই এই এন্টিবডি জীবাণুর বিরুদ্ধাচরণ করা ছাড়াও দেহের যে সমস্ত অংশে কোলাজেন টিস্যু রয়েছে তাদের বিরুদ্ধেও যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে যায়। ফলশ্রুতিতে যা হবার তা-ই হয়। আক্রান্ত ওই সমস্ত টিস্যু সম্বলিত অর্গ্যানসমূহে নানা ধরনের বিরূপ প্রতিক্রিয়া বা ইনফ্লামেটরী প্রসেস (ওহভষধসসধঃড়ৎু ঢ়ৎড়পবংং) দেখা দেয়। দীর্ঘদিন এই প্রক্রিয়া চলতে থাকলে ওই সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গসমূহ এক পর্যায়ে অকেজো হয়ে পড়ে।
ইশতিয়াক এতক্ষণ মনযোগের সাথে আমার কথাগুলো শুনে আসছিল। এইবার সে আর কৌতূহল দমন করতে না পেরে জিজ্ঞেস করলো, এই সমস্ত কোলাজেন টিস্যু দেহের কোন্ কোন্ অঙ্গ প্রত্যঙ্গে রয়েছে?
ঃ হ্যাঁ, ভালো প্রশ্ন। যে সমস্ত অঙ্গ প্রত্যঙ্গে এই কোলাজেন টিস্যু রয়েছে তাদের মাঝে অন্যতম হচ্ছে অস্থি-সন্ধি বা জয়েন্টসমূহ হৃৎপিন্ড, চামড়ার নিচের অংশ এবং কিছু রয়েছে ব্রেন টিস্যুতে।
ঃ তাহলেতো বিশাল ব্যাপার। এই এন্টিবডিগুলো দীর্ঘদিন দেহে অবস্থান করলেতো হৃৎপিন্ড অকেজো হয়ে যাবে, তখনতো বিপদ!
ঃ হ্যাঁ, তাইতো হয়। সেজন্যই তো এই রোগে আক্রান্তদের দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা দিতে হয় যেন হৃদযন্ত্র অকেজো হতে না পারে।
ঃ ভাইজান, অনিকেতের বেলায় তো অবলিলায় বলে দিলেন ওর এমন ভয়াবহ রোগটি নেই। কি দেখে আপনি এমনটি বলতে পারলেন?
ঃ একে একে সব প্রসঙ্গেই আসছি। প্রথমেই বলেছি এটি একটি জীবাণু ঘটিত রোগের পরবর্তি ধারাবাহিকতা, যে জীবাণুগুলো ফেরিংস কিংবা টনসিলকে আক্রান্ত করে। তাহলে রোগটির ব্যাপারে সন্দেহ করতে গেলে প্রথমেই জানতে হবে রোগটির সূচনা লগ্নের প্রথম ২/৩ সপ্তাহের ইতিহাস। উক্ত সময়ের মধ্যে রোগীর কোনো গলা ব্যথা অর্থাৎ ফেরেনজাইটিস কিংবা টনসিলাইটিস হয়েছিল কিনা সেটা জানা অত্যন্ত জরুরি, যা সঙ্গত কারণেই থাকার কথা। জীবাণুটি দ্বারা ফেরিংস কিংবা টনসিল আক্রান্ত হবার পর তার বিরুদ্ধে দেহে এন্টিবডি তৈরি হতে কিছুটা সময় নেবে, যা হতে পারে ২ কিংবা ৩ সপ্তাহের মত। পর্যাপ্ত পরিমাণ এন্টিবডি তৈরি হবার পর পরই সেগুলো জীবাণুটির বিরুদ্ধে কার্যকরের পাশাপাশি দেহে অবস্থিত কোলাজেন টিস্যুর বিরুদ্ধেও কার্যকর হবে এবং তখনই জ্বরের সাথে দেহের বিভিন্ন অস্থিসন্ধিতে ব্যথা অনুভূত হবে এবং সেগুলো ফুলে উঠতে পারে। দেখা দিতে পারে বুকে ব্যথাসহ আরো কিছু নির্দিষ্ট (ংঢ়বপরভরপ) উপসর্গ।
ঃ ভাইজান তাহলে তো দেখা যাচ্ছে জীবাণুটির বিরুদ্ধে দেহে যে এন্টিবডি তৈরি হয় রক্তে তার পরিমাণ বেশি হওয়া মানেই বাতজ্বরের উপস্থিতি নিশ্চিত হওয়া।
ঃ আপাতঃ দৃষ্টিতে সেটাই মনে হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু বিষয় হলো দেহে যে কোনো সময় কোনো না কোনো প্রক্রিয়ায় জীবাণুটির প্রবেশ ঘটার কারণেই এন্টিবডির পরিমাণ বেড়ে যেতে পারে, অথচ তখন জীবাণুটি সক্রিয় নাও থাকতে পারে। এমতাবস্থায় এএসও টাইটার বেশি হওয়া মানে বাতজ্বর হতে হবে তা নয়। কিন্তু যদি আরো কিছু ক্রাইটেরিয়ার সাথে এএসও টাইটারও বেশি হয় তখনই কেবল বাতজ্বর বলে নিশ্চিত হওয়া যায়।
ঃ রোগ নির্ণয়ের অন্যান্য বৈশিষ্ট্যগুলো কি ভাইজান?
