বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দিয়ে বিমানকে লোকসানের হাত থেকে বাঁচানোর দাবিতে আন্দোলনে উত্তাল হয়ে উঠেছেন বিমানকর্মীরা। তারা পর্ষদের চেয়ারম্যান জামালউদ্দিনের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তুলেছেন জোরেসোরে, অবিলম্বে তার অপসারণও দাবি করেছেন।
প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে নীতিনির্ধারক পর্যায়ের অনেকেই বিমান পর্ষদের ওপর নাখোশ। বিমানের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালককে অনেকের সামনেই বিষয়টি জানিয়ে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। এবার শ্রমিক-কর্মচারীদের আন্দোলনের মাধ্যমে তা চাঙ্গা হয়ে উঠেছে।
আর যেহেতু বিমানের পরিচালনা পর্ষদের বিরুদ্ধে সরকারি দলের সমর্থিত সিবিএ নেতারা আন্দোলনে নেমেছেন, তাই পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, এ আন্দোলনে সরকারের উচ্চ পর্যায়ের সমর্থন রয়েছে।
বিমান শ্রমিক লীগের একটি সূত্র থেকে জানা গেছে, আন্দোলনের জন্য তারা সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে গ্রিন সিগন্যাল পেয়ে গেছেন। এখন যদি দুর্নীতিবাজরা সরে না দাঁড়ায়, তাহলে প্রয়োজনে বিমানে তাদের অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হবে। একই সঙ্গে দুর্নীতিবাজদের দুর্নীতির শ্বেতপত্র তৈরি করা হবে। এরই মধ্যে তা শুরু করা হয়েছে। কে কোন খাতে কত টাকা লুটপাট করেছে, কত টাকার কমিশন বাণিজ্য করেছে তা বের করার জন্য বিভিন্ন শাখায় কাজ চলছে।
বিমানের নির্বাচিত কর্মচারী ইউনিয়নের (সিবিএ) দাবি, এই পরিচালনা পর্ষদ অযোগ্য, দুর্নীতিবাজ ও ব্যর্থ। তারা যেভাবে বিমানকে চালাচ্ছেন, তাতে আগামী দুই বছরে আরো হাজার হাজার কোটি টাকা লোকসান দিতে হবে। তাই ৭ মার্চের মধ্যে তারা সরকারি কর্তৃত্বে দক্ষ ও এভিয়েশন জ্ঞানসম্পন্ন নতুন পর্ষদ গঠনের দাবি জানিয়েছেন।
দাবি না মানা হলে ৮ মার্চ তারা বলাকার সামনে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করবেন বলেও ঘোষণা দিয়েছেন।
বিমানের নির্বাচিত কর্মচারী ইউনিয়নের (সিবিএ) ডাকে সোমবার বিমানের প্রধান কার্যালয় বলাকা ভবনের সামনে এয়ারলাইন্সের শত শত শ্রমিক-কর্মচারীর বিক্ষোভ-সমাবেশে নেতারা এ ঘোষণা দেন।
সমাবেশে বিমান কর্মচারী ইউনিয়নের সভাপতি ও বিমান শ্রমিক লীগের সভাপতি মশিকুর রহমান বলেন, ‘বর্তমান পরিচালনা পর্ষদ ব্যর্থ। তারা বিগত তিন বছরে এক হাজার কোটি টাকা লোকসান দিয়েছেন। তারা যেভাবে বিমানকে চালাচ্ছেন, তাতে আগামী দুই বছরে আরো হাজার হাজার কোটি টাকা লোকসান দেবে প্রতিষ্ঠানটি। অবিলম্বে এই পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান জামালউদ্দিন আহমেদসহ সব সদস্যকে বিদায় করে দক্ষ, পেশাদার ও বিমান চলাচল ব্যবসায় বিশেষজ্ঞদের দিয়ে নতুন পর্ষদ গঠন করতে হবে।’
মশিকুর রহমান বলেন, ‘বিমান বাঁচলে আমরা বাঁচবো। কিন্তু এই পরিচালনা পর্ষদ থাকলে বিমান বাঁচবে না। কারণ, তারা কোনো দায়-দায়িত্ব নেয় না। জনগণের কাছে এই বোর্ডের কোনো জবাবদিহিতা নেই। তাই আগামী ৭ মার্চের মধ্যে সরকারি কর্তৃত্বে নতুন পর্ষদ গঠন করা হোক।’
তিনি অভিযোগ করেন, বিমানের নিজস্ব টাকায় কেনা এয়ারবাস এক মাস ধরে সিঙ্গাপুরে পড়ে আছে। কিন্তু সেটি মেরামতের কোনো উদ্যোগ না নিয়ে বোর্ড আবারও ভাড়ায় প্লেন আনার উদ্যোগ নিচ্ছে।
