পরিবেশ ও বন মন্ত্রী এবং জাতীয় পার্টির (জেপি) চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন মঞ্জু বলেছেন, পরবর্তী প্রজন্মকে নতুন পৃথিবীর সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হলে তথ্য প্রযুক্তি জ্ঞানে তাদের সমৃদ্ধ করে তুলতে হবে। নতুন প্রজন্ম যে আমাদের চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন মন মানসিকতায় বেড়ে উঠছে তার প্রতি বিশেষ মনোযোগ দেয়া প্রয়োজন। দেশে যে পরিবর্তনের ধারা বহমান সেদিকে বর্তমান সরকার যেমন অগ্রাধিকার প্রদান করেছে তেমনি তা কার্যকর করতে সকলকে একযোগে কাজ করতে হবে। ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণ এবং সরকারের রূপকল্প-২০২১ বাস্তবায়নে জনগণের দোরগোড়ায় সেবা প্রদানের গৃহীত পদক্ষেপসমূহ তুলে ধরতে পিরোজপুরে আয়োজিত তিন দিনব্যাপী “ডিজিটাল উদ্ভাবনী মেলা-২০১৫” উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ কথা বলেন। আনোয়ার হোসেন মঞ্জু বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বর্তমান সরকারের প্রধানতম সাফল্য ডিজিটাল পদ্ধতির ব্যাপক প্রসার। তিনি চান পৃথিবীর সাথে সাথে আমাদেরও গতি বাড়াতে হবে। আন্তর্জাতিক সাব মেরিন ক্যাবল নেটওয়ার্কের সাথে বাংলাদেশ সংযুক্ত হয়েছে। অনেক দিন আগে বাংলাদেশ ডিজিটাল যুগে ঢুকতে পেরেছে সত্য। কিন্তু পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি মোবাইল ফোন ব্যবহারকারী হিসাবে অধুনা আমাদের দেশ পরিচিতি পেয়েছে। মোবাইল ফোন ক্রমান্বয় আমাদের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অনুসঙ্গ হয়ে গেছে। তথ্য প্রযুক্তির আনুষ্ঠানিক ব্যবহার শুরু করতে আমরা সক্ষম হওয়ায় দেরিতে হলেও অন্যান্য দেশের পাশাপাশি নতুন প্রজন্ম আধুনিক জ্ঞানের জগতে প্রবেশ করতে সুযোগ পাচ্ছে। নতুন প্রজন্ম দেশের প্রচলিত রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত নয়। টাইম ইজ মানি-এই ধারণা নতুনদের আকৃষ্ট করছে। তথ্য প্রযুক্তি জ্ঞানকে আয়ত্ত করে নিম্ন আয়-স্বল্প আয় এই চিন্তা থেকে বেরিয়ে এসে আউট সোর্সিং এর মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার পথে নতুনদের আগ্রহ বাড়ছে। এটাই উন্নয়নের সূচক, যার সাথে আমাদের রাজনীতিবিদদের চিন্তা-চেতনার ব্যবধান লক্ষণীয়। তথাকথিত রাজনীতিবিদরা উত্খাত-মোকাবেলা, জ্বালাও-পোড়াও প্রতিহত করা ইত্যাদি প্রথা সিদ্ধ যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি চর্চা করে চলেছেন তা নতুন প্রজন্মের ডিজিটাল উন্নয়নের ক্ষেত্রে বাধা। মনে রাখতে হবে পরবর্তী প্রজন্মের জন্য বর্তমান সরকারের আধুনিক ও সময় উপযোগী কার্যক্রম হচ্ছে ডিজিটাল পদ্ধতির ব্যাপক সম্প্রসারণ। যা ভবিষ্যত্ প্রজন্মের জন্য উত্স্বর্গকৃত।
তিনি আরও বলেন, আমাদের রাজনীতিবিদদের নিজের দিকে, সমাজের দিকে, মানুষের দিকে তাকিয়ে চলার অভ্যাস রপ্ত করতে হবে। তাঁরা যা চাচ্ছেন তা সনাতনী ধারায় অর্জন সম্ভব নয়, তাঁদের আশা-আকাঙ্ক্ষা নতুন ধারার চিন্তা ভাবনায় যুক্ত করতে ব্যর্থ হলে তারাই পিছনে পড়ে যাবেন। মানুষের বর্তমান চাহিদা বা প্রত্যাশা আগের দিনের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। গত ২০/৩০ বছরে মানুষ জিআর-টিআর-কাবিখা-ঢেউ টিন ইত্যাদি নানা সাহায্য সহযোগিতা দাবি করত। যা তাদের দারিদ্র্যের সাথে সহাবস্থানে অভ্যস্ত করে তোলা বা ক্ষোভ-রোষ প্রশমনের কাজে লাগাতো মহল বিশেষ। এখন তাদের জীবন মানের পরিবর্তনের ধারায় চাহিদার তালিকায় এসেছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, স্বাস্থ্য সেবা, কর্মসংস্থান ইত্যাদি। যে তালিকায় তথ্য প্রযুক্তি উপকরণাদিও রয়েছে। নতুন প্রজন্মের ডিজিটাল চিন্তার প্রভাব পড়েছে সাধারণ মানুষের