১৯৮৭ সালের ১০ নভেম্বর। এরশাদ বিরোধী আন্দোলনরত দলগুলোর ঢাকা অবরোধ কর্মসূচিকে ঘিরে টান টান উত্তেজনা চারদিকে। ঢাকা অবরোধের পর কী? কেউ তখনও কিছুই বলছে না।
এর আগে ‘এরশাদের অধীনে যে নির্বাচনে যাবে সে হবে `জাতীয় বেঈমান’ এই ঘোষণা দিয়ে ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে গেছে আওয়ামী লীগ। বিএনপির নির্বাচনে যাবার কথা থাকলেও নারায়ণগঞ্জের মতো শেষ মুহূর্তে যায়নি। এ নিয়ে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন পনের দল (কার্যত সেটি তখন ৮ দলীয় জোট), বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন সাত দলের মাঝে প্রায়ই কাইজ্যা লাগে। সেই কাইজ্যাকে কেন্দ্র করে আরামে নিজস্ব শাসনকে দীর্ঘ করে স্বৈরাচারী এরশাদ সরকার। আন্দোলনের পাশাপাশি এই দুই জোটের কাইজ্যা থামিয়ে তাদেরকে ঘষামজা রেফারিং’র কাজ করে বামপন্থী পাঁচদল।
পাঁচদলের অন্যতম তাত্ত্বিক, তৎকালীন ওয়ার্কার্স পার্টির নেতা হায়দার আকবর খান রনো ভাই’র (আজকের সিপিবির নেতা) ধানমন্ডির পিত্রালয়ে প্রায় যেতাম এক্সক্লুসিভের ধান্ধায়। রিটায়ার্ড প্রকৌশলী পিতার সন্তান রনো ভাই আর তার তৎকালীন স্ত্রী হাজেরা সুলতানা তথা হাজেরা আপা প্রতিদিন সকালে মায়ের হাত থেকে রিকশা ভাড়া, হাত খরচা নিয়ে আন্দোলন তথা সাম্রাজ্যবাদের এজেন্টদের পরাস্ত করে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম-মিশনে(!) বেরোন। ১০ নভেম্বর ঢাকা অবরোধের পর কী জানতে চাইলে রনো ভাই কৌশলী জবাব দিয়ে বলেন, আমরা সবাই পরীক্ষার আগের রাতে পড়াশুনা করে পাশ করা ছাত্র। কাজেই কর্মসূচি নিয়ে কোন সমস্যা হবে না। সময় আর ঘটনা ঠিক করে দেবে পরবর্তী কর্মসূচি।
১০ নভেম্বর সকাল সকাল তৈরি হয়ে চলে আসি জিরো পয়েন্ট এলাকায়। আজকাল দেশে সাংবাদিকতা করতে সবার আগে নাকি একটা আইডি তথা প্রেসকার্ড লাগে! কিন্তু পকেটে তেমন কিছু নেই বা কর্তৃপক্ষ তখনো ওসব ছাপেওনি। সচিবালয়ের চারপাশ ঘিরে বিশেষ নিরাপত্তা বলয় গড়ে তুলেছে স্বৈরাচারী বাহিনী। এর আগে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে সচিবালয় ঘেরাও’র এক কর্মসূচির দিন দেয়াল ভেঙ্গে ফেলা হয়েছিল সচিবালয়ের। এরপর থেকে যে কোন কর্মসূচির আগে সচিবালয়ের দেয়াল রক্ষা যেন এরশাদের মূল টার্গেট! সচিবালয়ের দেয়াল থাকলেই যেন তার গদি-পিঠ নিরাপদ থাকে!
