টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে বাংলাদেশের উদ্বেগ দূর না হতেই ফের আলোচনায় উঠে এসেছে ভারতের আন্তনদী-সংযোগ প্রকল্প। সে দেশের সুপ্রিম কোর্টের সর্বশেষ নির্দেশনার পর পরিবেশের জন্য বিপর্যয় সৃষ্টিকারী প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছে মনমোহন সিংয়ের সরকার।
বাংলাদেশ ও ভারতের পরিবেশ বিশেষজ্ঞদের মতে, আন্তনদী-সংযোগ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশের পরিবেশ ও কৃষি গুরুতরভাবে ক্ষতির মুখে পড়বে।
ভারতের সরকারি বার্তা সংস্থা প্রেস ট্রাস্ট অব ইন্ডিয়া (পিটিআই) জানায়, আন্তনদী-সংযোগ প্রকল্প সুনির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে বাস্তবায়নের জন্য মনমোহন সিংয়ের সরকারকে নির্দেশ দিয়েছেন সে দেশের সুপ্রিম কোর্ট। সর্বোচ্চ আদালত উচ্চাভিলাষী ওই প্রকল্প বাস্তবায়নের পরিকল্পনা সুচারুভাবে সম্পন্ন করতে একটি উচ্চপর্যায়ের কমিটি গঠন করে দিয়েছেন।
গতকাল সোমবার প্রধান বিচারপতি এস কে কাপাডিয়ার নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের বেঞ্চ এ আদেশ দেন। বেঞ্চের অন্য দুই সদস্য হলেন বিচারপতি সতান্তর কুমার ও এ কে পট্টনায়ক।
এই প্রকল্পের আওতায় নেপালের কোসি ও মহাকালী নদীর পানি উৎসস্থলের কাছে বাঁধ নির্মাণের মাধ্যমে আটকে দেওয়া হবে। সেখান থেকে পানি নিয়ন্ত্রিতভাবে গঙ্গায় এসে পড়বে। গঙ্গার পানি আন্তসংযোগের মাধ্যমে মধ্যপ্রদেশের কাছ দিয়ে দক্ষিণ ভারতের দিকে যাবে। দক্ষিণ ভারতের শুকনো অঞ্চলে পানি নেওয়া হবে।
ভারতের নর্মদা বাঁচাও আন্দোলনের আহ্বায়ক মেধা পাটেকার গতকাল রাতে আসাম থেকে মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘সুপ্রিম কোর্ট গতকাল যে নির্দেশনা দিয়েছেন, তাতে এ প্রকল্পের পরিবেশগত প্রভাব সম্পর্কে তাঁরা যথেষ্ট তথ্য-উপাত্ত পাননি বলে আমার মনে হয়েছে। শুধু সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশনাতেই এ প্রকল্প বাস্তবায়িত হবে না। পরিকল্পনা এবং পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের অনুমতি নিতে হবে। এ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে, শুধু বাংলাদেশ কেন, ভারতের ভাটি অঞ্চলের মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে।’ তিনি বলেন, ভারতে নদীগুলোর ওপরে যেসব বাঁধ নির্মিত হয়েছে, তার মধ্যে কতগুলো শর্ত সাপেক্ষে ছাড়পত্র পেয়েছিল। কিন্তু সেসব শর্ত পূরণ করে শেষ পর্যন্ত বাঁধ নির্মিত হয়নি। ফলে সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশসহ এ অঞ্চলের দেশগুলোর ওপর নেতিবাচক প্রভাব শুরু হয়েছে।
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও পানি বিশেষজ্ঞ আইনুন নিশাত প্রথম আলোকে বলেন, আন্তসংযোগ নদী প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্রের পানি কমে আসবে। শুকনো মৌসুমে ব্রহ্মপুত্র নদ বাংলাদেশের ৭০ শতাংশ পানির উৎস—এ কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, এই নদী দিয়ে পানি আসা কমে গেলে বাংলাদেশের কৃষি ও পরিবেশ গুরুতর বিপর্যয়ের মধ্যে পড়বে।
আইনুন নিশাত বলেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্প্রতি ঢাকা শীর্ষ বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেন, অববাহিকাভিত্তিক পানি ব্যবস্থাপনা করবে দুই প্রতিবেশী। ফলে ভারত চাইলে একতরফাভাবে যৌথ নদীর ওপর এ ধরনের বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে পারে না। এ ব্যাপারে ভারত সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশের নিবিড় আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।
সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশনা: ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের গতকালের রায়ে বলা হয়েছে, প্রকল্প বাস্তবায়নে দেরি হওয়ায় ইতিমধ্যেই এটির প্রাক্কলিত ব্যয় বেড়ে গেছে। তাই কেন্দ্রীয় সরকার ও সংশ্লিষ্ট রাজ্য সরকারগুলোকে সুনির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে প্রকল্প বাস্তবায়নে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে।
