ধর্মীয় বিষয়ে ফতোয়া দিতে পারবেন শিক্ষিতরা

ধর্মীয় বিষয়ে ফতোয়া দিতে পারবেন শিক্ষিতরা

raiধর্মীয় বিষয়ে শিক্ষিত ব্যক্তিরা শুধু ফতোয়া দিতে পারবেন। যা স্বেচ্ছায় গ্রহণ করা যাবে। কিন্তু কোনো অবস্থাতেই তা গ্রহণে কাউকে কোনো রকমের বল প্রয়োগ বা অনুচিত প্রভাব প্রয়োগ করা যাবে না। কোনো ব্যক্তির অধিকার, মর্যাদা বা সম্মান (যা দেশের আইনে গণ্ডির আওতায় আসে) বিনষ্ট করে এমন কোনো বিষয়েও ফতোয়া দেওয়া যাবে না। এ ছাড়া ফতোয়া ব্যবহার করে কোনো ধরনের শারীরিক বা মানসিক নির্যাতনও কোনো ব্যক্তির ওপর আরোপ করা যাবে না।

ফতোয়া নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের দেওয়া পূর্ণাঙ্গ রায়ে এসব কথা বলা হয়েছে। ২০১১ সালের ১২ মে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল
হকের নেতৃত্বাধীন ছয় সদস্যের আপিল বিভাগ সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে সংক্ষিপ্ত রায় ঘোষণা করেছিলেন। প্রায় পৌনে চার বছর অপেক্ষার পর গতকাল রোববার ‘ফতোয়া’ নিয়ে আপিল বিভাগ ঘোষিত চূড়ান্ত ওই রায় লেখা শেষে বিচারপতিদের স্বাক্ষরসহ জনসাধারণের জন্য প্রকাশ করা হয়।
বেঞ্চের অন্য বিচারপতিরা হলেন_ বিচারপতি (সাবেক প্রধান বিচারপতি) মো. মোজাম্মেল হোসেন, বিচারপতি (বর্তমান প্রধান বিচাপতি) এস কে সিনহা, বিচারপতি আবদুল ওয়াহহাব মিঞা, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ও বিচারপতি মো. ইমান আলী। ১৩৮ পৃষ্ঠার রায়ে ফতোয়া কারা দিতে পারবে, ফতোয়ার প্রেক্ষাপট ও পর্যবেক্ষণসহ বিচারপতিদের মতামত তুলে ধরা হয়েছে।
সংখ্যগারিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে দেওয়া এ রায় লিখেছেন আপিল বিভাগের বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন। এর সঙ্গে একমত পোষণ করেছেন বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক, সাবেক প্রধান বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেন, বর্তমান প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা ও বিচারপতি মো. ইমান আলী। রায়ের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করে অভিমত দিয়েছেন বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহহাব মিঞা। গতকাল সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে পূর্ণাঙ্গ এ রায় প্রকাশিত হয়।
বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক রায়ে লিখেছেন, একজন মুফতি, মাওলানা অথবা ইমাম ফতোয়া ঘোষণা করতে পারেন, যদি তাকে অনুরোধ করা হয়। কিন্তু তিনি দেশের কোনো আইন ভঙ্গ করতে পারেন না। একই সঙ্গে তাকে অন্যদের ফতোয়া বা মতামতের ব্যাপারেও শ্রদ্ধাশীল থাকতে হবে।
বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহহাব মিঞা তার অভিমতে বলেছেন, হাইকোর্ট বিভাগ সংবিধানের ১০২ অনুচ্ছেদের আওতায় স্বপ্রণোদিত হয়ে রুল ইস্যু করতে পারে বলে রায়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারপতির যে অভিমত দিয়েছেন তার সঙ্গে আমি একমত নই।
সুপ্রিম কোর্ট সূত্রে জানা গেছে, সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক গত ৬ নভেম্বর ফতোয়া নিয়ে রায়ে তার অংশবিশেষ লেখা শেষ করে আপিল বিভাগে জমা দেন। এর আগে ৪ নভেম্বর তার কাছে (খায়রুল হক) অপর পাঁচ বিচারপতির লেখা রায়ের অংশবিশেষসহ খসড়াটি পাঠানো হয়েছিল। জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্টের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার এসএম কুদ্দুস জামান সমকালকে বলেন, ‘ফতোয়ার রায়টি জনসাধারণের জন্য প্রকাশ করা হয়েছে।
২০০০ সালের ২ ডিসেম্বর একটি জাতীয় দৈনিকে ফতোয়া সংক্রান্ত একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়। এতে বলা হয়, নওগাঁ জেলার সদর উপজেলার কীর্তিপুর ইউনিয়নের আতিথা গ্রামের এক গৃহবধূকে ফতোয়া দিয়ে হিল্লা বিয়ে দিতে বাধ্য করা হয়। বিষয়টি নজরে এলে হাইকোর্ট স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে রুল জারি করেন। রুলের চূড়ান্ত শুনানি শেষে ২০০১ সালের ১ জানুয়ারি বিচারপতি গোলাম রাব্বানী ও বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা নেতৃত্বাধীন তৎকালীন হাইকোর্ট বেঞ্চ সব ধরনের ফতোয়াকে অবৈধ বলে রায় দেন। রায়ে বলা হয়, একমাত্র আদালতই মুসলিম বা অন্য কোনো আইন অনুযায়ী আইনসংক্রান্ত কোনো মতামত দিতে পারেন। কেউ ফতোয়া দিলে তা ফৌজদারি কার্যবিধির ১৯০ ধারা অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য হবে। ওই রায়ের বিরুদ্ধে মুফতি মো. তৈয়ব এবং মাওলানা আবুল কালাম আজাদ আপিল করেন। এরপর আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) ও নারীনেত্রী মালেকা বেগমসহ অন্যরা মামলায় পক্ষভুক্ত হন। ১০ বছর পর অর্থাৎ ২০১১ সালের ১ মার্চ আপিলের শুনানি শুরু হয়। শুনানিতে অ্যামিকাস কিউরি হিসেবে পাঁচ জন আলেমসহ নয়জন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী বক্তব্য রাখেন। এরপর ওই বছরের ১২ মে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হকের নেতৃত্বাধীন ছয় সদস্যের আপিল বিভাগ সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে সংক্ষিপ্ত রায় ঘোষণা করেন।
মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের প্রতিবেদন অনুযায়ী গত চার বছরে ফতোয়ার মাধ্যমে নারী নির্যাতনের প্রায় দুইশ’ ঘটনা ঘটেছে। ফতোয়ার কারণে অনেকে আত্মহত্যার পথও বেছে নিয়েছেন। এর মধ্যে ২০১৩ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ফতোয়ার নামে নারীর প্রতি সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে ২১টি। ২০১২ সালে এ সংখ্যা ছিল ৪৮। ২০১১ সালে সালিশ ও ফতোয়ার মাধ্যমে নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটে ৫৯টি।

বাংলাদেশ শীর্ষ খবর