রাজনীতিতে পারসেপশন বা আমজনতার মনের মধ্যে তৈরি হওয়া ধারণা বড় ভয়ঙ্কর এক ঘটনা।
পৃথিবীর ইতিহাসে রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে তাদের জীবনযাত্রার বহু অনুষঙ্গ যেমন যুক্ত হয়ে থাকে, তেমনই তাদের সম্পর্কে মানুষের যে ধারণা তৈরি হয়, তার বৃত্তে সেই নেতা অনেক সময় নিজেই বন্দি হয়ে যান। সেই ধারণায় যখন আঘাত লাগে, যখন সেই জনমতের বার্লিন প্রাচীর ভেঙে যায়, তখন সৃষ্টি হয় এক নতুন মহাভারত। চার্চিলকে যেমন তার চুরুট ছাড়া ভাবা যায় না, ঠিক সে ভাবেই আমাদের প্রমোদ দাশগুপ্ত ও অতুল্য ঘোষকেও ভাবা যায় না। এগুলি রাজনৈতিক চরিত্রের অনুষঙ্গ, যেমন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নীল হাওয়াই চটি!
আচ্ছা বলুন তো, ১৯৮৪ সালের ‘মিস্টার ক্লিন’ রাজীব গান্ধী কী ভাবে তিন-চার বছরের মাথায় ‘বফর্স গান্ধী’তে পরিণত হয়েছিলেন? রাজীব গান্ধী যে বফর্স কেলেঙ্কারিতে যুক্ত ছিলেন, এমনটা কিন্তু আজও প্রমাণিত হয়নি। উল্টো, মৃত্যুর আগে বিশ্বনাথপ্রতাপ সিংহ তো বফর্স নিয়ে সোনিয়া গান্ধীর কাছে কার্যত দুঃখপ্রকাশ করেন। অথচ ভারতের একটি লোকসভা নির্বাচন তো বফর্স নামক একটি শব্দতেই হয়ে গিয়েছে।
ভারতের পশ্চিমবঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাবমূর্তি ছিল ঠিক এমনই নিষ্কলুষ। তিনি রাজ্যে আমজনতার প্রতিনিধি। পায়ে নীল হাওয়াই চটি। সুতির অতি সাধারণ শাড়ি। ভোগ-বিলাস ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে পশ্চিমবঙ্গে মমতা ছিলেন সততা ও নির্ভীকতার প্রতীক। ৩৪ বছরের যে দীর্ঘ সিপিএম শাসন, সে শাসনেও দুর্নীতির ঘুণ ধরেছিল। মমতা সেই ঘুণ ধরা ব্যবস্থার বিরুদ্ধে ছিলেন এক জীবন্ত জিহাদ।
তিন বছর ক্ষমতায় থাকার পর এখন সেই মমতার সরকার সম্পর্কে অভিযোগের তর্জনী উঠেছে। মূলত সারদা কেলেঙ্কারির সিবিআই তদন্তে রাজ্যের কতিপয় নেতা, মন্ত্রী ও সাংসদকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তৃণমূলের এই নেতাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠায় বিজেপি রাজ্য জুড়ে প্রচার শুরু করেছে যে মমতার সরকারও ভ্রষ্ট। জ্যোতি বসুর আমলে তার পুত্র চন্দন বসুকে ঘিরে অনেক অভিযোগ উঠেছিল। বেঙ্গল ল্যাম্প কেলেঙ্কারির কথা আমরা ভুলিনি। অভিযোগ ওঠে, পূর্ত দফতর বেআইনি ভাবে চন্দন বসুর ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীদের সুযোগ পাইয়ে দিয়েছে। কিন্তু তখন জ্যোতি বসু কী করেছিলেন? যতীন চক্রবর্তীকেই মন্ত্রিসভা থেকে ইস্তফা দিতে বাধ্য করেছিলেন জ্যোতিবাবু। সেই দুর্নীতির জন্য জ্যোতি বসু নিজেকে দূরে রেখেছিলেন এবং বলির পাঁঠা হন যতীন চক্রবর্তী।
সারদা কেলেঙ্কারি নিয়ে সিবিআই যখন অভিযোগের তর্জনী উত্থাপন করে তখন মমতা জ্যোতিবাবুর স্টাইলে চলেননি। মমতা উল্টো মদন মিত্র থেকে মুকুল রায়দের পক্ষ নিয়েছেন প্রকাশ্যেই। উল্টে রাজ্য সরকার যে ভাবে সিবিআইয়ের বিরুদ্ধে মামলা করছে তাতে বোঝা যাচ্ছে, মমতা কিন্তু জ্যোতিবাবুর মতো নিজেকে অন্যদের থেকে আলাদা করে বাঁচানোর রাজনীতি করছেন না। কেউ কেউ বলছেন, মমতা এটা করছেন না পাছে মুকুল, মদন সরাসরি তার বিরুদ্ধেই পাল্টা কুৎসা করার সুযোগ পান।
অটলবিহারী বাজপেয়ীও গোধরা কাণ্ডের পর যখন নিজেকে মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির কাছ থেকে দূরে সরিয়ে রাখার রাজনীতি করেন, তখন লালকৃষ্ণ আদবানি প্রকাশ্যে মোদীর পক্ষে অবস্থান নেন। তবে সে ছিল সাম্প্রদায়িকতার বিষয়। দুর্নীতি নয়।
পশ্চিমবঙ্গের মানুষ আজও অনেকেই মনে করেন, মমতা ব্যক্তিগত ভাবে সত্। তৃণমূল নেতারা বলছেন, গোয়েবল্সের কায়দায় এখন মমতার বিরুদ্ধে অপপ্রচার হচ্ছে। একসময় সিপিএম জ্যোতিবাবু বিরোধী প্রচার সম্পর্কেও এই কথাই বলতেন।
আমি কিন্তু অন্য কথা বলছি। আমি বলছি, পারসেপশনের কথা। সত্য কী, তা তদন্তের বিষয়। কিন্তু মানুষের মনে কী ধারণা তৈরি হচ্ছে সেটাও কিন্তু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। শুধু সত্ হলেই চলে না, সত্ বলে রাজনৈতিক নেতাদের বা দলকে প্রতিভাতও হতে হয়। গত তিন বছরে এই ধারণায় যে একটা চিড় ধরেছে মমতা-সরকার সম্পর্কে, এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই।
জয়ন্ত ঘোষাল: নয়া দিল্লি ব্যুরো চিফ, আনন্দবাজার পত্রিকা