বাংলা সাহিত্যের অপ্রতিদ্বন্দ্বী এক কথাকারের কথা বলছি। কিংবদন্তিতুল্য ব্যক্তিত্ব তিনি। তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে জনপ্রিয়তার শীর্ষে অবস্থান। রসায়নশাস্ত্রে অধ্যাপনা, এন্তার স্বর্ণপ্রসূ লেখালেখি, নাটক-চলচ্চিত্র পরিচালনা, ভেষজ উদ্ভিদ বাগানের উদ্যোক্তা, জাদুশিল্প, দুর্দান্ত আড্ডাবাজি- কতই না বিচিত্র পথের পথিক ৬৩ বছরেরএই তরুণ।
হুমায়ূন আহমেদের জন্মদিন ১৩ নভেম্বর রোববার। প্রতিবছরের মত এবারও ঘটা করে জন্মদিনের উৎসব হতে যাচ্ছে। থাকছে এই লেখকের একক বইমেলার আয়োজন, তাঁর নতুন আত্মজৈবনিক বই ‘রঙ পেনসিল’ এর প্রকাশনা, অনুগল্প ও কবিতাপাঠ, আবৃত্তি ও পথনাটকের মঞ্চায়ন। যার বিবাহ, তিনিই এবার অনুপস্থিত। কর্কট ব্যাধিতে আক্রান্ত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চিকিৎসাধীন। সোঁদা মাটির বাংলাদেশে আয়োজিত এই আসরে জননন্দিত এই কথাশিল্পীরই মধ্যমণি হয়ে থাকার কথা ছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্য যে, তাঁকে এই সময়ে লড়তে হচ্ছে শত্রুব্যাধি ক্যান্সারের সঙ্গে। হুমায়ূন আহমেদের নিজস্ব অদম্য মনোবল, লক্ষ কোটি অনুরাগীর শ্রদ্ধা ভালোবাসা, আকুতি, প্রার্থনার জোর তাঁকে অবশ্যই সুস্থ করে তুলবে, এই আমাদের প্রত্যাশা। তাঁর দীর্ঘ, কর্মবহুল জীবন আমাদের কাম্য।
গত বছরের এই সময়ে তিনি জন্মদিনের উৎসবে অজস্র অনুরাগীকে নিজের বইয়ে অটোগ্রাফ দিয়েছেন। ধুম আড্ডা দিয়েছেন স্বজন সুহৃদদের সঙ্গে। মনে পড়ছে সেই প্রসঙ্গ। জন্মদিনের দু’দিন আগে ১১ নভেম্বর ‘হুমায়ূন আহমেদের প্রকাশকবৃন্দ’ আয়োজিত একক বইমেলা শুরু হয়েছে। প্রথম দিন উৎসবের উদ্বোধনী পর্ব অর্থাৎ বক্তৃতা, বেলুন ওড়ানো শেষ। তারপর তিনি গিয়ে বসলেন বইয়ের স্টলে। যথারীতি সার বেঁধে ক্রেতা পাঠকরা আসছে। তার মধ্যে বাহুল্য বলা, তরুণদেরই আধিক্য। মুখ গুঁজে দ্রুত হাতে অটোগ্রাফ দিয়ে চলেছেন তিনি। তাঁর পাশেই দাঁড়ানো ছিলাম। হালকা পাতলা গড়নের একটি মেয়ে এল অটোগ্রাফ নিতে। মেয়েটি সসংকোচে বললো,
– স্যার আপনাকে একটি প্রশ্ন করতে চাই।
লেখক মুখ তুলে তাকালেন। প্রশ্ন যে করেছে, লক্ষ করলেন তার দিকে। জিগ্যেস করলেন,
– তুমি কি কলেজে পড়ো?
মেয়েটি মনে হয় একটু আহত হলো এই প্রশ্নে। মুখটা গোমড়া করে কিঞ্চিৎ রাগত স্বরে উত্তর দেয় সে,
– আমি অনার্স পড়ি।
– তাই নাকি? কোন সাবজেক্ট?
– ইংরেজি।
– ও আচ্ছা।
মেয়েটি তখন বলে,
– স্যার প্রশ্নটা কি এখন করতে পারি?
