যেভাবে হত্যা করা হয় মাওলানা ফারুকীকে

যেভাবে হত্যা করা হয় মাওলানা ফারুকীকে

farukiখুন করার আগে ঘাতকরা শাইখ নুরুল ইসলাম ফারুকীকে বলেছিল, ‘আল্লাহ্‌কে ডাকেন হুজুর। কি কি দোয়া জানা  
আছে পড়ে নেন।’ তিনি দোয়া পড়তে শুরু করেন। তারপরই ঘাতকরা তাদের নৃশংস অপারেশন চালায়। বাসায় প্রবেশের সময় থেকে হত্যাকাণ্ড সংঘটন পর্যন্ত সর্বোচ্চ ২০ মিনিট সময় নেয়। এই হত্যাকাণ্ড ঘটাতে তিন দিন ধরে ফারুকীর পূর্ব রাজাবাজারের বাসায় যাতায়াত করেছে দুর্বৃত্তরা। তবে তার অনেক আগে থেকেই ফারুকীকে হত্যার হুমকি দেয়া হয়েছে। হামলা করা হয়েছে তার গাড়িতে। এ সব কারণে জীবন নিয়ে শঙ্কিত ছিলেন নুরুল ইসলাম ফারুকী। তিনি তার সন্তানদের প্রায়ই বলতেন, আমাকে ওরা বাঁচতে দেবে না। তবে তোরা সাবধানে থাকিস্‌। নুরুল ইসলাম ফারুকীর পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে আলাপকালে জানা গেছে এসব তথ্য। তারা মনে করেন ধর্মীয় মতবিরোধের কারণেই ফারুকীকে হত্যা করা হয়েছে। এছাড়া তার কোন শত্রু ছিল না বলে দাবি করেন তারা। যদিও পুলিশ সম্ভাব্য আরও কিছু কারণ সামনে  রেখে ঘটনা তদন্ত করছে। পুলিশের তেজগাঁও জোনের উপ-কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার বলেন, ধর্মীয় মতবিরোধের পাশাপাশি পারিবারিক, ব্যবসায়িক কোন শত্রু ছিল কিনা তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
নিহত ফারুকীর পরিবারের বিভিন্ন সদস্যের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ঘটনার শুরু থেকেই ফারুকীসহ বাসায় ছিলেন তার স্ত্রী লুবনা কুলসুম, ভাগ্নে মুহাম্মদ মারুফ, শাশুড়ি জয়গুণ নেসা, গৃহপরিচারিকা শরীফা খাতুন ও ফারুকীর দুই নারী ভক্ত। এই দুই নারী প্রায়ই ফারুকীর বাসায় আসা-যাওয়া করতেন। নুরুল ইসলাম ফারুকী তার মালিকানাধীন ফারুকী ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেলসের মাধ্যমে হজে লোক পাঠাতেন। মারুফ জানান, দুর্বৃত্তদের দু’জন ফারুকীকে হত্যার আগে আরও দু’দিন হজ সংক্রান্ত কাজের অজুহাতে বাসায় গিয়েছিল। প্রথমে তারা ওই বাসায় যায় ২৫শে আগস্ট সন্ধ্যায়। তাদের বয়স ২৫ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে। একজন ফর্সা, চোখে চশমা। অন্যজন শ্যামলা। কলিংবেল বাজতেই দরজা খুলে দেয় মারুফ। পরে ড্রয়িংরুমে বসে ফারুকী তাদের সঙ্গে কথা বলেন। হজ সংক্রান্ত বিষয়েই তারা কথা বলেছেন বলে জানান মারুফ। ওইদিন অল্প সময় কথা বলে তারা চলে যায়। পরদিন একই সময়ে ফারুকীর বাসায় যায় ওই দুই যুবক। কিন্তু সেদিন ফারুকী বাসার বাইরে থাকায় তারা চলে যায়। সর্বশেষ গত বুধবার সন্ধ্যার পর দুর্বৃত্তদের ওই দু’জন ফারুকীর বাসায় যায়। সন্ধ্যা ৭টা ২০ মিনিটে ফার্মগেট থেকে বাসায় ফেরে মারুফ। এ সময় ড্রয়িংরুমে তাদেরকে দেখতে পায় সে। তাদের মধ্যে একটি গ্রুপের হজে যাওয়া নিয়ে কথা হচ্ছিল। শ্যামলা ছেলেটি জানায়, বড় ভাই এলে বিস্তারিত আলাপ করা যাবে। এ সময় ফারুকী তাদের