ঃ বলছি শোন..। আগেই বলেছি গ্রুপ-এ বিটা হিমোলাইটিক স্ট্রেপ্টোকক্কাই-এর বিরুদ্ধে দেহে সৃষ্ট এন্টিবডিগুলো বিভিন্ন স্থানে অবস্থিত কোলাজেন টিস্যুতে ক্ষত সৃষ্টি করে, আর তাই যে লক্ষণসমূহ প্রকাশ পায় সেগুলো হলো ঃ ১. আর্থ্রাইটিস (অৎঃযৎরঃরং) বা অস্থিসন্ধিতে ইনফ্লামেশন – এর ধরন হচ্ছে মাইগ্রেটিং প্রকৃতির পলি আথ্রাইটিস (সরমৎধঃরহম ঢ়ড়ষু ধৎঃযৎরঃরং) যা বিভিন্ন ধরনের বড় জয়েন্টগুলোতে হয়ে থাকে এবং তা সব সময় একই জয়েন্টে সীমাবদ্ধ থাকে না। দেখা গেল কিছু কিছু জয়েন্টে সকালবেলা ফুলে উঠে ব্যথা হচ্ছে, আবার বিকালবেলা সেগুলো ভালো হয়ে গিয়ে অন্য জয়েন্টে একই উপসর্গ শুরু হয়ে গেল। ২. কার্ডাইটিস (ঈধৎফরঃরং), অর্থাৎ হৃদযন্ত্রে অবস্থিত কোলাজেন টিস্যুতে ইনফ্লামেশন। এর কারণে হার্টের বাল্বগুলো ফুলে উঠে রক্ত চলাচলে ব্যাঘাত সৃষ্টি করার কারণ হয়ে উঠতে পারে।। আর তাই এক্ষেত্রে ইসিজি-তে (ঊঈএ) পরিবর্তন আসতে পারে। ৩. ইরাইথেমা মার্জিনেটাম (ঊৎুঃযবসধ সধৎমরহধঃঁস), এক্ষেত্রে চামড়ার উপর এক ধরনের ব্যথামুক্ত চুলকানি বিহীন রেশ (ৎধংয) সৃষ্টি হয়, যা বেশি একটা দীর্ঘস্থায়ী হয় না। ৪. সিডেনহাম কোরিয়া (ঝুফবহযধস পযড়ৎবধ), মস্তিষ্কে অবস্থিত কোলাজেন টিস্যু আক্রান্ত হলে সেখান থেকে কিছু ইমপাল্স তৈরি হবার কারণে দেহের বিভিন্ন অঙ্গ হঠাৎ হঠাৎ ঝাকুনি দিয়ে উঠতে পারে। ৫. সাবকিউটেনিয়াস নডিউলস (ঝঁনপঁঃধহবড়ঁং হড়ফঁষং), চামড়ার নিচে কোথাও কোথাও শক্ত দানা দেখা দিতে পারে। এছাড়াও দেহে যেহেতু একটি ইনফ্লামেশন প্রক্রিয়া চলতে থাকে তাই রক্তের ইএসআর (ঊঝজ) বেড়ে যায়। গায়ে জ্বর থাকে। মোটামুটি এগুলোই হচ্ছে রোগ নির্ণয়ের উপকরণ। সকল বাতজ্বর রোগীদের যে সবগুলো উপসর্গই প্রকাশ পেয়ে থাকে তা নয়। তাই রোগ নির্ণয়ের জন্য একটি পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়, যাকে জোন্স পদ্ধতি (ঔড়হবং পৎরঃবৎরধ) বলে অভিহিত করা হয়ে থাকে। জোন্স ক্রাইটেরিয়া অবলম্বনে রোগটি নির্ণয়ের জন্য রোগের লক্ষণসমূহকে দুই ভাগে ভাগ করে নেয়া হয়। এদের মধ্যে কতগুলো মুখ্য লক্ষণ (সধলড়ৎ ংরমহ ধহফ ংুসঢ়ঃড়স) এবং কতগুলোকে গৌণ লক্ষণ (সরহড়ৎ ংরমহ ধহফ ংুসঢ়ঃড়স)। মুখ্য লক্ষণসমূহ হলো, কার্ডাইটিস (যা বুঝা যায় রোগীর বুকের ব্যথা ও শ্বাস কষ্ট অনুধাবন করার মাধ্যমে), আর্থ্রাইটিস (ধৎঃযৎরঃরং), সিডেনহাম কোরিয়া (ঝুফবহযধস পযড়ৎব), ইরাইথেমা মার্জিনেটাম (ঊৎুঃযবসধ সধৎমরহধঃঁস) ও চামড়ার নিচে উৎপন্ন হওয়া দানা (ঝঁনপঁঃহবড়ঁং হড়ফঁষং)। আর