হুমায়ূন আহমেদ অত্যন্ত রসিক মানুষ। রঙ্গরসে তাঁর তুলনা মেলা ভার। বলা চলে, তার তুলনা তিনি নিজেই।
চোখেমুখে একটু গাম্ভীর্য ফুটিয়ে তুললেন। তারপর নিরাসক্ত ভঙ্গিতে বললেন,
– তা করতে পারো। তবে প্রশ্ন কিন্তু ইংরেজিতে করা চলবে না। ঠিক আছে?
মেয়েটি কী একটু থতমত খায়? হবেও বা। আপাতদৃষ্টে সে কিছুটা অপ্রস্তুত বলেই মনে হয়। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই সামলে ওঠে মেয়েটি। তারপর প্রশ্নটি করে। সে জানতে চায়,
– পৃথিবীতে সবচেয়ে সহজ কাজ কোনটি বলুন তো?
লেখক এরকম প্রশ্ন শুনে একটুও চমকান না। চটজলদি উত্তর দিয়ে দেন তিনি। মনে হয়, এমনধারা প্রশ্নের উত্তর দেয়ার জন্যে যেন আগে থেকেই তৈরি ছিলেন। কিংবা এমন প্রশ্ন বহুবার শুনেছেন জীবনে। মৃদু কণ্ঠে বলেন,
– ঘুম। ঘুমই হচ্ছে পৃথিবীতে সবচেয়ে সহজ কাজ।
মেয়েটি কতটা সন্তুষ্ট হলো, সেটা বোঝা গেল না। সে পাল্টা কোনো প্রশ্ন করেনি। লেখকের পাশেই ছিলেন তাঁর স্ত্রী মেহের আফরোজ শাওন। তিনি মন্তব্য করলেন,
– যাদের ইনসমনিয়া (অনিদ্রা রোগ) আছে, তাদের বেলায়ও কী একথা প্রযোজ্য হবে?
পাশেই ছিলেন অন্যপ্রকাশের কমল। তিনি জবাব দিলেন এই প্রশ্নের। কমল জানালেন,
– সেটা তো ভাবী ব্যতিক্রম।
হুমায়ূন আহমেদ যেমন মজা করে লেখেন, তেমনি কথাও বলেন মজা করে। মানুষ মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শোনে। শুনতে বাধ্য হয়। পাঠক তার লেখা পড়তে গিয়ে চুম্বকের মত আটকে যায়। বই একবার পড়তে শুরু করলে শেষ না করা তক শান্তি নেই। সহজ ভাষায়, সাবলীল ভঙ্গিতে তিনি অত্যন্ত সরস করে যে কোনো বিষয় উপস্থাপন করতে জানেন। মনস্তত্ত্বও তিনি বোঝেন চমৎকার। মাটি থেকে উঠে আসে তাঁর যাবতীয় কাহিনী, গল্প, সংলাপ। অকৃত্রিম। যা-ই লেখেন, তা থাকে নাটকীয়তায় চমকে ভরপুর। মানুষের আবেগকে গভীর মমতায় তিনি স্পর্শ করতে জানেন। হয়তো এখানেই তাঁর অভূতপূর্ব জনপ্রিয়তার যে রহস্য, তার গোপন চাবিকাঠি লুকানো। বিশ্বজুড়ে ছড়ানো তাঁর বিপুলসংখ্যক পাঠকের মধ্যে তরুণরাই সিংহভাগ, সন্দেহ নেই। তবে শিশু-কিশোর, বয়স্করাও তাঁর পাঠক। যারা বইমনস্ক নন, ছিলেন না, তাদেরও বইয়ের দিকে টেনে এনেছেন হুমায়ূন আহমেদ। এই চ্যালেঞ্জকে কেউ হিমালয়ান টাস্কও বলতে পারেন। অবলীলায়, স্বচ্ছন্দে, একক দায়িত্বে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেছেন তিনি। হয়েছেন আশ্চর্য সফল। জনপ্রিয়তার শীর্ষে অবস্থান করছেন দীর্ঘকাল ধরে। এখনও