জাতীয় পার্টির অবস্থা নাজুক বলে মনে করছেন দলটির অন্যতম প্রেসিডিয়াম সদস্য জিএম কাদের। তার মতে, শুধু জাতীয় পার্টিই নয়। পুরো রাজনীতিই এখন সঙ্কটাপন্ন। রাজনীতিতে যে গুমোট অবস্থা বিরাজ করছে তা অব্যাহত থাকলে দেশে রাজনৈতিক শূন্যতা দেখা দিতে পারে। একান্ত আলাপচারিতায় তিনি এসব কথা বলেন। তার মতে, বাংলাদেশে সত্যিকার অর্থে কোন দিনই গণতন্ত্র ছিল না। প্রায় সব সময়ই স্বৈরাচারী কায়দায় দেশ চলেছে। সার্বিকভাবে গণতন্ত্রের চর্চাও কোন দিন হয়নি। তবে দেশে রাজনীতি ছিল। বর্তমানে রাজনীতি নেই, চলছে বিরাজনীতিকরণ। বিএনপি এবং সমমনা দলগুলো বর্তমানে সঠিক রাজনীতি করছে না এটা বলা যায় না। তাদের কর্মসূচি ও বক্তব্যগুলোকে মূল্যায়ন করে এ ধরনের রাজনীতিকে উৎসাহিত করা আবশ্যক। গুরুত্ব না দিলে তারা ধ্বংসাত্মক রাজনীতির দিকে ধাবিত হতে পারে। ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনের আগে সরকার বলেছিল সংবিধানের ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য নির্বাচন করতে হচ্ছে, সহসাই আরেকটি নির্বাচন দেয়া হবে। আর এখন সরকারের মন্ত্রীরা বলছেন, তারা পাঁচ বছরের জন্য নির্বাচিত হয়েছেন এবং মেয়াদ শেষে নির্বাচন হবে। এমন প্রশ্নে মহাজোট সরকারের সাবেক এ মন্ত্রী বলেন, সরকার এ কথা বলেছিল, এখন মনে হচ্ছে তারা সে অবস্থান থেকে সরে যাচ্ছে। তবে ভবিষ্যতে কি হবে তা রাজনৈতিক পরিস্থিতির ওপরই নির্ভর করছে। এ মুহূর্তে সুস্পষ্ট করে কিছু বলা যাচ্ছে না। আওয়ামী লীগের একজন নেতা বলেছেন, আগামী দুই বছরের মধ্যে বিএনপি এবং জাতীয় পার্টির অস্থিত্ব বিলীন হয়ে যাবে। এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, এখন দেশে যে অবস্থা চলছে তাতে রাজনীতি থাকবে বলে মনে হচ্ছে না। রাজনৈতিক দলগুলো বিলীন হওয়ার পথে। আগেই বলেছি বিরাজনীতির পথে অগ্রসর হচ্ছে দেশ। তাঁবেদার বিরোধী দল ছাড়া দেশে সরকার বিরোধী কোন রাজনীতি থাকবে না, দৃশ্যত এ পথে দেশ পরিচালিত হচ্ছে। ইতিহাস উদ্ধৃত করে তিনি বলেন, অতীতেও বাংলাদেশে একই ধরনের প্রচেষ্টা দেখা গেছে। কিন্তু বাংলাদেশের মতো জনবহুল সীমিত সম্পদের সমস্যাসঙ্কুল দেশে জোর করে সরকারবিরোধী মনোভাব বন্ধ করা যায় না। ফলে সরকারবিরোধী কোন রাজনৈতিক সংগঠন থাকবে না- এটা বিশ্বাসযোগ্য মনে হয় না। স্বাভাবিক প্রক্রিয়ার সরকারের পরিবর্তন না হলে কোন না কোনভাবে আন্দোলন মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে এবং তার মাধ্যমে অস্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় সরকারের পতন হয়। সারাদেশ রাজনৈতিক গুমোট ভাব চলছে। এটা ঝড়ের পূর্বাভাস হতে পারে।
জাপার বর্তমান অবস্থা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, জাপা সার্বিক পরিস্থিতি আমার চোখে নাজুক মনে হচ্ছে। জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ শুধু পার্টিরই প্রধান নন, পার্টির প্রাণপুরুষ। তাকে ঘিরেই জাতীয় পার্টি। ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনকে কেন্দ্র করে তার নেতৃত্ব নিয়ে যে সঙ্কট সৃষ্টি হয়েছে তা আজও বিদ্যমান। দেখা যাচ্ছে অনেকে পার্টির চেয়ারম্যানের নেতৃত্ব মানার কথা মুখে বললেও বাস্তবে তার আদেশ-নির্দেশ বা ইচ্ছাসমূহ অবহেলা করছেন। নিজেদের অনুকূলে হলে মানছেন, না হলে বর্জন করছেন।
