অবৈধভাবে মালয়েশিয়া পাঠানোর নামে মুক্তিপণ আদায়

অবৈধভাবে মালয়েশিয়া পাঠানোর নামে মুক্তিপণ আদায়

malooবাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বে কঙবাজারে বঙ্গোপসাগর দিয়ে অবৈধভাবে মালয়েশিয়ায় লোক পাঠানোর কথা বলে তাদের গভীর সমুদ্রে আটকে রেখে বড় অংকের মুক্তিপণ আদায়ের অভিযোগ এখন বেশি উঠছে।

মুক্তিপণের টাকা দিয়ে ফেরত আসা একজন বলেছেন, টাকা দেয়ার পরও শরীরে নির্যাতনের চিহ্ন নিয়ে ফিরতে হয় এবং অনেক ক্ষেত্রে মৃতদেহও পাওয়া যায় না।

স্থানীয় প্রশাসন বলেছে, বাংলাদেশ, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড এবং মালয়েশিয়া- এই ৪টি দেশের দালালরা সংঘবদ্ধভাবে মানব পাচার এবং অর্থ আদায়ের এই অপরাধ করছে।

ফলে দেশি-বিদেশি দালাল চক্রের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের একক অভিযান কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না।

বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বে শেষপ্রান্তে নাফ নদীর সীমান্তের একটি পয়েন্টে গিয়ে দেখা যায়, নদীতে ছোট ছোট অসংখ্য নৌকা চলাচল করছে।

সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর বক্তব্য অনুযায়ী, এ সব নৌকায় করে জেলেরা মাছ ধরে। আর অনেক সময় এই জেলের সাজ নিয়েই ৫ জন-৭ জন লোককে নৌকায় করে সাগরে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা হয় অবৈধভাবে মালয়েশিয়া পাঠানোর জন্য।

দেশি-বিদেশি দালালরা এই অঞ্চলকে রুট হিসেবে ব্যবহার করছে, এমন অভিযোগও উঠছে।

দালালের খপ্পরে পড়েছিলেন নাফ নদীর তীরের রঙ্গীখালী গ্রামের জয়নাল আবেদীন। মালয়েশিয়া যাওয়া হয়নি তার। বঙ্গোপসাগরের গভীরে জাহাজে আটকে রেখে তার ওপর নির্যাতন করা হয়েছে। নির্যাতিত হয়েছেন থাইল্যান্ডে। শেষ পর্যন্ত তার মা জমি বিক্রি করে দালালকে ৯০ হাজার টাকা দিয়ে ছেলেকে ছাড়িয়ে এনেছেন। কিন্তু জয়নাল আবেদীন ফিরেছেন শরীরে নির্যাতনের চিহ্ন নিয়ে।

জয়নাল আবেদীন বলেন, আমার গ্রামের এক দালাল মালয়েশিয়া পাঠানোর জন্য ৯০ হাজার টাকা চেয়েছিল। এই টাকার পুরোটা একসঙ্গে দিতে হবে না। প্রথমে ১০ হাজার টাকা দিয়ে বাকি টাকা মালয়েশিয়া যাওয়ার পর দিতে হবে। এই চুক্তি করে দালাল আমাকে বঙ্গোপসাগরের গভীরে নিয়ে নির্যাতন করেছিল।

তিনি উল্লেখ করেন, গ্রামের দালাল আমাকে নাফ নদীর একটি ঘাট থেকে ছোট নৌকায় নিয়ে সারারাত রেখেছিল। পরদিন অন্য দালাল আমাকে ছোট নৌকায় করে গভীর সমুদ্রে নিয়ে বড় জাহাজে তুলেছিল। সেই জাহাজে ১৭দিন রেখে আমাকে শারীরিকভাবে নির্যাতন করেছে। পরে আমার সঙ্গে আরো অনেককে দালালরা সাগরে ভাসিয়ে দিলে থাইল্যান্ডের দালালরা আমাদের নিয়ন্ত্রণ নেয়।

জয়নাল আবেদীন আরো বলেন, থাইল্যান্ডের দালালরা আমাদের ৯৫ জনকে একটা ঘরে ৩২ দিন আটকে রাখে। সেই সময় নির্যাতনে আমাদের মধ্যে ১৮ জন মারা গেছে। অন্যদিকে আমি মালয়েশিয়া পৌছে গেছি, এটা বলে আমার মার কাছ থেকে জোর করে ৯০ হাজার টাকা নিয়েছে।

রঙ্গীখালী গ্রামেরই আসমা বেগম দালালের প্রলোভনে আকৃষ্ট হয়ে একমাত্র ছেলে এবং বাড়িভিটে সবই হারিয়েছেন। ৪০ বছর বয়সী এই নারী তার স্বামীর মৃত্যুর পর একমাত্র ছেলেকে ঘিরে অনেক স্বপ্ন এঁকেছিলেন। মালয়েশিয়ায় ছেলে অনেক টাকা রোজগারের পর সেখানে যাওয়ার টাকা শোধ করবে, গ্রামেরই একজন দালালের এমন কথায় তিনি ৫ মাস আগে ছেলেকে ঐ দালালের হাতে তুলে দিয়েছিলেন।

