সন্ত্রাসবাদবিরোধী অভিযানে সহযোগিতার অংশ হিসেবে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার পাঁচটি দেশে যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ বাহিনী অবস্থান করছে। অন্য দেশগুলো হলো ভারত, শ্রীলঙ্কা, নেপাল ও মালদ্বীপ।
মার্কিন বাহিনীর প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের (প্যাসিফিক কমান্ড) কমান্ডার অ্যাডমিরাল রবার্ট উইলার্ড মার্কিন কংগ্রেসের সদস্যদের সামনে দেওয়া বক্তব্যে এ কথা জানিয়েছেন। ভারতের বার্তা সংস্থা পিটিআই ও বিবিসি অনলাইন এ খবর দিয়েছে।
বাংলাদেশে মার্কিন বাহিনী মোতায়েনের ব্যাপারে জানতে চাইলে ঢাকায় মার্কিন দূতাবাসের মুখপাত্র প্রথম আলোকে বলেন, তিনি বক্তব্য দিয়েছেন কংগ্রেসের শুনানিতে। ওই শুনানিতে তিনি যা বলেছেন, সে সম্পর্কে কথা বলার কোনো সুযোগ নেই।
যোগাযোগ করা হলে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের পরিচালক শাহিনুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, মার্কিন সেনাবাহিনীর সাত সদস্যের একটি দল বাংলাদেশে আছে। তারা সন্ত্রাস দমনের ব্যাপারে প্রশিক্ষণ দেবে। সিলেটে সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষণ স্কুলে এ প্রশিক্ষণ হবে। চার সপ্তাহের এ প্রশিক্ষণ আজ শনিবার থেকে শুরু হচ্ছে।
পিটিআইয়ের খবরে বলা হয়, পেন্টাগনের ওই কর্মকর্তা গত বৃহস্পতিবার কংগ্রেসের শুনানিতে বলেন, সন্ত্রাসবিরোধী কার্যক্রমের সক্ষমতা বাড়াতে, বিশেষ করে সমুদ্রসীমার নিরাপত্তা জোরদারে সহযোগিতা করতে দক্ষিণ এশিয়ার পাঁচটি দেশে মার্কিন বিশেষ বাহিনীর দলগুলো মোতায়েন করা হয়েছে। মার্কিন বাহিনীর প্রশান্ত মহাসাগরীয় কমান্ড তাদের নিয়োগ করেছে।
বাংলাদেশ সম্পর্কে উইলার্ড কংগ্রেস সদস্যদের বলেন, সন্ত্রাসবাদবিরোধী লড়াইয়ে বাংলাদেশ বিশেষ কার্যকর সহযোগী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। পাকিস্তানভিত্তিক লস্কর-ই-তাইয়েবাসহ বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বাংলাদেশ ভারতের পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রকেও সহযোগিতা করছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সেনাবাহিনীর একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, সেনা মোতায়েনের কথা যেভাবে বলা হচ্ছে, বিষয়টি তেমন নয়। তবে প্রশিক্ষণ বিনিময় কর্মসূচির আওতায় মার্কিন সেনাবাহিনীর সাত কর্মকর্তা বর্তমানে বাংলাদেশে অবস্থান করছেন। তাঁদের এ অবস্থান অস্থায়ী। এভাবে অন্য দেশের সঙ্গেও প্রশিক্ষণ বিনিময় হয়েছে।
মার্কিন কমান্ডার শুনানিতে আরও বলেন, বাংলাদেশের সেনাবাহিনী তাদের সক্ষমতা বাড়িয়ে চলেছে এবং জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে ক্রমশ আরও বেশি বেশি অবদান রাখছে।
উইলার্ড বলেন, বাংলাদেশ প্রতিবছর ঘূর্ণিঝড় ও বন্যার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের মুখে পড়ে এবং এসব দুর্যোগ মোকাবিলায় জনগণের পাশে দাঁড়ানোই সে দেশের সেনাবাহিনীর প্রাথমিক দায়িত্ব। দেশের মানুষের সুরক্ষায় এ দায়িত্ব সেনাবাহিনী ভালোভাবেই পালন করে চলেছে।
মার্কিন কমান্ডার কংগ্রেসকে বলেন, লস্কর-ই-তাইয়েবা খুবই ভয়ংকর জঙ্গি সংগঠন। শুধু হামলা বা অভিযান চালাতে তারা যে সুদক্ষ, তা-ই নয়; আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এদের যোগাযোগও বেশ ভালো। কাজেই এরা বড় হুমকি।
উইলার্ড বলেন, ২০০৮ সালে মুম্বাইয়ে ভয়াবহ হামলাসহ ভারতে আরও অনেক হামলার জন্য লস্কর-ই-তাইয়েবা দায়ী। এই জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে আল-কায়েদা এবং অন্য জঙ্গিগোষ্ঠীর সংশ্লিষ্টতা আছে। তারা আফগানিস্তানে সন্ত্রাসী হামলায় সহযোগিতা করছে এবং এশিয়া, ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকায় কার্যক্রম প্রসারের আকাঙ্ক্ষা তাদের আছে।
কংগ্রেস সদস্য জো উইলসন কমান্ডার উইলার্ডের কাছে জানতে চান, লস্কর-ই-তাইয়েবাকে মোকাবিলায় কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। জবাবে উইলার্ড বলেন, ‘তাদের দমন করতে আমরা ওই অঞ্চলের দেশগুলোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করে চলেছি।’
