ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী তখন প্রফুল্লচন্দ্র সেন। সবে চীনের যুদ্ধের ঝড় মাথার উপর দিয়ে গিয়েছে। এই রকম একটা সময়ে শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী সিরিমাভো বন্দরনায়েকে দিল্লি এসেছিলেন সরাসরি বেজিং থেকে। দিল্লিতে প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর সঙ্গে তার বৈঠক হয়। চীনের প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাইয়ের বার্তা নিয়ে একই সময়ে দিল্লি এসে নেহরুর সঙ্গে বৈঠক করেন চীনে কর্মরত ভারতীয় রাষ্ট্রদূত পি কে বন্দ্যোপাধ্যায়। ১৯৬৩ সালের কথা। বন্দরনায়েকের এই সফর নিয়ে লোকসভায় বিতর্কের ঝড় ওঠে। সেই বিতর্কে কলকাতার কিছু সংবাদপত্রের প্রকাশিত রিপোর্টে বেদম চটে যান নেহরু। ১৯৬৩-র ২ ফেব্রুয়ারি প্রফুল্ল সেনকে একটি চিঠি দিয়ে তিনি লেখেন যে, “হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ড’ (আনন্দবাজার পত্রিকা গোষ্ঠীর সেই সময়কার কাগজ) এবং ‘অমৃতবাজার পত্রিকা’র কিছু লেখা দেখে আমি বিস্মিত ও ব্যথিত হয়েছি। মতপার্থক্য নিয়ে আমি মাথা ঘামাই না। কিন্তু আমার সঙ্গে বন্দরনায়েকের সম্পর্ক নিয়ে যে ভাষায় লেখা হয়েছে সেটি অনুচিত বলে আমার মনে হচ্ছে। লেখায় বুদ্ধির থেকে রাগ এবং অসন্তোষ বেশি বলে মনে হচ্ছে। আমরা একটা পরিণত জাতি। এই রকম আচরণ অকাম্য। আমি এটা বলছি না যে তোমাকে এখনই কিছু ব্যবস্থা নিতে, আমি বলছি, যদি না সেটা তুমি প্রয়োজনীয় বলে মনে করো। কিন্তু আমি আমার মতামত তোমাকে জানালাম।’
প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে এই মতামতটুকুই যথেষ্ট। এই চিঠি পেয়ে মুখ্যমন্ত্রী ‘হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ড’-এর সম্পাদক অশোক সরকারের কাছে চিঠি পাঠালেন। সেই চিঠিটির মধ্যে কোনো রূঢ়তা ছিল না। কিন্তু ভুল সংশোধন করার জন্য আবেদন জানিয়েছিলেন। তার পর ১২ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি লিখে মুখ্যমন্ত্রী জানালেন, ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’ এবং ‘হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ড’-এ বেশ কিছু প্রবন্ধ নিয়ে আমি অশোক সরকারের সঙ্গে কথা বলেছি। জানিয়েছি যে আমি এই প্রবন্ধগুলিকে ‘অনুমোদন’ দিতে পারছি না। তবে ‘অমৃতবাজার পত্রিকা’ এবং ‘যুগান্তর’ আমাদের নীতিকে সম্পূর্ণ সমর্থন করছে। সমস্যা হচ্ছে যে ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’র কাছ থেকে ওই রকম ভাবে কোনো মুচলেকা জোগাড় করা সম্ভব হচ্ছে না। প্রফুল্লচন্দ্র সেন শুধু নয়, বিধান রায় থেকে সিদ্ধার্থ রায় পর্যন্ত প্রত্যেক মুখ্যমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী হিসেবে কাজ করেছেন যে সাংবাদিক, সেই শরৎ চক্রবর্তীর দু’টি খণ্ডে প্রকাশিত পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীদের সঙ্গে শীর্ষক গ্রন্থে এই চিঠি দু’টি-সহ অতীতের ঘটনাটি জানা যাচ্ছে।
