‘লাব্বাইক আল্লাহুমা লাব্বাইক’

‘লাব্বাইক আল্লাহুমা লাব্বাইক’

hajj05বিশ্বের নানাপ্রান্ত থেকে আগত ২০ লাখেরও বেশি মুসল্লির সমবেত কণ্ঠে ‘লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক’ ধ্বনিতে মুখরিত হচ্ছে আরাফাত ময়দান।

শুক্রবার সকাল থেকেই হাজিরা ‘লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, লাব্বাইক লা শারিকালাকা লাব্বাইক। ইন্নাল হামদা ওয়ান নিয়ামাতা লাকা ওয়াল মুলক। লা শারিকা লাক্’ (আমি হাজির, হে আল্লাহ আমি হাজির, আমি হাজির, তোমার কোনো শরিক নেই, তোমার দরবারে উপস্থিত হয়েছি। নিশ্চয় সব প্রশংসা ও নিয়ামত শুধু তোমারই, সব সাম্রাজ্যও তোমার, তোমার কোনো শরিক নেই)।’ সবার মনে এবং মুখে উচ্চারিত হচ্চে মহান আল্লাহর একত্ব ও মহত্বের কথা। কাফনের কাপড়ের মতো সাদা দুই টুকরো কাপড় পড়ে মহান আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়েছে আল্লাহর বান্দাহগণ।

ইসলামের পাঁচ স্তম্ভের অন্যতম স্তম্ভ হচ্ছে হজ। হজের তিন ফরজের মধ্যে আরাফাতের ময়দানে অবস্থান করা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। চলতি বছর জুমার (শুক্রবার) দিনে মূল হজ অনুষ্ঠিত হচ্ছে বিধায় হাজিরা পেতে যাচ্ছেন হজে আকবর এর মর্যাদা। জুমা এবং হজ একই দিনে অনুষ্ঠিত হলে ওই হজকে হজে আকবর বলা হয়।

‘হজ’ শব্দের আভিধানিক অর্থ সংকল্প করা বা ইচ্ছা করা। হজ শুধু উম্মাতে মুহাম্মদ (স.)এর ওপর ফরজ করা হয়নি। পূর্ববর্তী অনেক নবী-রাসুল ও তাদের অনুসারীদের ওপরও হজ আদায়ের বিধান ছিল। এ জন্য আল্লাহ তায়ালা প্রথম মানব হজরত আদম (আ.)কে কাবাঘর নির্মাণের নির্দেশ দিয়েছিলেন। হজরত ইবরাহীম ও ইসমাইল আলাইহিস সালাম আল্লাহর নির্দেশে কাবাঘর সংস্কার করেছেন এবং তারাও হজ পালন করেছেন। প্রাচীনকাল থেকেই আরবের লোকেরা হজ পালন করত।

ইতিহাস থেকে জানা যায়, দক্ষিণ আরবের বাদশাহ আবরাহা রাসুলের (স.) এর জন্ম বছরে কাবাঘর ভেঙে ফেলার জন্য বিশাল হাতি বাহিনী নিয়ে এসেছিলেন। অবশ্য আল্লাহর বিশেষ রহমতে ও কুদরতে কাবাঘর রক্ষা পায় এবং বাদশাহ আবরাহার বিশাল হাতিবাহিনী আবাবিল পাখির নিক্ষিপ্ত পাথরে ভস্মীভূত তৃণরূপ হয়ে যায়। আল কোরআনের সুরা ফিল এই প্রেক্ষাপটেই নাজিল হয়।