বলেন, আপনাদের ভাইদের আসতে বলেন। আমার সময় কম। বাসায় মেহমান। মোবাইল ফোনে কল দেয়ার পর কিছু সময়ের মধ্যেই ৬ থেকে ৭ জন যুবক ঘরে প্রবেশ করে। তাদের প্রত্যেকের বয়স ২৫ থেকে ৪০ বছরের মধ্যে। পরনে প্যান্ট, শার্ট ও টি-শার্ট। ড্রয়িংরুমে বসার চেয়ার না থাকায় একজন দাঁড়িয়ে ছিল। ফারুকী তার জন্য চেয়ার আনতে বলেন। মারুফ চেয়ার নিয়ে যেতেই দেখে ড্রয়িংরুমের এক কোণে ফারুকীর মাথায় পিস্তল ও গলায় রামদা ধরে আছে তিন যুবক। সঙ্গে সঙ্গে মারুফের গলায় চাপাতি ধরে এক যুবক বলে, কোন চালাকি বা শব্দ করলে জানে মেরে ফেলবো। দুর্বৃত্তরা তখন ফারুকীর কাছে জানতে চায়, এটা কে?  ফারুকী বলেন, এটা আমার ভাগ্নে। ওরে মারবেন না। দুর্বৃত্তদের একজন তখন বলে, ভাগ্নের চিন্তা করিস্‌ না, আগে নিজের চিন্তা কর্‌। দুর্বৃত্তরা জানতে চায়, তোর কাছে ৫০ লাখ টাকা আছে। টাকা কোথায় রেখেছিস্‌। ফারুকী তাদের জানান, এত টাকা বাসায় নেই। টাকা যা আছে তা দিয়ে দেবো। কয়েক মিনিটের মধ্যেই ড্রয়িংরুমের খাটের চাদর ছিঁড়ে ফারুকী ও মারুফের হাত ও মুখ বাঁধে দুর্বৃত্তরা। মুখ বাঁধার আগে ফারুকী অনুনয় করে বলেন, আমার হাতটা ভাঙা একটু খুলে দেন। সঙ্গে সঙ্গে ফারুকীকে পা দিয়ে আঘাত করে একজন। এ সময় ফারুকীকে তাদের অন্য একজন বলে, ‘আল্লাহ্‌কে ডাকেন হুজুর। কি কি দোয়া শিখেছেন পড়ে নেন।’ 
নুরুল ইসলাম ফারুকীর স্ত্রী লুবনা জানান, ফারুকীর কাছে বিভিন্ন শ্রেণীর লোকজন আসা-যাওয়া করতো। নারীরা বেডরুমে যেতো। তাদের সঙ্গে কথা হতো। কিন্তু পুরুষদের সঙ্গে কথা হতো না। এমনকি পুরুষরা ড্রয়িংরুমে থাকলে পর্দা মেনে চলতেন বাসার নারীরা। তারা ড্রয়িংরুমে যেতেন না। যে কারণে ড্রয়িংরুমে কি হচ্ছিল তারা বুঝতে পারেননি। হঠাৎ বেডরুমে ছুটে যায় দুর্বত্তরা। কিছু বুঝে ওঠার আগেই অস্ত্র উঁচিয়ে জিম্মি করে তাকেসহ শাশুড়ি, গৃহপরিচারিকা ও ফারুকীর দুই নারী ভক্তের হাত ও মুখ বাঁধে তারা। মুখ বাঁধার পর এক বেডরুমে বাসার সকল নারীকে আটক রাখে দুর্বৃত্তরা। এর মধ্যেই কলিংবেল বাজে। অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে দরজা খুলে দুর্বৃত্তরা আগত তিন জনের একই কায়দায় হাত ও চোখ বাঁধে। শফিক, রফিক ও বেলাল নামের এই তিন ব্যক্তি একটি মাহফিলে ফারুকীকে দাওয়াত দিতে গিয়েছিলেন বলে তারা পুলিশকে জানিয়েছেন। ওই তিন ব্যক্তি ড্রয়িংরুমে প্রবেশের পর মারুফ তার হাতের বাঁধন খোলার চেষ্টা করলে দুর্বত্তরা তাকে মারধর করে। তাদের একজনের চড়ের আঘাতে জ্ঞান হারায় সে।
টাকা কোথায় আছে তা দেখিয়ে দেয়ার জন্য ফারুকীকে টেনে ড্রাইনিং রুমে নিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা। এ সময় ফারুকীকে রামদা দিয়ে কুপিয়ে ও গলা কেটে খুন করা হয়। তার গলায় এলোপাতাড়ি আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে। ফারুকীকে খুন করার পর লুবনাকে দুর্বৃত্তরা ‘তোদের কাউকে বাঁচিয়ে রাখবো না’ বলে হুমকি দিয়ে চলে যায়। দুর্বৃত্তরা চলে যাওয়ার পর নিজেই