আন্তনদী-সংযোগ প্রকল্প বাস্তবায়নে সরকারের বিভিন্ন বিভাগ, মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিদের পাশাপাশি বিশেষজ্ঞ ও সমাজকর্মীদের সমন্বয়ে একটি উচ্চপর্যায়ের কমিটি গঠন করে দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্ট। কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত থাকবেন ভারতের কেন্দ্রীয় পানিসম্পদমন্ত্রী; পানিসম্পদসচিব; পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের সচিব; পানিসম্পদ, অর্থ, পরিকল্পনা ও পরিবেশ এবং বন মন্ত্রণালয় মনোনীত চারজন বিশেষজ্ঞ। রাজ্য সরকারের প্রতিনিধি, দুজন সমাজকর্মী এবং আন্তনদী-সংযোগ প্রকল্পের মামলায় সহায়তাদানকারী জ্যেষ্ঠ আইনজীবী রঞ্জিত কুমার।
প্রকল্পের ইতিবৃত্ত: ২০০২ সালের অক্টোবরে ভারতের তৎকালীন এনডিএ (ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স) সরকারের প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ি আন্তনদী-সংযোগ প্রকল্প বাস্তবায়নে একটি টাস্কফোর্স গঠন করেন। ভারতে মারাত্মক খরা সৃষ্টির প্রেক্ষাপটে তিনি সে বছর এ উদ্যোগ নেন।
ওই টাস্কফোর্সের প্রতিবেদনে আন্তনদী-সংযোগ প্রকল্পকে উপদ্বীপ অঞ্চলের নদীসংযোগ ও হিমালয় থেকে সৃষ্টি হওয়া নদীগুলোর মধ্যে সংযোগ—এই দুই ভাগে ভাগ করার সুপারিশ করা হয়েছে। উপদ্বীপ অঞ্চলের নদীগুলো মধ্য ভারত থেকে শুরু করে দক্ষিণ ভারতের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত।
প্রকল্পের এ অংশ দক্ষিণ ভারতের নদীগুলোর মাঝে ১৬টি সংযোগের মাধ্যমে ‘দক্ষিণাঞ্চলীয় পানি গ্রিড’ গড়ে তুলবে। এ পরিকল্পনার আওতায় মহানন্দা ও গোদাবরীর বাড়তি পানি পেন্নার, কৃষা, ভাগাই ও কাবেরীতে প্রবাহিত করা হবে। টাস্কফোর্সের পরিকল্পনা অনুযায়ী পশ্চিম দিকে প্রবাহিত কেরালা ও কর্ণাটকের নদীগুলোর ধারা পূর্ব দিকে পরিবর্তনের পাশাপাশি পশ্চিম উপকূলসংলগ্ন ছোট নদীগুলো এবং মুম্বাইয়ের উত্তর ও তাপির দক্ষিণে প্রবাহিত নদীগুলোর সঙ্গে যমুনার দক্ষিণের প্রবাহিত নদীর ধারার সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করা হবে।
উত্তরাঞ্চলীয় প্রকল্পে জলাধার নির্মাণের লক্ষ্যে ভারত, নেপাল ও ভুটানে গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্রের পাশে বেশ কিছু বাঁধ নির্মাণ করা হবে। গঙ্গার পূর্ব দিকে প্রবাহিত বাড়তি পানির গতিপথ পশ্চিমে সরিয়ে দিতে খাল নির্মিত হবে। ব্রহ্মপুত্র ও এতে প্রবাহিত অন্য নদীর ধারার সঙ্গে গঙ্গা এবং গঙ্গার সঙ্গে মহানন্দার সংযোগ করা হবে। প্রকল্পের এ অংশ প্রায় দুই লাখ ২০ হাজার বর্গকিলোমিটারে সেচের পাশাপাশি প্রায় ৩০ গিগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করবে। পাশাপাশি এটি গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায় বন্যা নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা জোরদার করবে।
টাস্কফোর্স ১৪টি নদীর মাঝে আন্তসংযোগের প্রস্তাব করেছিল। এর মধ্যে ছিল কোসি-ঘাগরা, কোসি-মেখ, ঘাগরা-যমুনা, গন্দক-গঙ্গা, যমুনা-রাজস্থান, রাজস্থান-সবরমতী, সারদা-যমুনা, ফারাক্কা-সুন্দরবন, ব্রহ্মপুত্র-গঙ্গা, সুবর্ণরেখা-মহানন্দা এবং গঙ্গা-দামোদর-সুবর্ণরেখা।
টাস্কফোর্সের মূল্যায়ন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আন্তনদী-সংযোগের মাধ্যমে ২০৫০ সালের মধ্যে ভারতের আবাদি জমির পরিমাণ ১৪ কোটি হেক্টর থেকে বেড়ে ১৬ কোটি হেক্টর হবে।
আন্তসংযোগ প্রকল্পের বিরুদ্ধে সোচ্চার ভারতীয় পরিবেশবাদী গোপাল কৃষ্ণা বলেন, প্রকৃতির ওপর হস্তক্ষেপ করে ভারতের সুপ্রিম কোর্টের এত বড় নির্দেশনা দেওয়ার এখতিয়ার নেই। এর মাধ্যমে সুপ্রিম কোর্ট বিতর্কের জন্ম দিল।
২০০২ সাল থেকে আন্তনদী-সংযোগের বিরুদ্ধে সোচ্চার এই পরিবেশকর্মী বলেন, এটা অর্থনৈতিক ও পরিবেশগতভাবে মহাবিপর্যয় সৃষ্টি করবে। বাংলাদেশ, ভারত ও নেপালের জন্য পরিবেশগত হুমকি তৈরি করবে।