সেই সকালে জিরো পয়েন্ট এলাকাতেই নূর হোসেনের সঙ্গে প্রথম দেখা। তখনও তার নাম-সাকিন কারও জানা নেই। তামাটে পেটানো শরীর। খালি গা। পুরনো জিন্সের একটা প্যান্ট পরনে। খালি পা। বুকে ‘স্বৈরাচার নীপাত যাক’, বুকে ‘গণতন্ত্র মুক্তি পাক’ লেখা (নিপাত বানানটি ‘নীপাত’ লেখা ছিল তার পিঠে)। এমনই এক জীবন্ত রাজপথের পোস্টার হয়ে মিছিলে এসেছিলেন যুবক। রোদের অক্ষরে লেখা নামে। ঢাকার কোন মিছিলে এর আগে এমন আর কাউকে দেখার অভিজ্ঞতা নেই। তাই সারা সময় সবার চোখে চোখে নূর হোসেন! নূর হোসেন! সারাক্ষণ তাকে দেখায় ভীষন অস্থির ব্যস্ত।
এই জিরো পয়েন্টেতো একটু পরে বঙ্গবন্ধু এভিনিউ’র আওয়ামী লীগ অফিসের সামনে! একটু পরেই হয়তো গোলাপশাহ’র মাজারের কাছে। একসময় শেখ হাসিনা পৌঁছেন সেখানে। তিনি তখন বিরোধীদলের নেত্রী। তার গাড়িকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের মিছিল স্লোগান মুখরিত। নূর হোসেনও সেখানে! তাকে মাথায় হাত বুলিয়ে জামা পরতে বলেন শেখ হাসিনা। সতর্ক করে বলেন নইলে স্বৈরাচার বাহিনী তাকে টার্গেট করে গুলি চালাতে পারে। কিন্তু শোনেননি নূর হোসেন। উল্টো শেখ হাসিনাকে বলেন, না আপা স্বৈরাচাররে যাইতেই অইব আইজ!
এর কিছু সময়ের মধ্যে টিয়ারগ্যাস ছুঁড়তে ছুঁড়তে জনতার ওপর হামলা শুরু করে স্বৈরাচার বাহনী। লাঠিচার্যে ছত্রভঙ্গ করে দেয় মিছিল। পুলিশের ধাওয়া খেয়ে জনতার সঙ্গে চলে যাই বায়তুল মোকাররম এলাকায়। জার্নালিজমে নতুন হওয়াতে ভুলটি হয় সেখানেই। ফটোসাংবাদিকরা সাধারণত পুলিশ বেস্টনির আশেপাশে থাকেন। কিন্তু তরুণ একজন ক্যামেরা হাতে তাদের সঙ্গে দৌড়াচ্ছে দেখে আন্দোলনের কর্মীরা সন্দেহ করে। কিছু শোনার আগে কয়েকজন ধরে ক্যামেরা থেকে কেড়ে নেয় ফিল্ম। এভাবে পিঠ বাঁচলেও থামে না চোখ ভরে আসা জলের কান্না! কারণ নূর হোসেনের অনেক ছবি তোলা হয়েছিল সে ক্যামেরায়। ফিল্মটি যাবার সঙ্গে সব যায়।
পরের দিনের পত্রিকায় এক ছবি দেখে শুরু হয় নতুন অনুসন্ধান। গুলিবিদ্ধ নূর হোসেনকে রিকশায় টেনে তুলছেন এক কিশোর। সে কিশোরকে খুঁজে বের করার টার্গেট হয়। ওয়ার্কার্স পার্টির তৎকালীন যুবনেতা নুরুল ইসলাম ছোটনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার সূত্রে এ মিশনটিও সহজ হয়ে যায়। ছোটন ভাই জানান ছেলেটির নাম সুমন। ক্লাস এইটে পড়ে। তাদেরই ছাত্র সংগঠন গণতান্ত্রিক ছাত্র ইউনিয়ন করে’এমন একজনের ছোটভাই। খিলগাঁও’র তিলপাপাড়ায় বাসা।