পরে দালালের চাপে বাড়ির জমি বিক্রি করে ২ লাখ টাকা দিয়েও ছেলের খোঁজ পাননি।

আসমা বেগম বলেন, আমার ১৩ বছরের ছেলে রিকশা চালাতো। দালালরা অবৈধভাবে মালয়েশিয়া পাঠানোর প্রলোভন দেখিয়ে তাকে নাফ নদীতে ট্রলারে তুলে দেয়। এর কিছুদিন পর ঐ দালাল এসে আমাকে বলে, তোমার ছেলে থাইল্যান্ডে আছে। এখন ২ লাখ টাকা না দিলে সে আসবে না। তখন আমি বাড়ির জমি বিক্রি করে ২ লাখ টাকা দেই। টাকা নেয়ার পর দালাল জানায়, ছেলেকে সাগরে মেরে ফেলেছে। লাশও দেয়নি।

সব হারিয়ে আসমা বেগম এখন আশ্রয় নিয়েছেন আত্মীয়ের জায়গায়। তার মতো অনেক পরিবার নিঃস্ব হয়ে গেছে টেকনাফ, উখিয়ার গ্রামগুলোতে।

ইউনিয়ন পরিষদগুলোর কাছেও এ ধরনের অভিযোগ জমা পড়েছে। উখিয়ার রাজাপালং ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর কবির চৌধুরী বলেন, অবৈধভাবে মালয়েশিয়া পাঠানোর কথা বলে দালালরা বঙ্গোসাগরের এই অঞ্চলকে রুট হিসেবে ব্যবহার করে এখন মুলত গভীর সমুদ্রে নিরীহ মানুষকে আটকে রেখে মুক্তিপণ বা টাকা আদায করছে। গভীর সমুদ্রে আটকে রেখে নির্যাতন করে তা পরিবারকে মোবাইল ফোনে শুনিয়ে টাকা আদায় করা হয়। কখনও অল্পসংখ্যক মালয়েশিয়ায় পৌঁছালেও তাদের জায়গা হচ্ছে কারাগারে। প্রতিনিয়ত এমন তথ্যই তারা পাচ্ছেন।

টেকনাফে সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবির ৪২ ব্যাটালিয়নের পরিচালক আবু জার আল জাহিদ বলেন, বাংলাদেশিদের মতো রোহিঙ্গাসহ মিয়ানমারের নাগরিকরাও দালালদের খপ্পরে পড়েছে।

তিনি বলেন, বাংলাদেশ, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড এবং মালয়েশিয়া- এই ৪টি দেশে দালাল রয়েছে। মালয়েশিয়া যাওয়ার জন্য ২ লাখ টাকা লাগবে। এখন শুধু ৫-১০ হাজার টাকা দিয়ে বাকিটা মালয়েশিয়া যাওয়ার পর দেয়া যাবে। এ ধরনের নানান প্রলোভন দেখানো হয়। এরপর প্রলোভনে আকৃষ্ট মানুষকে গভির সমুদ্রে নিয়ে আটকে রেখে পরিবারের কাছ থেকে টাকা আদায় করা হয়।

গ্রামগুলোতে স্থানীয়দের অনেকে দালাল চক্রের সঙ্গে জড়িত বলে অভিযোগ উঠছে। কিন্তু তাদের খুঁজে পাওয়া কঠিন কাজ। অনেক কষ্টের পর কোনো প্রশ্ন না করা বা নাম প্রকাশ না করার শর্তে রাতে একটি গ্রামে একজন দালালের দেখা মিললো। কিন্তু তিনি মাইকের সামনে কয়েকটি বাক্য বলেই মুহূর্তেই সেই এলাকা থেকে সরে পড়লেন।

এলাকা থেকে অনেক মানুষ মালয়েশিয়া গেছে। অনেক বড় বড় দালাল আছে। বড় দালালরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকে। আমরা এখানকার মানুষ। আমরা ছোট-খাট। আমিও একজন লোক দিয়েছিলাম। তখন বড় দালাল আমাকে ১ হাজার টাকা দিয়েছিল।

ক্ষতিগ্রস্তদের দিক থেকে অভিযোগ রয়েছে, পুলিশের কাছে অভিযোগ করে লাভ হয় না। তবে কঙবাজারের পুলিশ বলছে, দেশি দালালরা সারাদেশে নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছে এবং তারা দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে লোক নিয়ে এসে তাদের সমুদ্রে ধরে রেখে টাকা আদায় করছে।

টেকনাফ থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোক্তার হোসেনের বক্তব্য হচ্ছে, দালালদের দেশি-বিদেশি নেটওয়ার্কের কারণে কোস্টগার্ড, বিজিবি এবং পুলিশ সমন্বিত অভিযান চালিয়েও এই অপরাধ নির্মূল করা সম্ভব হচ্ছে না।

পুলিশ এবং বিজিবির স্থানীয় কর্মকর্তারা মনে করেন, নাফ নদী থেকে বঙ্গোসাগর দিয়ে মানব পাচার এবং অর্থ আদায়ের এই অপরাধ বন্ধে মিয়ানমারসহ সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে যৌথ পদক্ষেপ নেয়া উচিত।

বাংলাদেশ