নতুন রাজনৈতিক ফ্রন্ট গঠন প্রক্রিয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, দেশ বিরাজনীতির পথে। এই পরিস্থিতিতে যারা নতুন ফ্রন্টের উদ্যোগ নিয়েছে তাদের সম্ভাবনা আছে বলা যায়। সরকারবিরোধী প্লাটফর্ম যাতে কার্যকর হয় তা জনগণও উপলব্ধি করছে। সৃষ্ট রাজনৈতিক শূন্যতা যে কোনভাবেই পূরণ হবে। গণতন্ত্রে বিশ্বাসী দলগুলো যদি স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় দাঁড়াতে পারে তবে তা দেশের জন্য মঙ্গল। আর তা না হলে এ শূন্যতা পূরণ হবে চরমপন্থি ও জঙ্গিগোষ্ঠীর মাধ্যমে। মানুষের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ, সরকারের জবাবদিহিকরণ ও সরকার পরিবর্তনের সুযোগ জনগণের কাম্য। এ ইচ্ছার সফল বাস্তবায়ন ঘটাতে সক্ষম হবে এ ধরনের রাজনৈতিক শক্তি জনগণের আকাঙ্ক্ষা। গণতান্ত্রিক শক্তিসমূহ এ আকাঙ্ক্ষা পূরণে সক্ষম হলে তা দেশের জন্য স্বস্তি বয়ে আনবে। অন্যথায়, অপরাজনীতি বিকাশ ঘটে দেশে বড় ধরনের সঙ্কট হতে পারে। এ দেশে আল-কায়দার শাখা খোলার কথায় যার কিছুটা আভাস পাওয়া যায়। জিএম কাদের বলেন, আমাদের দুর্ভাগ্য কোন সরকারেই স্বৈরাচারী বা একনায়কতন্ত্রের ঊর্ধ্বে উঠতে পারেনি। গণতন্ত্রের কথা মুখে বললেও কার্যত কোন সরকারেই তা চর্চা করেনি। পাশাপাশি গণতন্ত্রের চর্চার জন্য আবশ্যক সহযোগী যে সকল প্রতিষ্ঠান আছে তা প্রতিটি সরকার নিজেদের দলীয় স্বার্থে দুর্বল করে বর্তমানে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে এসেছে। গণতন্ত্র মুখে আছে কাজে নেই। স্বৈরতন্ত্র প্রচলিত আছে বলা যায়। এক প্রশ্নের জবাবে জিএম কাদের বলেন, দেশে সঙ্কট আছে তা সরকারও জানে। অধুনা বাংলাদেশ সফর করে যাওয়া জাপানের প্রধানমন্ত্রীরও জানা আছে। যারা স্বীকার করছেন না তারা বাস্তবতাকে অস্বীকার করছেন। রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে ইতিমধ্যে দেশে, বিদেশী বিনিয়োগ স্থবির হয়ে গেছে। দেশের অনেক বিনিয়োগকারী তাদের অর্থ বিদেশে পাচার করছেন এমন খবরও শোনা যাচ্ছে। এ ধরনের পরিস্থিতি বেশি দিন থাকলে অর্থনৈতিক সঙ্কট দেখা দেবে দেশে। আর বিনিয়োগ না বাড়লে কর্মসংস্থান বাড়বে না। কর্মসংস্থান না থাকলে বেকার সমস্যা ও আনুষঙ্গিক নানাবিধ সামাজিক সমস্যা দেখা দেবে, যা রাজনৈতিক সমস্যাকে আরও গভীরতর করবে। তিনি বলেন, বিএনপি ও সমমনা দলসমূহের বর্তমান রাজনীতিকে সঠিক নয় তা বলা যায় না, গণতন্ত্রের রীতিনীতি অনুসরণ করে তারা যে মতামত প্রকাশ করছে তা গুরুত্ব না পেলে সে দলসমূহ হয়ত দুর্বল হবে, তবে মূলত গণতন্ত্রকামী দল ও গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে প্রতিবাদের আবেদন থাকবে না। স্বাভাবিকভাবে চরমপন্থা জঙ্গিবাদ ও এ ধরনের রাজনৈতিক শক্তির উত্থান হবে।
গুম, খুন, অপহরণ ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি প্রসঙ্গে সাবেক মন্ত্রী জিএম কাদের বলেন, ১৯৯১ সালের পর থেকে দেশে রাজনীতিতে দলীয়করণের সংস্কৃতি চালু হয়েছে। যা দিনকে দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। জনগণকে সরকারের তরফ থেকে দুভাবে ভাগ করা হয়েছে। যারা যখন ক্ষমতায় থাকে অর্থাৎ সরকারি দল (বর্তমানে আওয়ামী লীগ) ও তাদের সঙ্গে যারা জড়িত দলীয় লোকজন প্রথম শ্রেণীর নাগরিক হিসেবে গণ্য হন। আর তাদের বাইরে সাধারণ জনগণ দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক। চাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্য সুযোগ-সুবিধা বণ্টন ছাড়াও আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে এ শ্রেণীভেদ অনুযায়ী আলাদা করে দেখা হচ্ছে। আইন প্রয়োগে প্রথম শ্রেণীর নাগরিকের জন্য করা হয় নমনীয় আচরণ। আরা যারা ক্ষমতাসীনদের বাইরে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক তাদের সঙ্গে কোন কোন ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি করা হয়, হয়রানির অভিযোগও পাওয়া যায়। পার্টির লোকজন আইনের ঊর্ধ্বে ওঠায় অপরাধীরা যে কোন প্রক্রিয়ায় সরকারি দলের খাতায় নাম লেখায়। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির এটি একটি প্রধান কারণ। আইনের চোখে সবাই সমান সরকারের তরফ থেকে সবার জন্য আইন সমানভাবে প্রয়োগ করলে পরিস্থিতির উন্নতি হবে আশা করি। বলা হচ্ছে, জাতীয় পার্টির সংসদীয় দল মন্ত্রিপরিষদ থেকে পদত্যাগের নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ প্রশ্নে সাবেক মন্ত্রী ও প্রেসিডিয়াম সদস্য জিএম কাদের বলেন, জনগণের পক্ষে সরকারের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার গুরুদায়িত্ব বিরোধী দলের। সরকারের অংশ হিসেবে এ কাজ করা জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হয় না। যদি তারা পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন, সঠিক কাজটি করেছেন।
সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে দেয়া হচ্ছে- এ বিষয়ে তিনি বলেন, অনেক দেশে আছে। তবে আমাদের দেশে বর্তমান পরিস্থিতিতে এ পরিবর্তনটি বিচার বিভাগের স্বাধীনতার ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলবে। কারণ সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের কারণে সংসদ সদস্যরা এ বিষয়ে নিজস্ব কোন মতামত দিতে পারবেন না। দলের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মত দিতে হবে। দলের সিদ্ধান্ত দেয়ার একক ক্ষমতা দলীয় নেতার ওপর। আর দলীয় নেতা ও সরকার প্রধান এক ব্যক্তি হলে পুরো ক্ষমতা এক ব্যক্তির ওপর থাকবে। বর্তমান সংসদের দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যসমূহ আওয়ামী লীগের দলভুক্ত। সেই দলেরই প্রধান সরকার প্রধান বা প্রধানমন্ত্রী, একই সঙ্গে তিনি সংসদীয় দলের নেতাও। তাই সকল সিদ্ধান্তের ক্ষমতা এক ব্যক্তির হাতে। একক সিদ্ধান্তে যে কোন সময় সরকার প্রধান হাইকোর্টের বিচারপতিদের অপসারণ করতে পারবেন। এ ঝুঁকির মধ্যে বিচারকগণ সর্বক্ষেত্রে স্বাধীনভাবে বিচার করতে পারবেন না এটাই স্বাভাবিক।
সুষ্ঠু বিচারের মাধ্যমে সরকারকে বা সার্বিকভাবে নির্বাহী বিভাগের জবাবদিহি নিশ্চিত করার একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান বিচার বিভাগ। সে প্রতিষ্ঠানকে যদি নির্বাহী বিভাগের প্রধান নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হন তা হলে এ প্রতিষ্ঠানের মুখ্য উদ্দেশ্য ব্যাহত হবে।
সম্প্রচার নীতিমালা সম্পর্কে জিএম কাদের বলেন, গণমাধ্যম সংশ্লিষ্ট বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ পাশাপাশি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন গুলি বলেছে, এ নীতিমালা সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধ করবে। এ নীতিমালার কারও জন্য মঙ্গলজনক হবে না। আমিও মনে করি দেশের উন্নয়নসহ সার্বিক সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবেশ এ নীতিমালা নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।