সুমনের সন্ধানে প্রথমে গোড়ানে ছোটন ভাই’র বাসায়। সেখান থেকে তিলপা পাড়ায় সুমনদের বাসায়। গোলাপশাহ মাজার এলাকার রাস্তায় কাটা মুরগির মতো কাতরাচ্ছিলেন গুলিবিদ্ধ নূর হোসেন। একটা রিকশা ডেকে তাকে সেটিতে টেনে তুলেন সুমন। তাকে টেনে তুলতে তার কষ্ট হচ্ছিল। রিকশা চালক সাহায্য করেন। এরপর চালক ছুটে চলা শুরু করেন ঢাকা মেডিক্যালের ইমার্জেন্সির উদ্দেশে। নূর হোসেনের রক্তে ভিজে আসে সুমনের সারা শরীর । এই যুবকই যে নূর হোসেন তা সুমন তখনও জানেন না। পরের দিন পত্রিকায় তার সঙ্গে ছবি দেখে তিনি জেনেছেন।
নূর হোসেন কী কিছু বলছিলেন তখন? মাথা নাড়েন সুমন। হ্যাঁ বলছিলেন। বিড়বিড় করে বলছিলেন, `আমার কিছু অয় নাই। স্বৈরাচাররে আইজ যাইতেই অইব।` ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ইমার্জেন্সিতে পৌঁছবার আগেই রিকশার পথ আটকে গুলিবিদ্ধ নূর হোসেনকে ছিনিয়ে নিয়ে যায় পুলিশ। সুমনকে ধাক্কা দিয়ে সেখান থেকে সরিয়ে দেয়। বন্দুক উঁচিয়ে গুলি করার ভয় দেখায়। এরপর কিশোর সেখান থেকে চলে আসে। ‘আমার লগে যতক্ষণ আছিল, হে বাঁইচা আছিল। পুলিশ নিয়া যাওয়ার পর আর কিচ্চু জানিনা’ বলতে বলতে তার চোখ অশ্রু সজল হয়। সুমনের বক্তব্যের পর খটকা লাগে মনে। গুলিবিদ্ধ নূর হোসেনকে কী কোনও চিকিৎসা দেবার চেষ্টা করেছে স্বৈরাচারের পুলিশ? না অপেক্ষা করেছে তার মৃত্যু নিশ্চিত হওয়ার?
এমন এক প্রত্যক্ষদর্শীর জবানিতে গণতন্ত্রের অমর শহীদের শেষ কথাগুলোর সেটিই ছিল প্রথম মিডিয়া রিপোর্ট। আজকের মতো এত পত্রিকা তখন ছিল না। দৈনিক পত্রিকাগুলো সমঝে চলত এরশাদকে। নূর হোসেনের শেষ কথা ছিল, `স্বৈরাচাররে আইজ যাইতেই অইব।`। কিন্তু রাজনৈতিক বিভাজনে স্বৈরাচার তখনই যায়নি। লোকচক্ষুর আড়ালে রাখতে চুপিসারে শহীদ নূর হোসেনকে গোড়ান গোরস্থানে সমাহিত করা হয়। সে গোরস্থানে একদিন গিয়ে দেখা যায় পুলিশের পাহারা। সেখানে কাছাকাছি কাউকে যেতে দেয় না পুলিশ। ১৯৮৭’র ১০ নভেম্বরের কিছু পরেই কোরবানির ঈদের ছুটি হয়ে যায়। বাংলাদেশে ঈদের ছুটি মানে আন্দোলনের ছুটি। সরকারের স্বস্তির সময়। এসব নিয়ে বিচিন্তায় ছাপা রিপোর্টের শিরোনাম ছিল, ‘গোড়ানে বিরোধীদলের লাশ, রেফারির ভূমিকায় পাঁচদল এবং আন্দোলনের ঈদ ভ্যাকেশন’।