এটা ১৯৬৩ সালের কথা। বলা যায় যে ২০১৪ সালেও সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলেছে। রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে সংবাদমাধ্যম, তার মালিক ও সাংবাদিকদের সম্পর্ক একটি অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক গবেষণার বিষয়। সাপ্তাহিক বেঙ্গল গেজেট পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছিল ১৭৮০-র ২৯ জানুয়ারি জেমস অগাস্টাস হিকি-র সম্পাদনায়। এটা ছিল ভারতের প্রথম মুদ্রিত পত্রিকা। প্রথম প্রতিবাদী পত্রিকাও বলা যায় একে। সেই সময় থেকে স্বাধীন ভারতবর্ষেরও কয়েক যুগ কেটে গিয়েছে। সংবাদমাধ্যমেরও এক বিরাট অগ্রগতি হয়েছে। উর্দু সংবাদপত্র পয়গম-ই-আজাদির সম্পাদক দেদার বক্তকে প্রাণদণ্ড দেওয়া হয়েছিল মহাবিদ্রোহ সমর্থন করার জন্য। সম্ভবত ইনি ভারতের প্রথম সাংবাদিক শহিদ। জরুরি অবস্থার সময় গণশক্তি-র বার্তা সম্পাদক কল্পতরু সেনগুপ্তকে বিধানসভা সদস্যের অধিকার ভঙ্গের জন্য বিধানসভার কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে ভর্ৎসনা করা হয়েছিল। তার অপরাধ ছিল, জয়প্রকাশ নারায়ণের সভাভঙ্গকারীদের অভিনন্দন জানিয়েছিলেন যে সব বিধায়ক, তাদের অবস্থানের প্রতিবাদ করে প্রবন্ধ লিখেছিলেন তিনি। সত্যি কথা বলতে, সংবাদপত্রও এক বিপুল অবক্ষয়ের শিকার হয়েছে।
যেভাবে একজন পুলিশ কিংবা এক জন চিকিৎসক অথবা একজন শিক্ষক দুর্নীতিগ্রস্ত হন, ঠিক সে ভাবে এক জন সাংবাদিকও হতে পারেন। আবার ভালো পুলিশ, ভালো চিকিৎসক, ভালো শিক্ষক যেমন এ সমাজে রয়েছেন, তেমন ভালো সাংবাদিকও রয়েছেন। তা ছাড়া খবরের কাগজ বের করাটা এখন আর ঠিক ‘নষ্টনীড়’-এর ভূপতির ছাপাখানা নয়। বিশেষত বৈদ্যুতিন চ্যানেলগুলি আসার পর, সোস্যাল মিডিয়ার আবির্ভাবের পর পুরো দৃশ্যপটটাই বদলে গিয়েছে। গ্রাহকমূল্যে সংবাদমাধ্যম যত চলে, তার থেকে অনেক বেশি প্রয়োজন বিজ্ঞাপন রাজস্ব। আবার রাজনেতাদের বিরোধী শিবিরে থাকা আর শাসক হয়ে ওঠার মধ্যেও মনস্তত্বের ফারাক হয়ে যায়। শাসক দলের বিরুদ্ধে, প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে যখন সংবাদমাধ্যম সোচ্চার হয়, তখন সেটা বিরোধী পরিসরের পছন্দ হয়। ফলে বিরোধী নেতানেত্রীরা সংবাদমাধ্যমের ‘ডার্লিং’ হয়ে ওঠেন। কিন্তু সেই শাসকদল যখন রাজনেতা হয়ে ওঠেন, তখন তার সমালোচনা সহ্য করার সহিষ্ণুতা তথা পরমত সহিষ্ণুতা খুব কমে যায়। ফলে বিরোধী দলে থাকার সময় অর্ডিন্যান্সের বিরোধিতা করে। শাসক প্রভু হয়ে অর্ডিন্যান্সের ক্ষমতা ব্যবহার করে।
সেটা যে আজকে নরেন্দ্র মোদী প্রথম করছেন তা নয়। ১৯৭৫ সালে ইন্দিরা গান্ধীর জরুরি অবস্থাও এই অসহিষ্ণুতারই প্রকাশ। ইন্দিরা গান্ধীর সময় প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ে কাজ করেছেন এমন এক জন বিশিষ্ট প্রশাসক বি এন ট্যান্ডন তার ‘পিএমও ডায়েরি’ গ্রন্থে লিখেছেন মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় তার কাছে এসে হন্তদন্ত হয়ে বললেন যে রাজ্য সরকার শরৎ রচনাবলী প্রকাশ করতে চান। কিন্তু শরৎবাবুর পরিবারের সদস্যরা রাজি হচ্ছেন না। তাই তিনি অর্ডিন্যান্স করে অবিলম্বে রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে শরৎ রচনাবলী প্রকাশ করে দিতে চান। তখন এই অফিসার বলেছিলেন, এত তুচ্ছ কারণে এ হেন ব্রহ্মাস্ত্র প্রয়োগ করাটা কি সমীচীন হবে? এই ঘটনাটি ঘটেছিল ১৯৭৫-এর ১ ফেব্রুয়ারি। পশ্চিমবঙ্গে শরৎচন্দ্রের অনেক ভক্ত আছেন। এই কারণে মুখ্যমন্ত্রী শরৎবাবুর জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে রচনাবলী প্রকাশের এবং তার গল্প থেকে দু’টি চলচ্চিত্র বানানোর কথা ভেবেছিলেন। বি এন ট্যান্ডন লিখেছেন, এটা ভয়াবহ প্রস্তাব বলে তিনি বিরোধিতা করেছিলেন। অর্ডিন্যান্স করে কপিরাইট কেড়ে নেওয়া ভুল হবে। অন্য রাজ্য সরকারগুলিও এই পথ নিতে পারে।