উইলার্ড কংগ্রেসকে বলেন, ‘সন্ত্রাসবাদবিরোধী লড়াইয়ে সক্ষমতা, বিশেষ করে সমুদ্রসীমার নিরাপত্তা জোরদারে সহযোগিতা করতে আমরা ভারতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করছি। তবে এই সহযোগিতা করা হচ্ছে সরকার পর্যায়ে, প্রতিরক্ষা দপ্তর পর্যায়ে নয়। কিন্তু অভ্যন্তরীণ সন্ত্রাস এবং গোয়েন্দা হুমকির চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় তাদের সহযোগিতা করছে অন্যান্য সংস্থা।’
অ্যাডমিরাল উইলার্ড আরও বলেন, প্রশান্ত মহাসাগরীয় কমান্ডের যে দলটি ভারতে আছে, তারা মুম্বাইয়ের সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষজ্ঞদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। একই সঙ্গে ভারতের দক্ষিণ এশীয় অংশীদারদের সঙ্গে তাদের সহযোগিতা বৃদ্ধির কার্যক্রমে সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। এ কার্যক্রমের প্রধান লক্ষ্য মূলত লস্কর-ই-তাইয়েবা। তবে ওই সব দেশের সেনাবাহিনীর সন্ত্রাসবাদবিরোধী সক্ষমতা বৃদ্ধি ও আত্মনির্ভরশীল করাও এর লক্ষ্য।
কৌশলগত দিক দিয়ে সমগ্র দক্ষিণ এশিয়াই যুক্তরাষ্ট্রের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে উল্লেখ করেন কমান্ডার উইলার্ড। তিনি বলেন, মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপ থেকে এশিয়া ও আমেরিকার মধ্যে জ্বালানি পরিবহনসহ অন্যান্য নৌ-বাণিজ্যের অন্যতম বড় একটি অংশ ওই অঞ্চলে। এর মধ্যে ভারতের সমুদ্রসীমাই সবচেয়ে দীর্ঘ।
উইলার্ড বলেন, দক্ষিণ এশিয়া বিভিন্নমুখী চ্যালেঞ্জের একটি ক্ষেত্র। এখানে আছে দুই পরমাণু শক্তিধর প্রতিদ্বন্দ্বী ভারত ও পাকিস্তান। এ ছাড়া লস্কর-ই-তাইয়েবা, জলদস্যুতা, মাদক ও মানুষ পাচার, সীমান্ত বিরোধ, বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনসহ বিভিন্ন উপদ্রবে জড়িয়ে আছে ভারত, নেপাল ও শ্রীলঙ্কা।
মার্কিন বাহিনীর প্রশান্ত মহাসাগরীয় কমান্ড এশিয়াজুড়ে বিভিন্ন দেশে কাজ করছে। লস্কর-ই-তাইয়েবাসহ বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ওই সব দেশের সেনাবাহিনীকে সহযোগিতা করছে। এ ছাড়া সমুদ্র নিরাপত্তা জোরদার ও জলদস্যুতা রোধ, দুর্যোগ মোকাবিলার জন্য পরিকল্পনা ও প্রশিক্ষণও দিচ্ছে মার্কিন বাহিনী।
যোগাযোগ করা হলে ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশে বিশেষ মার্কিন বাহিনীর কোনো দপ্তর নেই। তবে বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে প্রশিক্ষণসহ সন্ত্রাসবিরোধী কর্মকাণ্ডে মার্কিন কর্মকর্তাদের উপস্থিতি থাকে। এসব কাজে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে কারা প্রতিনিধিত্ব করবেন, সেটা ঠিক করে মার্কিন প্রশাসন। বাংলাদেশে বিশেষ মার্কিন বাহিনীর কর্মকাণ্ড বলতে অ্যাডমিরাল উইলার্ড এ ধরনের উপস্থিতির প্রতি ইঙ্গিত করেছেন বলে তিনি মন্তব্য করেন।
এদিকে, মার্কিন বিশেষ বাহিনীর সদস্যদের বাংলাদেশ, ভারতসহ দক্ষিণ এশিয়ার পাঁচটি দেশে অবস্থান সম্পর্কে লন্ডনভিত্তিক জেনস ডিফেন্স উইকলির বিশ্লেষক রাহুল বেদি গতকাল রাতে বিবিসি বাংলাকে জানান, ইসলামি জঙ্গিবাদের পাশাপাশি দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের প্রভাবও যুক্তরাষ্ট্রের জন্য উদ্বেগের কারণ। এ কারণেই যুক্তরাষ্ট্র হয়তো বাংলাদেশের মতো দেশগুলোতে তৎপরতা বাড়াচ্ছে। তবে মার্কিন বিশেষ বাহিনীর সেনারা বাংলাদেশে স্থায়ীভাবে অবস্থান করবে, এমনটা তিনি মনে করেন না।
ভারতে মার্কিন দূতাবাসের প্রতিক্রিয়া: ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লিতে অবস্থিত মার্কিন দূতাবাস বলেছে, মার্কিন বাহিনীর কোনো দল ভারতে নেই, যেমনটা গণমাধ্যমে প্রচার করা হচ্ছে। তবে মার্কিন দূতাবাস ও ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, মার্কিন ২৫তম পদাতিক ডিভিশনের একটি ইউনিট ভারতীয় বাহিনীর সঙ্গে একটি মহড়ায় অংশ নিয়েছিল।
অন্যদিকে কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া (সিপিআই) গতকাল বলেছে, মার্কিন বিশেষ বাহিনীর উপস্থিতি কেন গোপন রাখা হলো, সে ব্যাখ্যা সরকারকে দিতে হবে।
এক বিবৃতিতে দলটি বলেছে, বিষয়টি কেন দেশের জনগণ ও পার্লামেন্টকে জানানো হয়নি? মার্কিন বাহিনীর ওই বিশেষ দল ভারতে এলে কী কাজ করছে? এসব প্রশ্নের উত্তর সরকারকে অবশ্যই দিতে হবে।