শহীদ নূর হোসেনকে নিয়ে অনুসন্ধান চলতে থাকে। পুরনো ঢাকার বনগ্রামের বাড়ি খুঁজে তার পিতার ইন্টারভ্যু করে জানার চেষ্টা করি নূর হোসেনের জীবন। যুবক ক্লাস এইট পর্যন্ত পড়াশুনা করেছিলেন। বনগ্রামের ছোট ঘুঁপচির মতো ঘরটিতে গাদাগাদি করে পরিবারটি থাকত। ছোট চৌকির ওপরে নিচে পরিবারের সদস্যরা ঘুমাতেন। যুবলীগের সদস্য নূর হোসেনের স্থায়ী কোন চাকরি ছিল না। কোনও কাজ পেলে পরিবারকে সহায়তা করতেন। নূর হোসেন শহীদ হবার পর তার ভাই আলী হোসেনকে নিজের গাড়ি চালকের কাজ দেন শেখ হাসিনা। এরপর পরিবারটির অর্থনেতিক অবস্থা কিছুটা বদলাতে থাকে ।
এরশাদের পতনের পর সাপ্তাহিক প্রিয় প্রজন্ম বেরুলে সেখানে কাজ শুরু করেন একঝাঁক নতুন সাংবাদিক। ১৯৯২ সালের নভেম্বরে প্রিয় প্রজন্মের প্রথম সংখ্যায় এক্সক্লুসিভ ইন্টারভ্যু ছাপা হয় সেই শিল্পীর। যিনি নূর হোসেনের বুকে পিঠে কালজয়ী কবিতার সেই কথাগুলো লিখে দিয়েছিলেন, “স্বৈরাচার নিপাক যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক”। বঙ্গবন্ধু’র অমর কবিতা “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ এরপর এমন কালজয়ী কবিতা আর কেউ কী কখনো লিখেছে?
স্বৈরাচারীর জমানায় চুপচাপ থাকা সেই সাইনবোর্ডশিল্পীকে খুঁজে বের করে ইন্টারভ্যুটি করেন পল্লব মোহাইমেন। এরপর শিল্পীকে প্রিয় প্রজন্ম অফিসে চায়ের দাওয়াতে ডেকে এনে মূল প্রশ্ন ছিল একটাই, নূর হোসেনের বুকে লেখা স্বৈরাচার নিপাত যাক’ এর নিপাত বানানটি কেন ভুল লেখা হয়েছিল? জবাবে শিল্পী বলেন তার সাইনবোর্ডের দোকানের লাগোয়া দেয়ালে নিপাত বানানটি নূর হোসেন যেভাবে লিখে দিয়েছিলেন, রংতুলিতে সেভাবে তিনি লিখেছেন।
ক্লাস এইট পর্যন্ত পড়াশুনা করা নূর হোসেন বানানটি ভুল লিখতেই পারেন। কিন্তু লক্ষ্য তথা স্বৈরাচারের পতনের শপথে তার কোনও ভুল ছিল না। ভুল করেছেন তারা। যারা বানান শুদ্ধ লিখতে পারার দাবি করেন আর শর্টকাট রাজনৈতিক ক্ষমতায় যাওয়া-থাকার লোভে পতিত স্বৈরাচারকে টেনে নেন বুকে। চারদলীয় জোটের অন্যতম রূপকার সেই স্বৈরাচারী এরশাদ এখন মহাজোটের নেতা! তাকে সঙ্গে রেখেই এবার দলের সকল ইউনিটকে নূর হোসেন দিবস পালনের আহবান জানিয়েছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম!
নূর হোসেন রিপোর্টিং’এর আরেকটি তথ্য। নূর হোসেনের ‘গণতন্ত্র মুক্তি পাক’ লেখা পিঠের ছবিটি পাভেল রহমানের হলেও বুকের ছবিটি কিন্তু সৌখিন আলোকচিত্রী দিনু আলমের। ইশ্বরদীর যুবক দিনু আলম এখন কানাডায় থাকেন। সৌখিন আলোকচিত্রীরা অনেক সময় তাদের তোলা এক্সক্লুসিভ ছবি প্রকাশের জন্য মিডিয়াকে দেন। মিডিয়ার কেউ কেউ পরে সেটিকে দাবি করেন নিজের ছবি বলে। নূর হোসেনের ছবিকে কেন্দ্র করে তেমন একটি ঘটনার আমি নিজে প্রত্যক্ষ