আগামী ২০১৫-১৬ অর্থবছরের জন্য ৬ লাখ ৩২ হাজার ৫০০ কোটি টাকার বিকল্প বাজেট প্রস্তাব করেছে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি (বিইএ)। এর মধ্যে এনবিআর, এনবিআর-বহির্ভূত কর এবং কর-বহির্ভূত আয় মিলিয়ে মোট রাজস্ব আয় ধরা হয়েছে ৪ লাখ ৮৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। ঘাটতি ১ লাখ ৪৫ হাজার কোটি টাকা। ঘাটতি পূরণে বিদেশি অর্থায়ন নেয়া হবে না। ব্যাংকিং খাত, সঞ্চয়পত্র বিক্রি, পিপিপি এবং প্রবাসী বন্ড ইস্যু করে এ অর্থের সংস্থান করা হবে। আয়ের ক্ষেত্রে পরোক্ষ করের চেয়ে প্রত্যক্ষ করের অনুপাতই বেশি ধরা হয়েছে। আর ব্যয়ের মধ্যে উন্নয়ন ব্যয়কে সবচেয়ে বেশি অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে। শনিবার রাজধানীর বিইএ কার্যালয়ে আয়োজিত এক প্রাক-বাজেট সাংবাদিক সম্মেলনে এ বাজেট উপস্থাপন করেন বিইএর সাধারণ সম্পাদক ড. জামালউদ্দিন আহমেদ। এ সময় বিইএর সাবেক সভাপতি ড. আবুল বারকাতসহ আরো অনেকে উপস্থিত ছিলেন।
অর্থনীতি সমিতির প্রস্তাবিত বিকল্প বাজেটে এনবিআরের আয় ধরা হয়েছে ২ লাখ ৮০ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এনবিআর-বহির্ভূত আয় ৫৪ হাজার কোটি টাকা। আর কর-বহির্ভূত আয় ধরা হয়েছে ১ লাখ ৫৩ হাজার কোটি টাকা। ঘাটতি অর্থায়নে ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়া হবে ৩০ হাজার কোটি টাকা, দেশিয় সঞ্চয় ইন্সট্রুমেন্ট বিক্রি করে ২৫ হাজার কোটি টাকা, পিপিপি খাতে ৪৫ হাজার কোটি টাকা এবং প্রবাসী বন্ড থেকে ৪৫ হাজার কোটি টাকা। আর ব্যয়ের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দেয়া হবে মানবসম্পদ উন্নয়ন, ভৌত সম্পদ উন্নয়ন এবং প্রাকৃতিক সম্পদের দক্ষ ব্যবহারের ক্ষেত্রে। বিকল্প বাজেটে ১৩টি খাতে নতুন কর (আগে কোনো কর ছিল না) আরোপের প্রস্তাব করা হয়েছে। এ খাতগুলো হলো—বিদেশি নাগরিক কর (০.৫৩%), সার্ভিস ট্যাক্স (১.৪৩%), সম্পত্তি কর (৫.৩৫%), এয়ার লাইন ট্রাভেল এজেন্সি কর (০.৮৯%), ট্রাভেল ট্যাক্স (৩.৭০%), টেলিফোন বোর্ড ট্যাক্স (০.৯৮%), বিটিআরসি (৬.৫৪%), বিইআরসি (১.৯৬%), আইডিআরএ (১.৬৩%), বিএসইসি (১.৯৬%), বিআইডব্লিউটিএ (১.৯৬%), সরকারি মনোহারি বিক্রি কর (০.৯৮%) এবং মিউনিসিপাল হোল্ডিং ট্যাক্স (১.৯৬%)।
বিকল্প বাজেট বাস্তবায়নের সক্ষমতা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ড. আবুল বারকাত বলেন, ‘বর্তমানে আদৌ কর নেই—এমন খাত থেকে ৫০ হাজার ৫০০ কোটি টাকা আনা সম্ভব। এনবিআরের ভাষ্য মতে দেশে ২ কোটি টাকার মালিকের সংখ্যা মাত্র ১০ হাজার। অথচ এ সংখ্যা অন্তত ১ লাখ হবে। এদের থেকে কর আদায় করতে পারলে অনেক রাজস্ব আয় সম্ভব। এনবিআর সদ্ভাবে কাজ করলে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী রাজস্ব আয় করা সম্ভব’।