বিভিন্ন হাদিস ও ইতিহাস থেকে জানা যায়, জাহেলিয়া যুগের লোকেরা হজ মওসুমে নগ্ন হয়ে কাবাঘর প্রদক্ষিণ করতো। ইসলামের প্রাথমিক পর্যায়ে মহানবী (স.) হজ মওসুমে মক্কায় আগত মানুষদের কাছে ইসলামের সুমহান দাওয়াত পৌঁছে দিতেন। এতে বোঝা যায়, পূর্ববর্তী অনেক নবী-রাসুলের ওপরও হজ পালনের বিধান ছিল। তাদের স্মৃতিস্মারক ও ঐতিহ্য সম্পর্কে অবগত হওয়া এবং শ্রদ্ধা প্রদর্শন করাও হজের অন্যতম উদ্দেশ্য।

হযরত আবদুর রহমান বিন ইয়ামার আদ-দায়লি (রা.) থেকে বর্ণিত আছে, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “আরাফাই তো হজ।” ইমাম শাওকানী (রহ.) এ কথার ব্যাখ্যায় বলেছেন, “যে ব্যক্তি আরাফাতে অবস্থানের জন্য নির্দিষ্ট দিনে ওই ময়দানে উপস্থিত থাকার সৌভাগ্য অর্জন করল তার হজ হয়ে গেল।”

ইমাম তিরমিযী (রহ.) এ প্রসঙ্গে বলেছেন, “আরাফাত ময়দানে অবস্থান করার ভাগ্য যার হয়নি তার হজ বাতিল হয়ে যাবে।”

‘আরাফাহ’ এবং ‘আরাফাত’ —এই দুটি শব্দই আরবিতে প্রচলিত। মক্কা থেকে ১৫ কিলোমিটার নিকটবর্তী  আরাফাতের ময়দানটি দুই মাইল দৈর্ঘ্য ও দুই মাইল প্রশস্ত এক বিশাল সমতল মাঠ। এর দক্ষিণ পাশে মক্কা হাদা তায়েফ রিং রোড। এই রোডের দক্ষিণ পাশে আবেদি উপত্যকায় মক্কার উম্মুল কুরআ বিশ্ববিদ্যালয়। আরাফাতের উত্তরে সাদ পাহাড়। সেখান থেকে আরাফাত সীমান্ত পশ্চিমে আরো এক হাজার মিটার বিস্তৃত।

এখানেই ৯ জিলহজ জোহর নামাজের পর অবস্থান করার মাধ্যমেই হজের প্রথম ও প্রধান কাজ সম্পন্ন করা হয়। এদিনে মসজিদে নামিরা থেকে হাজিদের উদ্দেশে খুতবা দেবেন সৌদি আরবের গ্র্যান্ড মুফতি শেখ আব্দুল আজিজ আল আশ শেখ। আল্লাহ তায়ালা এবং তার বান্দার মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়নের অনন্য আবহ বিরাজ করছে আরাফার ময়দানে। ফুটে উঠছে মুসলিম উম্মাহর ঐক্য, সংহতি ও ভ্রাতৃত্বের এক অসাধারণ দৃশ্য।

দুনিয়া ও আখেরাতের কল্যাণ, রহমতপ্রাপ্তি ও নিজের গুনাহ মাফের জন্য আল্লাহ তায়ালার কাছে কায়মনোবাক্যে ফরিয়াদ জানাবেন বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা মুসলমানরা। হজের মাধ্যমে বিশ্ব মুসলিম ঐক্য ও ভ্রাতৃত্ববোধের স্বরূপ প্রকাশ পায়। এ মহামিলনকেন্দ্রে দুনিয়ার সব দেশ, অঞ্চল, জাতি-বংশ-বর্ণ এবং বিভিন্ন ভাষাভাষী ও আকার-আকৃতির মুসলমান স্রষ্টাপ্রেমে ব্যাকুল হয়ে কাফনসদৃশ সাদা পোশাকে সজ্জিত হয়ে একই বৃত্ত ও কেন্দ্রবিন্দুতে সমবেত হন। সমবেত কণ্ঠে বিশ্বের বিভিন্ন এলাকার নানা ভাষা, আকৃতি ও বর্ণের লাখ লাখ মুসলমান তালবিয়া পাঠরত অবস্থায় হজ পালনে শরিক হন।