মাঝেও। নেতাদের এই পরিবর্তন ধারার প্রতি খেয়াল করে সেকেলে নেতিবাচক রাজনৈতিক মানসিকতা ঝেড়ে ফেলে নতুন প্রজন্মের আগ্রহের প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে। মনে রাখতে হবে ভাগ্য পরিবর্তনের সচেষ্ট মানুষকে ঘেরাও-হরতাল-অবরোধ দিয়ে বা অধিকার হরণ করে দাবায়ে রাখা যাবে না। মন্ত্রী আরও বলেন, পিরোজপুর তথা সারাদেশে নারী জাগরণের ক্ষেত্রে প্রণিধান যোগ্য অগ্রগতি ঘটেছে। স্বাধীন বাংলাদেশের ৪৩ বছরের তিলে তিলে পরিবর্তন নারীদের পুরুষের পাশাপাশি নিজের অবস্থান প্রতিষ্ঠায় অবদান রেখেছে। পিরোজপুরে নারীদের এই ভাবমূর্তি সারাদেশে তুলে ধরতে হবে।
পিরোজপুর জেলা প্রশাসন আয়োজিত কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার চত্বরের এ ডিজিটাল উদ্ভাবনী মেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে জেলা প্রশাসক এ কে এম শামিমুল হক ছিদ্দিকীর সভাপতিত্বে আরও বক্তব্য রাখেন বিশেষ অতিথি পুলিশ সুপার শাহ মোঃ আবিদ হোসেন, জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ মকবুল হোসেন, সিভিল সার্জন ডা. মোঃ ফকরুল আলম, জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মোঃ সালাহ্উদ্দিন ও অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মোঃ মানিক হার রহমান। অনুষ্ঠানে জেলা পর্যায়ের কর্মকর্তা, স্থানীয় সুধী সমাজ, বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা উপস্থিত ছিলেন। মন্ত্রী মেলার বিভিন্ন স্টল পরিদর্শন করেন এবং ডিজিটাল উপকরণাদি ও উদ্ভাবিত সরঞ্জামাদি দেখেন।
তিন দিনের ডিজিটাল মেলায় ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার, মাল্টিমিডিয়া ক্লাস রুম এবং ইনোভেশন বিষয়ক তিনটি সেমিনার, বিতর্ক প্রতিযোগিতা, আইসিটি বিষয়ক কুইজ প্রতিযোগিতা ইত্যাদি কর্মসূচি থাকছে। এছাড়া প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে ছাত্র-ছাত্রীদের রচনা প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। শিশু-কিশোররা যাতে ডিজিটাল প্রযুক্তির সাথে পরিচিতি লাভ করতে পারে তার সুযোগ এ মেলায় থাকবে এবং ছাত্র-ছাত্রীরা মেলা থেকে অনেক কিছু শিখতে পারবে বলে উদ্যোক্তাদের আশা। মেলার সমাপনীতে প্রতিযোগীদের ১৩টি পুরস্কার দেয়া হবে। মেলায় তথ্যপ্রযুক্তিসহ বিভিন্ন বিষয় ২৭টি স্টল থাকবে। সমাপনী অনুষ্ঠানে এ কে এম এ আউয়াল এমপি এবং দ্বিতীয় দিনের অনুষ্ঠানে বরিশালের বিভাগীয় কমিশনার মোঃ গাউস প্রধান অতিথি থাকবেন।
অন্যদিকে, পরিবেশ ও বন মন্ত্রী আনোয়ার হোসেন গতকাল বিকালে পিরোজপুরের জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত জেলা মাসিক উন্নয়ন ও সমন্বয় কমিটি এবং জেলা আইন-শৃঙ্খলা কমিটির সভায় বলেন, অগ্রাধিকার নির্ধারণ করে আমাদের উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করতে হবে। যাতে আমরা উন্নয়ন বরাদ্দ বাড়াতে পারি সেদিকে গুরুত্ব দিতে হবে। অতীতে দক্ষিণাঞ্চলের নেতৃত্বের অনৈক্যের কারণে ন্যায্য হিস্যা থেকে বরিশাল অঞ্চল বঞ্চিত হয়েছে। তারপরও সাহস, মনোবল, আন্তরিকতা ও ঐকান্তিকতাকে ভিত্তি করে এই অবহেলিত অঞ্চলের উন্নয়ন ধারাকে পশ্চাত্পদ অবস্থা থেকে বর্তমান অবকাঠামোগত উন্নয়নের দৃষ্টিগোচর পর্যায়ে আনা গেছে। যেখানে এলাকার মানুষের সমর্থন আমাদের পাথেয় ছিল। সর্বোপরি দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আন্তরিক দৃষ্টি রয়েছে বলে অতীতে যেমন আমরা অনেক সাফল্য পেয়েছি আবার বর্তমান ও আগামীতে এই ধারা অব্যাহত থাকবে। পিরোজপুরের জেলা প্রশাসক এ কে এম শামিমুল হক ছিদ্দিকীর সভাপতিত্বে এ দু’টি সভায় আরও বক্তব্য রাখেন পিরোজপুর-১ আসনের সংসদ সদস্য এ কে এম এ আউয়াল, পুলিশ সুপার শাহ মোঃ আবিদ হোসেন, জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ মকবুল হোসেন প্রমুখ। সভায় পিরোজপুরের দামোদর খাল পুনঃখনন ও বলেশ্বর নদীর ভাঙ্গন থেকে শহর রক্ষা বাঁধ নির্মাণ প্রকল্প গ্রহণের বিষয় আলোচনা হয়।