পর্যন্ত অপ্রতিদ্বন্দ্বী তিনি। স্কাই ইজ দ্য লিমিট। বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে তাঁর গ্রন্থাদি। সেই পর্ব বিস্তারিত হয়ে চলেছে ক্রমশ। এক হিসাবে তিনি বাংলা সাহিত্যকে, লাল সবুজ পতাকার বাংলাদেশকে বহির্বিশ্বে পরিচিত, সম্মানিত করে তুলেছেন। তুলছেন। সমকালীন বাংলাসাহিত্যের প্রচণ্ড সফল এক রাষ্ট্রদূতও তাঁকে বলতে পারি আমরা।
নিজের সন্তানদের নিয়ে অসম্ভব গর্বিত এই লেখক। সে এক অনন্য অহঙ্কার তাঁর। গত বছর এক ঘরোয়া সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম বরেণ্য এই লেখকের। ৬২তম জন্মদিনের আগে আগে। জানতে চেয়েছিলাম, মানুষ হিসেবে আপনার জীবনের সবচেয়ে বড় অর্জন কি বলে আপনি মনে করেন? উত্তর দিতে সময় নেননি। মৃদু হেসে বললেন, আমার ছেলেমেয়েরা। লেখালেখি না। দুটো তো এখনো বেশ ছোট। যারা বড় হয়েছে, তারা প্রত্যেকে মেধাবী। অতি ভালো মানুষ। দুই মেয়ে পিএইচডি করেছে। চোখের সামনে তারা ভালো মানুষ হিসেবে বড় হয়েছে। বাবা হিসেবে এটা আমার অনেক বড় পাওয়া। আমি বিশাল লেখক হয়ে গেলাম, আর ছেলেমেয়েরা ড্রাগস নিয়ে পড়ে থাকলো–এটা তো হতে পারে না!
তাঁর বড় মেয়ে নোভার বিয়ে হয়েছিল বেশ ঘটা করে। বিডিআরের দরবার হলে ছিল বিয়ের অনুষ্ঠান।কবি-কথাশিল্পী সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় যোগ দিয়েছিলেন সেই বিয়েতে। শুধু বিয়েতে অংশ নেয়ার জন্যেই সেবার এসেছিলেন বাংলাদেশে। বিবাহ উৎসবে আমিও নিমন্ত্রিত ছিলাম। কিন্তু যোগ দিতে পারিনি। বিয়ের কিছুদিন পরে দেখা হুমায়ূন ভাইয়ের সঙ্গে। মার্জনা চেয়ে বললাম, স্যরি আপনার মেয়ের বিয়েতে যেতে পারিনি। স্বভাবরসিক তিনি। এই বিষয়টা নিয়েও রঙ্গ করতে পিছপা হলেন না। তেমন পাত্রই তিনি নন। ঝটপট জবাব দিলেন,
– কোনো সমস্যা নাই। যেতে পারেন নি তো কি হয়েছে? আমার মেয়ে আরো আছে। বিয়ে আরো হবে।
তিনি একাই এক শ’। তাঁর দীর্ঘজীবন, সুস্বাস্থ্য শুধু তাঁর নিজের জন্য না, জাতির জন্যেও প্রয়োজন। ভীষণ প্রয়োজন। বাংলাদেশের মত দেশে, যেখানে বইবিমুখতা জাতির মজ্জাগত একটি ব্যাপার (লজ্জারও বটে!), সেখানে তিনি চমৎকার এক বিপ্লব ঘটিয়েছেন। বইমুখী করেছেন তরুণদের। এ এক বিশাল ও মহৎ অর্জন। এই একুশের বইমেলা এক সময় এদেশে ছিল না। ভাষা শহীদদের স্মৃতিজড়ানো মাসে এত বিপুলসংখ্যক সৃষ্টিশীল গ্রন্থ প্রকাশের রেওয়াজও ছিল না। এখন, ভাবা যায়, বইমেলায় ঢুকতে হলে লাইনে দাঁড়াতে হয়। কোটি টাকার