কামারুজ্জামানে মৃত্যু পরোয়ানা কারাগারে

কামারুজ্জামানে মৃত্যু পরোয়ানা কারাগারে

kamruzzzজামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের মৃত্যু পরোয়ানা ও পূর্ণাঙ্গ রায়ের কপি ঢাকা কেন্দ্রীয় করাগারে পৌঁছেছে।

লাল কাপড়ে মোড়ানো মৃত্যু পরোয়ানা ও পূর্ণাঙ্গ রায়ের কপি বৃহস্পতিবার দুপুর দেড়টায় ঢাকা কেন্দ্রীয় করাগারে এসে পৌঁছায়।

ট্রাইব্যুনালে ডেপুটি রেজিস্ট্রার (ভারপ্রাপ্ত) আফতাব উদ্দিন আহমেদ মৃত্যু পরোয়ানাটি কারা কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করেন।

এর আগে দুপুর ১২টা ২০ মিনিটে ট্রাইব্যুনাল-২ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বাধীন বেঞ্চ এ পরোয়ানা জারি করেন।

এর আগে বুধবার মোহাম্মদ কামারুজ্জামানের আপিলের পূর্ণাঙ্গ রায়ের সার্টিফাইড কপি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে পৌঁছে।

বুধবার রাত পৌনে আটটায় ট্রাইব্যুনালে রায়ে রায়ের সার্টিফাইড কপি পৌঁছেছে বলে জানিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার সৈয়দ আমিনুল ইসলাম।

সুপ্রিম কোর্টের সূত্র জানায়, পূর্ণাঙ্গ রায় ৫৭৭ পৃষ্ঠার। রাত আটটার দিকে ট্রাইব্যুনালের রেজিস্ট্রার মো. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, রায়ের কপি এসেছে। মিলিয়ে দেখা হচ্ছে।
অন্যদিকে সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার সৈয়দ আমিনুল ইসলাম বলেন, রাত পৌন আটটার দিকে পূর্ণাঙ্গ রায় ও আনুষঙ্গিক নথিপত্র ট্রাইব্যুনালে পাঠানো হয়েছে।

জামায়াতে ইসলামীর সাবেক নেতা আবদুল কাদের মোল্লার পুনর্বিবেচনার আবেদন নিষ্পত্তি করে দেয়া পূর্ণাঙ্গ রায়ে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ সিদ্ধান্ত দেন, পূর্ণাঙ্গ রায়ের অনুলিপি পাওয়ার ১৫ দিনের মধ্যে আপিল বিভাগের রায় পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন করতে পারবেন দণ্ডিত ব্যক্তি ও রাষ্ট্রপক্ষ। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পুনর্বিবেচনার আবেদন নিষ্পত্তি হবে। আপিল বিভাগের এই সিদ্ধান্ত কামারুজ্জামানের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হবে।

মুক্তিযুদ্ধকালে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনের দায়ে ২০১৩ সালের ৯ মে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ সাতটি অভিযোগের মধ্যে পাঁচটিতে দোষী সাব্যস্ত করে মৃত্যুদণ্ডসহ বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দিয়েছিলেন। ওই পাঁচটি অভিযোগে খালাস চেয়ে আপিল করেছিলেন কামারুজ্জামান। গত বছরের ১৭ সেপ্টেম্বর আপিল শুনানি শেষে রায় অপেক্ষমান (সিএভি) রাখা হয়। একই বছরের ৩ নভেম্বর ওই রায়ের আদেশের অংশটুকু ঘোষণা করা হয়।

একাত্তরে বর্তমান শেরপুর জেলার নালিতাবাড়ী উপজেলার সোহাগপুর গ্রামে গণহত্যা ও মুক্তিযোদ্ধা গোলাম মোস্তফাকে হত্যার দায়ে ট্রাইব্যুনাল-২ কামারুজ্জামানকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন। আপিল বিভাগ আদেশের অংশে সোহাগপুরে গণহত্যার দায়ে কামারুজ্জামানের মৃত্যুদণ্ড সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে বহাল রাখেন। তবে গোলাম মোস্তফা হত্যাকাণ্ডের জন্য তাকে ট্রাইব্যুনালের দেয়া মৃত্যুদণ্ডের শাস্তি কমিয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। ওই রায়ের পূর্ণাঙ্গ বিবরণীতে সই করেন চার বিচারপতি।

এই চার বিচারপতি হলেন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা, বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহহাব মিঞা, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী ও বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী।

মুক্তিযুদ্ধকালে আলবদরের সংগঠক কামারুজ্জামান বর্তমানে জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল। তিনি জামায়াতের দ্বিতীয় সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল, যিনি মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে আপিল বিভাগেও মৃত্যুদণ্ডাদেশ পেয়েছেন। এর আগে জামায়াতের আরেক সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লাকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দিয়েছিলেন আপিল বিভাগ। ২০১৩ সালের ১২ ডিসেম্বর ওই রায় কার্যকর হয়।

মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় এটি আপিল বিভাগের তৃতীয় রায়। কাদের মোল্লাকে মৃত্যুদণ্ডাদেশের পর আপিল বিভাগ জামায়াতের নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেন। ট্রাইব্যুনালের রায়ে তাঁর মৃত্যুদণ্ড হয়েছিল।

