নোবেল জয়ী মালালার নিজ শহরে দেখা দিয়েছে অসন্তোষ। তাদের ক্ষোভ সরাসরি মালালার প্রতি নয়। তাদের ক্ষোভ বিশ্বের প্রতি, যা কিনা মালালার নিজ এলাকা সোয়াত উপত্যকায় সহিংসতা আর অবহেলা উপক্ষে করে তার প্রতি অতি মনোযোগ দিচ্ছে।
নোবেল জয়ী মালালা ইউসুফজাইয়ের শহর সোয়াত উপত্যকার মিঙ্গোরা। সেখানকার একটি সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ে ছাত্রীরা মাটিতে চাদর, পাটি বিছিয়ে পাঠ গ্রহণ করছে। কেননা, যথেষ্ট পরিমাণ আসবাব নেই। জানালা ভাঙা। দেয়াল নোংরা। আর শিক্ষকরা ক্ষুব্ধ। বার্তা সংস্থা রয়টাসের্র প্রতিবেদনে এসব কথা বলা হয়েছে।
গণিত শিক্ষিকা সায়মা খান অভিযোগের সুরে বললেন, শুধুই মালালা, মালালা, মালালা। শত শত মানুষ আছে যারা সব কিছু বিসর্জন দিয়ে সর্বস্ব হারিয়েছে। তাদেরকে কেউ কিছু দেয়নি। গতকাল সোয়াত উপত্যকায় অনুষ্ঠিত হয় একটি কেক কাটা অনুষ্ঠান। সমাজকর্মীদের সঙ্গে একরকম ধাক্কাধাক্কি করে মালালার পোস্টার উঁচিয়ে স্থানীয় রাজনীতিকরা এগিয়ে যায় অনুষ্ঠানে যোগ দিতে। খানাখন্দ ভর্তি রাস্তা আর চারপাশে আবর্জনার স্তূপ উপেক্ষা করে তারা প্রেস ক্লাবে গিয়ে হাজির হয়।
স্থানীয় অনেক নিবাসী ওই শোভাযাত্রাটা কিছুটা সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখেছেন। তারা বললেন, মালালার শিক্ষা প্রচারণার প্রতি নেতারা মৌখিক প্রশংসা করলেও ওই নেতারা মালালার শহরের স্কুলগুলোকে সরকারি অবহেলা আর অব্যাহত সামরিক দখলদারিতে পর্যবসিত হতে দিচ্ছে। মালালার সাবেক শিক্ষক ও তার পিতার ঘটিষ্ঠ বন্ধু আহমেদ শাহ বললেন, এটা নিঃসন্দেহে মানুষকে অখুশি করছে। সরকার যদি তাদের দায়িত্ব পালন করতো তাহলে মানুষ মালালাকে অপছন্দ করতো না। তারা নিজেদের পরিত্যক্ত অনুভব করে।
তিনি আরও বলেন, মানুষ অনুভব করছে মালালা বিশ্বজুড়ে সবার মনোযোগ পাচ্ছে কিন্তু পাকিস্তানেও সোয়াত উপত্যকার ওপর কারও দৃষ্টি নেই। প্রাদেশিক আইন প্রণয়নকারী সংস্থার সদস্য ফজলে হাকিম বললেন, তিনি মালালার শিক্ষা প্রচারণার একজন বড় ভক্ত। কিন্তু তিনি স্বীকার করলেন, সরকার ক্ষমতায় আসার পর একটিও বিদ্যালয় তৈরি করেনি। মানুষ কাজের ঘাটতিতে হতাশ। নতুন স্কুল নির্মাণ বিশেষভাবে জরুরি। কেননা, ২০০৯ সালে সেনাদের আগমনের পর অনেক স্কুল সেনা ব্যারাক আর ঘাঁটিতে পরিণত হয়েছে।
হাকিম জানালেন, সোয়াত উপত্যকার ৪০ শতাংশ বিদ্যালয় বর্তমানে সেনারা ব্যবহার করছে। মেডিকেল কর্মকর্তা তারিক খান জানালেন, আমার নিজের বোন দু’বছর ধরে স্কুলে যায়নি। কারণ, সে যে স্কুলে পড়তো সেটা এখন আমির্র দখলে। আর বাকি স্কুলগুলো অনেক দূরে। এতদূর তার পক্ষে হেঁটে যাওয়া সম্ভব নয়। এ পরিস্থিতি মালালার মিশনের ভিত্তি দুর্বল করে দিচ্ছে। তিনি আরও বলেন, মালালার সংগ্রাম সফল করতে হলে দয়া করে আমাদের স্কুলগুলো ফিরিয়ে দিন। তা না হলে মালালা গুলি খেয়ে এতো সমস্যার মধ্য দিয়ে যে গেছে তা বৃথা যাবে। ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া মিঙ্গোরার সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা বললেন, তারা মালালাকে নিয়ে গর্বিত।
কিন্তু তাদের ক্ষোভ, শুধুমাত্র তাকেই সম্মানিত করা হয়েছে, যেখানে কত শত মানুষ জঙ্গিদের হাতে নিগৃহীত হয়েছে। সোয়াত উপত্যকা থেকে পাকিস্তান আর্মি ২০০৯ সালে তালেবানদের বিতাড়িত করে। কিন্তু তারা গুপ্তহত্যা অব্যাহত রেখেছে। ২০১২ সালে মেয়েদের শিক্ষা অধিকারে প্রচারণা চালানোর কারণে তালেবান বন্দুকধারীরা মালালার ওপর হামলা চালায়। মাথায় গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর তাকে ইংল্যান্ডে নিয়ে যাওয়া হয়। এখন সে পরিবারসহ সেখানেই আছে। তালেবান হামলার শিকার হওয়ার পর মালালা একটি বই লিখেছেন। জাতিসংঘে বক্তব্য দিয়েছেন। অসংখ্য পুরস্কার জিতেছেন। আর শুক্রবার ভারতীয় শিশু অধিকার কর্মী কৈলাশ সত্যার্থীর সঙ্গে শান্তিতে নোবেল জিতলেন যৌথভাবে।
১৭ বছরের মালালার ওপর বিশ্বের একক মনোযোগ আর জঙ্গি আগ্রাসনের শিকার বাকিদের উপেক্ষা করায় অপ্রীতিকর সব গুজব উঠেছে। এমন কথাও অনেকে বলেছেন, মালালা একজন সিআইএ এজেন্ট। আর তার পরিবার হামলার ঘটনা সাজিয়েছে যেন তারা এ থেকে উপকৃত হতে পারে। বিজ্ঞান শিক্ষক গুল মাকাই বললেন, মানুষের মধ্যে এসব ধারণা ঢোকার পেছনে একটি কারণ রয়েছে। তা হলো, মালালা সবকিছু পেয়েছে, সোয়াত কিছুই পায়নি। তিনি জানালেন, সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের তিনজন শিক্ষক তালেবান বোমা হামলায় বিধবা হয়েছেন। কিন্তু তারা কোন অনুদান বা বিদেশে থাকার প্রস্তাব পাননি। তিনি জানতে চান, সরকার ও আন্তর্জাতিক সমপ্রদায় তাদের জন্য কি করবে? আর বললেন, মালালা সোয়াতের একমাত্র বাসিন্দা নন।