ঘরে গিয়ে পৌঁছায় বিক্রি বাণিজ্য। ভোগ্যপণ্যপ্রধান বর্তমান জীবনে বইয়ের মত পণ্য, তার এত্ত কাটতি? হুমায়ূন আহমেদের বই কেনার জন্যে দুর্ধর্ষ কাড়াকাড়ি সাংবাৎসরিক ঘটনা। তাঁর নতুন কোনো বইয়ের দশ বিশটা মুদ্রণ হওয়া নিতান্ত মামুলি ব্যাপার। এক ফেব্রুয়ারি মাসেই লাখের ঘর (কপি হিসেবে) ছুঁয়ে ফেলে বইয়ের বিক্রি। এই যে ক্রেজ, তা কিন্তু শুধু রাজধানী ঢাকাতেই সীমাবদ্ধ না। সারা দেশে তাঁর বই পড়বার জন্যে পাঠকদের আকুলি বিকুলি। প্রবাসী বাংলাদেশিরাও তাঁর বইয়ের জন্যে পাগলপারা। তাঁর নাটক, সিনেমা দেখতে উন্মুখ। তিনি একুশের বইমেলায় গেলে যে প্রচণ্ড ভিড় হয়, তা নিজের চোখে না দেখলে কেউ বিশ্বাস করতে চাইবেন না। ভিড় এমনই যে, তা সামাল দিতে পুলিশকে পর্যন্ত হিমশিম খেতে হয়। সে এক দেখার মতন কাণ্ড!
নতুন নতুন প্রকাশকও তিনি তৈরি করেছেন। তাদের সঙ্গে তাঁর সখ্য, মিতালিও অনেক অনেক আন্তরিক। নতুন প্রকাশকদের সম্পর্কে তাঁর নিজস্ব চিন্তাভাবনা কেমন, তা জানবার জন্যে আমরা তাঁর বক্তব্যের শরণাপন্ন হতে চাই।
১৯৯৪ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি দৈনিকবাংলার বিশেষ সংখ্যায় তিনি লিখছেন:
“…প্রকাশকদের কথা বলা হচ্ছে, হ্যাঁ আমাকে দিয়ে তাঁদের কিছু স্বার্থসিদ্ধি তো হবেই। কিন্তু একটা ব্যাপার ভুললে চলবে না। এঁরা আমার যতটা নির্ভরশীল আমি তাঁদের উপর অনেক বেশি নির্ভরশীল। আমার লেখা এদেশের প্রতিটি আনাচে কানাচে পৌঁছে দিচ্ছেন তাঁরাই। আজকের এই বইমেলার বিশাল আয়োজনের নেপথ্য নায়ক এঁরাই। পাঁচ বছর আগের বইমেলার সর্বাধিক বিক্রীত একটি গ্রন্থের বিক্রয় সংখ্যা ছিল সাত শ’। আজ একজন নবীন লেখকের লেখাও মেলার প্রথম দশদিনে এক হাজার কপির বেশি বিক্রি হয়।
মানুষকে গ্রন্থের প্রতি আগ্রহী করার প্রধান ভূমিকা এই প্রকাশকদের। এঁরা ব্যবসায়ী। একজন ব্যবসায়ী লাভ-লোকসান দেখবেন। কিন্তু আমরা ভুলে যাই যে, এঁরা লাভ-লোকসান বিবেচনা করে চিনি বা পেঁয়াজের ব্যবসায় যাননি। এসেছেন বই-এর ব্যবসায়, যার কোন স্থিরতা নেই। এঁদের যুদ্ধ করতে হচ্ছে পাশের দেশের শক্তিমান প্রকাশকদের সঙ্গে। যাদের আছে দীর্ঘদিনের প্রকাশনার অভিজ্ঞতা।
আমার বই-এর যাঁরা প্রকাশক, তাঁরা সবাই অল্পবয়স্ক। কারো বয়সই আমার চেয়ে বেশি নয়। প্রতিষ্ঠিত পুরনো প্রকাশকরা আমার প্রতি আগ্রহী হননি। আগ্রহী হয়েছেন তরুণ প্রকাশকরা আজ আমাদের প্রকাশনা শিল্পের যে জয়জয়কার, তা তাঁদের উদ্যম এবং কর্মপ্রচেষ্টার সোনালী ফসল।”