নিজের হাতের বাঁধন খুলে চিৎকার করেছেন লুবনা। চিৎকার শুনে প্রতিবেশী ফাতেমা বেগম ছুটে যান ওই বাসায়। তখন রক্তে ভেসে গেছে ডাইনিং রুম। মেঝেতে ফারুকীর নিথর দেহ। কিছু সময় পরে বাসায় ফিরে এই দৃশ্য দেখেন ফারুকীর মেজ ছেলে নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির ছাত্র ফয়সাল ফারুকী। লুবনা ও মারুফ জানান, ২০ মিনিটের মধ্যেই দুর্বৃত্তরা হাত বাঁধা থেকে শুরু করে ফারুকীকে হত্যা করেছে।
ফয়সাল ফারুকী জানান, দুর্বত্তরা আলমারি ভেঙে দেড় লক্ষাধিক টাকা মূল্যের স্বর্ণালঙ্কার ও নগদ ২ লাখ টাকা নিয়ে গেছে। তবে টাকা বা স্বর্ণালঙ্কার নেয়া তাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল না দাবি করে তিনি বলেন, ইসলামী মতবিরোধের কারণেই তাকে হত্যা করা হয়েছে। তিনি জানান, শাইখ নূরুল ইসলাম ফারুকী হিযবুত তাওহীদ, জামায়াতে ইসলামী ও হেফাজতে ইসলামের বিরোধিতা করতেন। তিনি হযরত মুহম্মদ (সাঃ)-এর শানে দাঁড়িয়ে মিলাদ ও মাজারের পক্ষে মত পোষণ করতেন। একই সঙ্গে তিনি সুন্নি ভিত্তিক সংগঠন আহ্‌লে সুন্নাত ওয়াল জামাতের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক ও ইসলামিক ফ্রন্টের প্রেসিডিয়াম সদস্য ছিলেন। এর কারণেই তাকে হত্যা করা হতে পারে। ফয়সাল আরও জানান, গত বছরের শুরুতে তাকে দুর্বৃত্তরা ফোনে হুমকি দিয়ে বলেছে, জুমা পড়ানোর আগে তুই কাফনের কাপড় নিয়ে তৈরি থাকিস্‌। শুধু তাই নয়, গত এপ্রিলে টাঙ্গাইলে একটি ওয়াজ মাহফিলে বক্তব্য দিয়ে ফেরার পথে তার গাড়িতে হামলা চালিয়েছিল দুর্বৃত্তরা।
উল্লেখ্য, বেসরকারি স্যাটেলাইট টেলিভিশন চ্যানেল আইয়ের উপস্থাপক শাইখ নূরুল ইসলাম ফারুকী ১৯৫৯ সালের ২৪শে নভেম্বর পঞ্চগড় জেলার নাউতারী নবাবগঞ্জ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা মাওলানা জামশেদ আলী। মাওলানা ফারুকী সংসার জীবনে দুই বিয়ে করেন। তার প্রথম স্ত্রী আয়শা বেগমের গর্ভে তিন সন্তান মাসুদ রেজা, হুমায়রা তাবাসুম তুবা ও লাবনী লুবা। তারা থাকেন মালিবাগে। দ্বিতীয় স্ত্রী লুবনা কুলসুমের তিন সন্তান- আহমদ রেজা, ফয়সাল ফারুকী ও ফুয়াদ আল মাহদী। ঘটনার দিন দ্বিতীয় স্ত্রীর পূর্ব রাজাবাজারের বাসায় ছিলেন ফারুকী। দুই স্ত্রীর সঙ্গেই তার ভাল সম্পর্ক ছিল বলে তার স্বজনরা জানান। নুরুল ইসলাম ফারুকী নীলফামারী জেলার ডোমার থানার অন্তর্গত চিলাহাটি জামিউল উলুম সিনিয়র মাদরাসা থেকে ১৯৭৫ সালে দাখিল ও পরবর্তীতে আলিম পাস করেন। ১৯৮১ সালে পুরান ঢাকার রায়সাহেব বাজার জামে মসজিদের খতিব হিসেবে যোগ দেন। ঢাকাসহ বিভিন্ন মসজিদে ৩৩ বছর ইমাম ও খতিবের দায়িত্ব পালন করেন। পাশাপাশি বিভিন্ন আলিয়া মাদরাসায় ১৫ বছর শিক্ষকতা, রেডিও, টেলিভিশনে ২৫ বছর ওয়াজ-নসিয়তের অনুষ্ঠান করেন। তার উল্লেখযোগ্য অনুষ্ঠানের মধ্যে ‘কাফেলা’ ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে। তিনি হযরত শরফদ্দিন চিশতির দরবারের খাদেম ও সুপ্রিম কোর্ট জামে মসজিদের খতিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। গতকাল আসর নামাযের পর চ্যানেল আই প্রাঙ্গণে নিহত নুরুল ইসলাম ফারুকীর প্রথম নামাজে জানাজা হয়। মাগরিবের পর পূর্ব রাজাবাজারে তার দ্বিতীয় জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। আজ জুমার পর জাতীয় ঈদগাহে মরহুমের তৃতীয় জানাযা হবে।