তিনি আরো বলেন, ‘বিমানে এখন রীতিমতো লুটপাট চলছে। গত তিন বছরে ১১ সদস্যের এই পরিচালনা পর্ষদ ৯১টি বোর্ডসভা করেছে। এসব সভার ফল হচ্ছে বিমানের হাজার কোটি লোকসান আর তাদের লাভ।’
পরিচালনা পর্ষদের সদস্যদের কারণে বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ সব কর্মকর্তা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারেন না। বিমানের এমডিকে স্বাধীনভাবে কোনো কাজ করতে দিচ্ছে না ব্যর্থ বোর্ড। সব কাজেই অহেতুক হস্তক্ষেপ করা হচ্ছে বলে তিনি অভিযোগ করেন।
সমাবেশ থেকে বিমান শ্রমিক লীগের সাধারণ সম্পাদক মুনতাসির রহমান জানান, ৭ মার্চের মধ্যে তাদের দাবি-দাওয়া মেনে নেওয়া না হলে ৮ মার্চ তারা বলাকা ভবনের সামনে থেকে বিমানের হ্যাঙ্গার গেট পর্যন্ত মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করবেন।
তিনি বলেন, ‘বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যে দাবি মানা না হলে পর্যায়ক্রমে লাগাতার আন্দোলন করে দাবি আদায় করা হবে।’
বলাকা সূত্রে জানা গেছে, শ্রমিকদের প্রয়োজন ও গুরুত্ব অনুযায়ী বিমান কর্তৃপক্ষের কাছে ২৮ দফা দাবি জানান সিবিএর নব নির্বাচিত কমিটি। কমিটির অভিষেক অনুষ্ঠানে বিমানমন্ত্রী ফারুক খান প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিলেও কোনো কাজ হয়নি। এরপর ২০ ফেব্রুয়ারি সিবিএ নেতারা তাদের দাবি কমিয়ে ছয় দফা করে বোর্ডে পাঠায় এবং ২৯ ফেব্রুয়ারির মধ্যে তা বাস্তবায়নে আলটিমেটাম দেয়। কিন্তু পরিচালনা পর্ষদ তাদের কোনো দাবিই আমলে নেয়নি।
বিমানকর্মীদের ছয় দফা দাবির মধ্যে আছে-ক্যাজুয়াল কর্মচারীদের চাকরি স্থায়ীকরণ, বেতন কাঠামোতে পিপি পরিবর্তন, টাকার বদলে ইউনিফর্ম সরবরাহ করা, মিল অ্যালাউন্স ৫০ টাকা থেকে বাড়িয়ে দেড় শ’ টাকা করা ও গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং রক্ষা করা।
শ্রমিক লীগ সূত্র জানায়, পেশাদারিত্ব না থাকায় গত তিন বছরে এক হাজার কোটি টাকা লোকসান দিয়েছে বিমান। কিন্তু বিমান প্রকাশ্যে তা বলছে না।
রক্ষণাবেক্ষণের নামে বিদেশে মাসের পর মাস উড়োজাহাজ বসিয়ে রেখে কোটি কোটি টাকা হরিলুট করছে। বিমানে বর্তমানে ৩৩৮টি মামলা ঝুলে আছে। বিমান কর্তৃপক্ষ কর্মচারী-কর্মকর্তাদের সমস্যার সমাধান না করে বাধ্য করে মামলায় যেতে। এর ফলে বিমানে গত তিন বছরে প্রায় চার কোটি টাকা লোকসান হয়েছে। এ ছাড়া ওই সময়ে ৯১টি পরিচালনা পর্ষদের প্রতিটি বৈঠকে এক লাখ টাকা করে খরচ হয়েছে, যা বিমানের লোকসানের কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, গত সেপ্টেম্বরে বিমানের চেয়ারম্যান এয়ার মার্শাল (অব.) জামালউদ্দিন আহমেদকে অপসারণের প্রস্তাব প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠানো হয়। জিএম কাদের তখন বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটনমন্ত্রী ছিলেন। প্রধানমন্ত্রী তখন যুক্তরাষ্ট্র সফরে ছিলেন। দেশে ফিরে এ ব্যাপারে তার সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা থাকলেও কোনো সিদ্ধান্ত নেননি।
এর আগে বিমান পরিচালনার কর্তৃত্ব মন্ত্রণালয়ের কাছে ফেরত চেয়ে বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো প্রস্তাব প্রধানমন্ত্রী নাকচ করে দেন।
বিমানের সিবিএ নেতারা জানিয়েছেন, বোর্ডের কতিপয় সদস্য এখন বাংলাদেশ পাইলট অ্যাসোসিয়েশনকে (বাপা) কাছে টানার চেষ্টা করছে। যদি বাপার কোন কর্মকর্তা দুর্নীতির পক্ষে অবস্থান নেয়, তাহলে কোনো পাইলটকে শাহজালাল বিমানবন্দরে প্রবেশ করতে দেওয়া হবে না।