গৌণ লক্ষণসমূহগুলো হলো জয়েন্ট পেইন বা অস্থি সন্ধিতে ব্যথা, উচ্চ মাত্রায় জ্বর হওয়া (১০২০ ফারেনহাইটের মত), রক্তের ইএসআর বেড়ে যাওয়া এবং হৃদযন্ত্রের অনিয়মিত স্পন্দন যা ইসিজি-এর মাধ্যমে নির্ণয় করা যায়।
উপরে উল্লেখিত লক্ষণসমূহের মধ্যে কমপক্ষে দু’টি মুখ্য লক্ষণ অথবা দু’টি গৌণ লক্ষণ এবং এক বা একাধিক মুখ্য লক্ষণের উপস্থিতি পর্যবেক্ষণের সাথে রক্তে এএসও টাইটার বেশি থাকলেই বাতজ্বর বলে ধরে নেয় হয়।
ঃ সে না হয় হলো রোগ নির্ণয়ের বিষয়; কিন্তু কথা হলো, আপনি কিভাবে নিশ্চিত হলেন যে অনিকেতের বাতজ্বর নেই।
ঃ আসছি সে প্রসঙ্গে । একে একে পর্যালোচনা করা যাক তার অসুস্থতার লক্ষণসমূহ। প্রথমেই উল্লেখযোগ্য বিষয়টি হলো, তার কোনো জ্বর কিংবা গলা ব্যথার ইতিহাস নেই, যা তুমি কনফার্ম করেছো। তার মুখ্য কিংবা গৌণ লক্ষণসমূহের একটিও উপস্থিত নেই। তার রক্তের ইএসআর-এর মাত্রাও স্বাভাবিক, যা আমি ইনভেস্টিগেট (রহাবংঃরমধঃব) করে পেয়েছি। সুতরাং…।
ঃ কিন্তু ভাইজান ওর হাতে পায়ের ব্যথা…।
ঃ হাতে পায়ে ব্যথা মানেই আর্থ্রাইটিস নয়। এর হাজারটি কারণ থাকতে পারে; কিন্তু আর্থ্রাইটিস হলে তার নির্দিষ্ট ক্রাইটেরিয়া থাকবে, যা ওর মধ্যে নেই। হ্যাঁ, একটিই বিষয় পজেটিভ ছিল, এএসও (অঝঙ) টাইটার, এটি নন-স্পেসিফিক (হড়হংঢ়বপরভরপ) গুরুত্ব দেয়ার কিছু নেই।
ঃ বাব্বাহ্! ডাক্তারতো হয়েই যাচ্ছি ভাই। এবার চিকিৎসাটা বলে দিলেই হলো।
ঃ ঠিকই বলেছো। এতই যখন বলা গেল তাহলে চিকিৎসাটাইবা বাদ যাবে কেন। তবে চিকিৎসা বিষয়টি খুবই সোজা। প্রথমতঃ যা করতে হবে তা হলো রোগটি কর্তৃক সৃষ্ট দেহের ইনফ্লামেশন প্রক্রিয়া বন্ধ করতে হবে, সেজন্য রোগীকে এন্টি-ইনফ্লামেটরী (ধহঃর-রহভষধসসধঃড়ৎু) ঔষধ দেয়া হয়। তাছাড়া যেহেতু রোগীর দেহে এন্টিবডি তৈরির কারণ হচ্ছে গ্রুপ-এ, বিটা হিমোলাইটিক স্ট্রেপ্টোকক্কাই, সুতরাং পরবর্তিতে রোগীর দেহে জীবাণুটির অণুপ্রবেশ বন্ধ করতে হবে। তাই প্রতিরোধক হিসেবে রোগীকে দেয়া হয় দীর্ঘমেয়াদি পেনিসিলিন জাতীয় জীবাণুবিরোধী ঔষধ। হতে পারে সেটা কমপক্ষে পাঁচ বছর অথবা রোগীর বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী আরো অধিক সময়। এ ছাড়াও লক্ষণ ভেদে আরো কিছু ঔষধ প্রয়োজনে দেয়া হয়ে থাকে। এক নজরে এই তো চিকিৎসা। এবার বুঝলে তো কেন আমি বললাম অপচিকিৎসাধীন অধিকাংশ বাতজ্বরের রোগীই প্রকৃত বাতজ্বরের রোগী নয়।
ঃ হ্যাঁ, বাতজ্বরের বিষয়ে একদম অন্ধকারে ছিলাম, এখন দৃষ্টি খোলাসা হলো। তাছাড়া ছেলেটি যে একটি বিরাট ফাড়া কেটে উঠলো সে জন্য আল্লাহ্কেও অশেষ ধন্যবাদ। ধন্যবাদ আপনাকেও।
লেখকঃ ডাঃ মোঃ বজলুল করিম চৌধুরী, সহযোগী অধ্যাপক, মানিকগঞ্জ মেডিকেল কলেজ। |