থানায় ডাকাতি ও হত্যা মামলা: রাজাবাজারের নিজ বাসায় মাওলানা নূরুল ইসলাম ফারুকীকে গলা কেটে হত্যার ঘটনায় নিহতের মেজো ছেলে ফয়সাল ফারুকী বাদী হয়ে শেরেবাংলানগর থানায় একটি মামলা (নং ২৭) দায়ের করেছেন। মামলায় ডাকাতির উদ্দেশ্যে প্রথমে ২ জন ও পরে ৬-৭ জন লোক তাদের বাসায় ঢুকে তার পিতাকে হত্যা করে বলে অভিযোগ করেছে। মামলার এজাহারে সূত্রে জানা গেছে, দুর্বৃত্তরা নিহত ফারুকীর শয়ন কক্ষের একটি স্টিলের ফাইল কেবিনেটের ড্রয়ার থেকে নগদ ২ লাখ টাকা, দেড় লাখ টাকা মূল্যের একটি সনি ক্যামেরা, একটি স্যামসাং ট্যাব, তিন জোড়া স্বর্ণের কানের দুল, তিনটি স্বর্ণের চেইন, চারটি স্বর্ণের আংটি নিয়ে যায়। ঘটনাটি সন্ধ্যা ৭টা থেকে ৮টা ৫ মিনিট পর্যন্ত ঘটে। ফয়সাল ফারুকী বলেন, আসামিরা পূর্ব পরিকল্পিতভাবে তার পিতাকে হত্যা করেছে।
চট্টগ্রামে গাড়ি ভাঙচুর, আগুন, অবরোধ
স্টাফ রিপোর্টার, চট্টগ্রাম থেকে জানান, ইসলামি চিন্তাবিদ ও চ্যানেল আইয়ের জনপ্রিয় উপস্থাপক মাওলানা নুরুল ইসলাম ফারুকীর হত্যাকারীদের শনিবার সন্ধ্যা ৬টার মধ্যে গ্রেপ্তারের আলটিমেটাম দিয়েছেন তার চট্টগ্রামের কর্মী-সমর্থকরা। এ সময়ের মধ্যে তাদের গ্রেপ্তার করা না গেলে একই সঙ্গে আগামী রোববার সারা দেশে সকাল সন্ধ্যা হরতাল পালিত হবে বলে তারা ঘোষণা দিয়েছেন। গতকাল বিকালে নগরীর প্রেস ক্লাবের সামনে হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে সমাবেশ আয়োজন করা হয়। সেখানে এই কথা জানান ইসলামী ছাত্র সেনার নেতারা। এর আগে মাওলানা নুরুল ইসলাম ফারুকীর হত্যাকারীদের শাস্তির দাবিতে প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করেন আহলে সুন্নাত ওয়াল জমা’আত নামের আরেকটি সংগঠন। সেখানে তারা সারা দেশের সব মাদরাসার ছাত্রদের নিয়ে আজ থেকে প্রতিদিন বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করার কথা জানিয়েছেন। অন্যদিকে এ ঘটনার সঙ্গে নিজেদের জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করেছেন হেফাজতে ইসলামের নেতারা।
দফায় দফায় সংঘর্ষ: মাওলানা নুরুল ইসলাম ফারুকীকে হত্যার ঘটনায় উত্তাল হয়ে উঠেছে চট্টগ্রাম। ঘটনার পরপরই তার সমর্থকরা ২০-৩০টি গাড়ি ভাঙচুর করেছে। রাস্তার মোড়ে মোড়ে টায়ার জ্বালিয়ে বন্ধ করে দিয়েছে সব ধরনের যানচলাচল। 
নগরীর বেশির ভাগ মার্কেটের দোকানপাট বন্ধ রাখা হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল থেকে সংঘাতময় পরিস্থিতি এড়াতে শহরে প্রচুর পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। নগরীর পাঁচলাইশ থানার ওসি মোহাম্মদ মহিউদ্দিন মাহমুদ বলেন, বিক্ষোভকারীরা অনেক গাড়ি ভেঙে চুরমার করেছে। কোন কোন জায়গায় আগুন ধরিয়ে দিয়েছে বলে শুনেছি। এ মুহূর্তে রাস্তায় আগুন দিয়ে ওরা সব ধরনের বাস বন্ধ করে দিয়েছে। আমরা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করছি।