প্রায় ১৪০০ বছর আগে ১০ হিজরিতে অর্থাৎ ৬৩২ খ্রিস্টাব্দে হজ চলাকালে আরাফায় অবস্থিত জাবালে রহমত পাহাড়ে দাঁড়িয়ে মুসলমানদের উদ্দেশে হযরত মোহাম্মদ (স.) বিদায় হজের ভাষণ দিয়েছিলেন। মুহাম্মাদ (স.)এর জীবিতকালে এটা শেষ ভাষণ ছিল। তাই এটিকে বিদায়ী খুৎবা বলে আখ্যায়িত করা হয়। ইসলামের প্রকৃত মূল্যবোধ অনুযায়ী মুসলমানদের করণীয় সম্পর্কে এই ভাষণে চূড়ান্ত দিকনির্দেশনা ছিল।

হাজিরা শনিবার কোরবানি দেবেন। অধিকাংশ হাজি নিজে বা বিশ্বস্ত লোক দিয়ে মুস্তাহালাকায় (পশুর হাট ও জবাই করার স্থান) গিয়ে কোরবানি দেন। ইচ্ছে করলে ইসলামি উন্নয়ন ব্যাংকে (আইডিবি) রিয়াল (টাকা) জমা দিয়ে কোরবানি দিতে পারবেন। এরপর মাথা মুণ্ডন করে এহরাম খুলে পোশাক পড়বেন হাজিরা। একে তাহাল্লুলে আসগর বলা হয়।

তারপর তাওয়াফে ইফাদা (কাবাঘর তাওয়াফ) এবং সায়ি (সাফা-মারওয়ায় সাত চক্কর) শেষ করে ফের মিনায় ফিরে যাবেন।

১১ ও ১২ জিলহজ (রোব এবং সোমবার) মিনায় অবস্থান করে সূর্য হেলে পড়ার পর প্রতিদিন ছোট, মধ্য ও বড় জামারায় পাথর নিক্ষেপ করে ১২ তারিখ সূর্যাস্তের আগে মিনা ত্যাগ করবেন হাজিরা।

যারা ১২ তারিখ সূর্যাস্তের আগে মিনা ত্যাগ করতে পারবেন না, তারা ১৩ তারিখ মঙ্গলবার সূর্যাস্তের আগ পর্যন্ত মিনায় অবস্থান করবেন এবং জামারায় ১১ ও ১২ তারিখের মতো পাথর নিক্ষেপ করবেন।

এরপর বুধবার মক্কায় অবস্থান করে বিদায়ী তাওয়াফ সম্পন্ন করে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করবেন হাজিরা। আর যারা মদীনা জিয়ারত করবেন, তারা মদীনার উদ্দেশে মক্কা ত্যাগ করবেন।

এ বছর বাংলাদেশ থেকে সরকারি এবং বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় ৯৮ হাজার ৬০৫ জন (গাইডসহ) হজ পালনের জন্য ইতিমধ্যে সৌদি আরবে পৌঁছেছেন। এর মধ্যে মারা গেছেন ৩৩জন বাংলাদেশি। তাদের সবারই স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে বলে হজ মিশন সূত্র নিশ্চিত করেছে। রাষ্ট্রপতিসহ বেশ কয়েকজন এমপি-মন্ত্রী এবার হজ পালনের জন্য সৌদি আরব অবস্থান করছেন।

হাজিদের নিয়ে ফিরতি ফ্লাইট শুরু হবে ৮ অক্টোবর শেষ হবে ৭ নভেম্বর ২০১৪।

পবিত্র মক্কা শরীফের সম্প্রসারণ কাজ সম্পন্ন না হওয়ায় এবছর আন্তর্জাতিক ২০ ভাগ এবং আভ্যন্তরীণ ৫০ ভাগ হাজির আবেদনপত্র গ্রহণ করা হয়নি।

বাংলাদেশ শীর্ষ খবর