রাজীব গান্ধীও প্রেস বিল করে বিপদে পড়েছিলেন। তার পর তিনি নিজেই সংসদে এসে সেই বিল প্রত্যাহার করে পরিস্থিতি সামাল দিয়েছিলেন। হিটলারের মনস্তত্ব নিয়ে লেখা একটি বইতে এক মার্কিন মনস্তাত্বিক লেখেন, হিটলারের প্রধান সমস্যা তার মধ্যে হাস্যরস ছিল না। চার্লি চ্যাপলিনের গোঁফ দেখেও তিনি রেগে গিয়েছিলেন। তার মনে হয়েছিল, চার্লি তাকে ব্যঙ্গ করার জন্য এটি করেছেন। ‘গ্রেট ডিক্টেটর’ ছবিটি তিনি নিজের দেশে নিষিদ্ধ করেছিলেন। যদিও চার্লি ও হিটলার ছিলেন সমসাময়িক। ব্যঙ্গচিত্র আঁকার দায়ে এই প্রথম শাস্তি পশ্চিমবঙ্গেই হচ্ছে তা নয়। দার্শনিক প্লেটো-ও অবশ্য ব্যঙ্গচিত্র সহ্য করতে পারতেন না। তিনি ব্যঙ্গচিত্রকে ব্ল্যাক ম্যাজিক বলে আখ্যা দিয়েছিলেন। বৃটিশ আমলে বসন্তক বলে একটি পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছিল। সেই পত্রিকায় হগ সাহেবের বাজারের লিজ পাওয়া নিয়ে দুর্নীতির ব্যঙ্গচিত্র ছাপা হয়েছিল। বৃটিশ শাসক দল তাদের রক্তচক্ষু দেখানোয় পত্রিকাটি বেশ কয়েক বার উঠে যাওয়ার জোগাড় হয়েছিল। রাজনেতার অহংবোধও সুপ্রাচীন। ইংল্যান্ডের রাজা অষ্টম হেনরি যখন রোমান ক্যাথলিক খ্রিস্টধর্মের সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করে ১৫৩৪ সালে পাল্টা চার্চ অফ ইংল্যান্ড তৈরি করলেন, তখনই এস্টাব্লিশমেন্টের ধারণাটিও এল। এই প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা থেকে সরে যাওয়া আজ সংবাদমাধ্যমের পক্ষে অসম্ভব। শুধু নীতির জন্য নয়। বাজারের চাহিদা অনুযায়ী জোগান রক্ষা করার জন্যও।
সমস্যা হচ্ছে, রাজনৈতিক নেতারা চান নিঃশর্ত আনুগত্য। যদি তুমি আমাকে ভালোবাসো, আমাকে সমর্থন করো, তা হলে আমার মতাবলম্বী হতে হবে। বঙ্কিমচন্দ্রের এক অসাধারণ প্রবন্ধ রয়েছে যার নাম ‘ভালোবাসার অত্যাচার’। সেখানে তিনি বলেছেন যে, লোকের বিশ্বাস যারা শত্রু তারাই শুধু আমাদের উপর অত্যাচার করে। আসলে তা নয়। ভালোবাসার অত্যাচারও ভয়াবহ। ‘তুমি আমাকে ভালোবাসো। অতএব আমার অনুরোধ রাখিতে হইবে। তোমার ইষ্ট হউক, অনিষ্ট হউক, আমার মতাবলম্বী হইতে হইবে।’
তবে সংবাদমাধ্যমের দায়িত্ব কিন্তু অনেকটা। গণহিস্টিরিয়া তৈরি করার একটা প্রবণতা যে এই প্রতিযোগিতামূলক সাংবাদিকতায় নেই সেটাও সত্য নয়। আবার সেটাও নতুন নয়। বার্টান্ড রাসেলের একটা গল্প দিয়ে শেষ করি। ‘টু ফেস ডেঞ্জার উইথআউট হিস্টিরিয়া’ গ্রন্থে এক জায়গায় রাসেল লিখেছেন, ‘হাতি খুব শান্ত ও বিচক্ষণ প্রাণী। কিন্তু মধ্য আফ্রিকায় কিছু হাতির পাল যখন সর্বপ্রথম আকাশে এরোপ্লেন উড়তে দেখে, তখন তাদের ভিতর ভীষণ চাঞ্চল্য দেখা দেয়। ওদের চোদ্দো পুরুষে কেউ কখনও এমন আজব শব্দ করা একটা পাখিকে উড়তে দেখেনি। দলের সব হাতি ভয় পেয়ে এ দিক-ও দিক ছোটাছুটি শুরু করে দেয়। কিন্তু এরোপ্লেনটি দিগন্তে মিলিয়ে যেতে সবাই আবার শান্ত হয়ে লাইন করে হাঁটতে শুরু করল।’ কোনো দুর্ঘটনা ঘটেনি। কোনো ষড়যন্ত্রের উপাখ্যান রচনা হয়নি। কোনো সিবিআই তদন্তেরও দাবি ওঠেনি।
কারণ, রাসেল লিখেছেন, সেই হাতির পালে কোনো সাংবাদিক ছিলেন না!–আনন্দবাজার পত্রিকা