চার অভিযোগ চূড়ান্তভাবে প্রমাণিত: কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে প্রথম অভিযোগ, একাত্তরের ২৯ জুন কামারুজ্জামানের নেতৃত্বে আলবদরের সদস্যরা শেরপুরের ঝিনাইগাতি উপজেলার রামনগর গ্রাম থেকে মুক্তিযোদ্ধা বদিউজ্জামানকে অপহরণ করে আহম্মেদনগর সেনাক্যাম্পে নিয়ে সারা রাত নির্যাতন করেন। পরদিন তাঁকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এ অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করে ট্রাইব্যুনাল কামারুজ্জামানকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছিলেন। তবে আপিল বিভাগ কামারুজ্জামানকে সর্বসম্মতিক্রমে খালাস দিয়েছেন।

দ্বিতীয় অভিযোগ: ১৯৭১ সালের মে মাসের মাঝামাঝি একদিন কামারুজ্জামান ও তার সহযোগীরা শেরপুর কলেজের অধ্যক্ষ সৈয়দ আবদুল হান্নানকে প্রায় নগ্ন করে শহরের রাস্তায় হাঁটাতে হাঁটাতে চাবুকপেটা করেন। এ অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় ট্রাইব্যুনাল কামারুজ্জামানকে ১০ বছরের কারাদণ্ড দেন। সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে আপিল বিভাগ এ দণ্ড বহাল রেখেছেন।

তৃতীয় অভিযোগ: ১৯৭১ সালের ২৫ জুলাই কামারুজ্জামানের নেতৃত্বে আলবদর বাহিনী, রাজাকার ও পাকিস্তানি সেনাসদস্যরা শেরপুরের নালিতাবাড়ী উপজেলার সোহাগপুর গ্রামে নির্বিচারে হত্যাকাণ্ড চালায় ও নারী ধর্ষণ করে। ওই বর্বরতার পর থেকে গ্রামটি বিধবাপল্লি নামে পরিচিত। এই অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় ট্রাইব্যুনাল কামারুজ্জামানকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিলেন। আপিল বিভাগ সর্বসম্মতিক্রমে এ অভিযোগে কামারুজ্জামানকে দোষী সাব্যস্ত করেন। তবে সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারপতির মতের ভিত্তিতে তাঁর মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন।

চতুর্থ অভিযোগ: একাত্তরের ২৩ আগস্ট রাতে কামারুজ্জামানের নির্দেশে আলবদরের সদস্যরা শেরপুরের মোস্তফাবাগ থানার গৃদ্দা নারায়ণপুর গ্রামের গোলাম মোস্তফা ও আবুল কাসেমকে সেরিহ সেতুর কাছে নিয়ে গুলি করা হয়। গোলাম মোস্তফা মারা গেলেও আবুল কাসেম নদীতে লাফিয়ে পড়ে প্রাণে বেঁচে যান। এই অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করে ট্রাইব্যুনাল কামারুজ্জামানকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দিয়েছিলেন। আপিল বিভাগ তা কমিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছেন।

সপ্তম অভিযোগ: মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পবিত্র ২৭ রমজান কামারুজ্জামানের নেতৃত্বে আলবদরের সদস্যরা ময়মনসিংহের কোতোয়ালি থানার কাঁচিঝুলি গ্রামের ট্যাপা মিয়া, তার বড় ছেলে জহুরুল ইসলামসহ আরও পাঁচ ব্যক্তিকে ব্রহ্মপুত্র নদের পাড়ে নিয়ে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করেন। তবে এদের মধ্যে ট্যাপা মিয়া নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়লে তাকে গুলি করা হয়। গুলি তার পায়ে লাগে। এ অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করে ট্রাইব্যুনাল কামারুজ্জামানকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন। এ অভিযোগে সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে কামারুজ্জামানের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বহাল রাখেন আপিল আদালত।

পঞ্চম অভিযোগ ও ষষ্ঠ অভিযোগ ছিল যথাক্রমে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পবিত্র রমজান মাসের মাঝামাঝি শেরপুরের চকবাজার এলাকা থেকে মো. লিয়াকত আলী, মুজিবুর রহমানসহ ১০ জনকে আহম্মেদনগর উপজেলা পরিষদ কার্যালয়ের কাছে গুলি করে হত্যা করা এবং একাত্তরের নভেম্বরে টুনু ও জাহাঙ্গীরকে অপহরণ করে ময়মনসিংহের জেলা কাউন্সিল ডাকবাংলোতে নিয়ে নির্যাতন করা হয়। এ দু’টি অভিযোগ থেকে কামারুজ্জামানকে খালাস দিয়েছিলেন ট্রাইব্যুনাল।

রাজধানীর পল্লবী থানায় করা একটি মামলায় ২০১০ সালের ১৩ জুলাই কামারুজ্জামানকে গ্রেফতার করেছিল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। ওই বছরের ২ অক্টোবর তাঁকে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়। ২০১২ সালের ৪ জুন ট্রাইব্যুনাল-২ তাঁর বিরুদ্ধে সাতটি অভিযোগ গঠন করেন।

বাংলাদেশ শীর্ষ খবর