ড. আবুল বারকাত আরো বলেন, ‘আমরা বৈষম্যহীন, উন্নত ও শক্তিশালী অর্থনীতি চাই। এ জন্য বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। অবকাঠামো খাতে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। তাই মানব উন্নয়নের পাশাপাশি প্রস্তাবিত বাজেটে অবকাঠামো খাতকে অধিক গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ চাইলে এ বাজেট বাস্তবায়ন সম্ভব। আয় বৈষম্য কমানোর গুরুত্ব উপস্থাপন করে তিনি বলেন, মধ্য আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার গাল গল্প শুনিয়ে আর লাভ নেই। কারণ, কালো টাকা যোগ করলে এমনিতেই আমরা মধ্য আয়ের দেশে উন্নীত হয়ে গেছি। এ অবস্থায় সাধারণ মানুষের আর্থিক অবস্থার উন্নতি হয়েছে কি না, সেটাই বিবেচ্য বিষয়।’
বিভিন্ন শিল্প বেসরকারিকরণের বিরোধিতা করে আবুল বারকাত বলেন, ‘এখনো যুক্তরাষ্ট্রের মোট আউটপুটের ৩৭ ভাগ রাষ্ট্রায়ত্ত্ব প্রতিষ্ঠানগুলোর। অথচ তারা আমাদের বিরাষ্ট্রীকরণের উপদেশ দেয়। সমাজতন্ত্রের এ দেশে বিরাষ্ট্রীকরণ সংবিধান পরিপন্থী। তাই দেশজ শিল্প সংরক্ষণে অধিক গুরুত্ব দেয়া দরকার।’
আগামী অর্থবছরের বাজেট প্রসঙ্গে অর্থনীতি সমিতির লিখিত বক্তব্যে ড. জামালউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘দারিদ্র্য বৈষম্য দূরীকরণ, মানবসম্পদ উন্নয়ন ও সামাজিক কল্যাণ খাতের উন্নয়নে ধীরে ধীরে প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় হ্রাসে পদক্ষেপ নেয়া দরকার। মানসম্পন্ন ও জনকল্যাণমুখী সরকারি স্বাস্থ্য খাতের নিশ্চয়তা দরকার (শুধু প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা নয়, উচ্চতর স্বাস্থ্যসেবাসহ)। নারী ও শিশুদের জন্য সুস্পষ্টভাবে বরাদ্দ দিতে হবে। করপ্রশাসনের আওতা জেলা, উপজেলা এবং ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত নেয়া প্রয়োজন। দেশে কমপক্ষে ১ কোটি টাকা কর দেয়ার যোগ্য লোকের সংখ্যা অন্তত ৫০ হাজার জন। অথচ কর দেন মাত্র ৫০ জন। এ বিষয়ে সরকারের নজর দেয়া প্রয়োজন। এ ছাড়া, সিগারেট ও বিড়ির ক্ষেত্রে মূল্যস্তর ভিত্তিক কর কাঠামো বাতিল করে সমহারে উচ্চ এক্সাইজ ট্যাক্স আরোপ করা হলে অন্তত ১ লাখ লোক বিড়ি, সিগারেট ছেড়ে দিবেন। অন্যথায় সিগারেট থেকে প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা, বিড়ি থেকে ১ হাজার কোটি টাকা এবং ধোয়াবিহীন তামাকজাত দ্রব্য থেকে ১ হাজার কোটি টাকা বাড়তি রাজস্ব আহরণ করা সম্ভব হবে। এ ছাড়া, বিদ্যুত্ সঞ্চালন ব্যবস্থার উন্নয়নে জিএলএস ব্যবস্থায় বিনিয়োগ করা দরকার।