এদিকে, পরিবেশ ও বন মন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু গতকাল বৃহস্পতিবার পিরোজপুর জেলার জিয়ানগর উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নের কয়েকটি উন্নয়ন প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। এগুলো হচ্ছে পাড়েরহাট ইউনিয়ন পরিষদ থেকে বাটাজোট ভায়া নতুনহাট সড়ক উন্নয়ন, বালিপাড়া ইউনিয়ন পরিষদ থেকে বটতলা হাট ভায়া উত্তর কলারণ দাখিল মাদ্রাসা সড়ক কার্পেটিং দ্বারা উন্নয়ন এবং ঘোষেরহাট বাজার থেকে খেজুরতলা বাজার সড়ক কার্পেটিং দ্বারা উন্নয়ন কাজ। আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর উপস্থিতিতে দুস্থ কল্যাণ সংস্থার উদ্যোগে পাড়েরহাট, বালিপাড়া ও পর্ত্তাশী ইউনিয়ন পরিষদ প্রাঙ্গণে শীতার্ত মানুষের মাঝে কম্বল বিতরণ করা হয়। এছাড়া ত্রাণ বিভাগের উদ্যোগে দুস্থ-অসহায়দের মাঝে ঢেউটিন বিতরণ করা হয়। এ সময় জিয়ানগর উপজেলা চেয়ারম্যান মাসুদ সাঈদী, ভারপ্রাপ্ত ইউএনও জাহাঙ্গীর হোসেন, উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান ফায়জুল কবির তালুকদার, জিয়ানগর উপজেলা জেপি’র আহ্বায়ক ও পর্ত্তাশী ইউপি চেয়ারম্যান আসাদুল কবির তালুকদার স্বপন, জেপি’র সদস্য সচিব ও বালিপাড়া ইউপি চেয়ারম্যান মশিউর রহমান মঞ্জু, উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এ্যাডভোকেট মতিউর রহমান ও সাধারণ সম্পাদক মনিরুজ্জামান মৃধা, উপজেলা জেপি নেতা হারুন অর রশীদ পান্না, আনিসুর রহমান, কাওছার আহম্মেদ দুলাল, মিজানুর রহমান, পাড়েরহাট ইউপি চেয়ারম্যান মোঃ শাহ আলম হাওলাদার প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
জিয়ানগরে মন্ত্রী স্থানীয় হাইস্কুল মাঠে এক সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে বলেন, শান্তি ও শৃঙ্খলা বজায় রাখতে হবে। এলাকার মানুষ যাতে নির্ভয়ে-নির্বিঘ্নে চলাফেরা করতে পারে তা নিশ্চিত করতে জনপ্রতিনিধিদের প্রশাসনকে সহযোগিতা করতে হবে। মনে রাখতে হবে উন্নয়নের জন্য স্থিতিশীলতা দরকার।
ভাণ্ডারিয়া সংবাদদাতা জানান, সকালে পরিবেশ ও বন মন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু ভাণ্ডারিয়ার চরখালী বিসমিল্লাহ চত্বরে সড়ক ও জনপথ বিভাগের চরখালী-তুষখালী-মঠবাড়িয়া-পাথরঘাটা সড়কের উন্নয়ন কাজের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। এ সময় পিরোজপুর সড়ক বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী নূরুন্নবী তরফদার, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় উপ-কমিটির সহ-সম্পাদক মহিউদ্দিন মহারাজ, জেপি’র কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব খলিলুর রহমান খলিল, ভাণ্ডারিয়া উপজেলা চেয়ারম্যান আতিকুল ইসলাম তালুকদার উজ্জল, ইউএনও কাজী মাহবুবুর রশীদ, মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান আসমা আক্তার, নদমুলা ইউপি চেয়ারম্যান শফিকুল কবির তালুকদার বাবুল, ধাওয়া ইউপি চেয়ারম্যান ও ভাণ্ডারিয়া উপজেলা জেপি’র সদস্য সচিব সিদ্দিকুর রহমান টুলু, ভিটাবাড়িয়া মশিউর রহমান মৃধা, জেপি নেতা ইউসুফ আলী আকন, আবুল কালাম পোদ্দার, আওয়ামী লীগ নেতা হাফিজুর রশীদ তারিক জোমাদ্দার প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। এর আগে দুস্থ কল্যাণ সংস্থার উদ্যোগে নদমুলা বাজার সাইক্লোন শেল্টার প্রাঙ্গণে শীতার্তদের মাঝে কম্বল বিতরণ করা হয়।
http://www.ittefaq.com.bd/print-edition/last-page/2015/01/16/26257.html