বাস মালিক সমিতির নেতারা জানান, অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার আশঙ্কায় আজ তারা চট্টগ্রামের সঙ্গে ঢাকা, কক্সবাজার, রাঙামাটি, বান্দারবান ও খাগড়াছড়ি সড়কের যানচলাচল অনেক কম রেখেছেন। বুধবার গভীর রাত থেকে নগরীর বহদ্দারহাট, মুরাদপুর, জিইসি, অক্সিজেন, ফতেয়াবাদ, হাটহাজারী মাদরাসার মোড়, শহরের বাইরে পটিয়া, চন্দনাইশ, সাতকানিয়া, লোহাগাড়া ও সীতাকুণ্ড সড়কে অবস্থান নিয়েছে মাওলানা নুরুল ইসলাম ফারুকীর শ’ শ’ কর্মী-সমর্থক। তারা ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের অবিলম্বে খুঁজে বের করার দাবি জানিয়েছেন। অন্যথায় সারা দেশে আগুন জ্বলবে বলে হুমকি দেয়ায় বড় গাড়ি চলাচল বন্ধ রয়েছে। 
ঘটনার পর থেকে বৃহস্পতিবার সকাল ১২টা পর্যন্ত চট্টগ্রামের বিভিন্ন জায়গা থেকে পুলিশ ২০ জনকে আটক করেছে। আন্দরকিল্লা, ফতেয়াবাদ, অলংকারের মোড়ে থেমে থেমে পুলিশের সঙ্গে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার খবর পাওয়া গেছে। 
চট্টগ্রাম আহলে সুন্নত ওয়াল জামাতের নেতা-কর্মীরা জানান, ফারুকী এ সংগঠনের একজন বড় নেতা। তাই তার হত্যার ঘটনার প্রতিবাদে সংগঠনের সব সমর্থকদের রাস্তায় নামার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। বৃহস্পতিবার সকালে হাজার হাজার কর্মী-সমর্থক মুরাদপুর জামিয়া ?আহমদিয়া সুন্নী মাদরাসার সামনে থেকে বিক্ষোভ মিছিল বের করেন। 
সুন্নত ওয়াল জামাতের সমন্বয়ক মাওলানা এম এ মনি মানবজমিনকে বলেন, এই ঘটনায় বিক্ষোভে ফেটে পড়েছে অনেক নেতা-কর্মী। তাদের আটকানো যাচ্ছে না। নিজ বাসায় একজন আলেমকে এভাবে নৃশংসভাবে হত্যা করার ঘটনায় উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়েছে সবার মাঝে। আমরা এ ঘটনার সুষ্ঠু বিচার চাই। চট্টগ্রাম থেকে হরতালসহ কঠোর কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে সারা দেশে। এ বিষয়ে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে আপনাদের পরবর্তী করণীয় জানিয়ে দেবো।
রোববার হরতালের ডাক: মাওলানা নুরুল ইসলাম ফারুকীর হত্যাকারীদের গ্রেপ্তার দাবিতে গতকাল বিকাল সাড়ে ৩টায় প্রেস ক্লাব চত্বরে সমাবেশের ডাক দেয় ছাত্রসেনা। সেখানে সংগঠনের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক জামালউদ্দিন রব্বানি রোববার হরতালের ডাক দেন। এ সময় নেতারা বলেন, ইসলামের নামে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠা জঙ্গিবাদী, বিকৃত মতাদর্শী ওহাবি-খারেজি ও আহলে হাদিসপন্থিদের বিরুদ্ধে গণমাধ্যমে সোচ্চার ভূমিকা রাখায় আল্লামা ফারুকীকে দীর্ঘদিন ধরে বহুভাবে খুন-গুমের হুমকি দেয়া হচ্ছিল। ছদ্মবেশী দুর্বৃত্তরাই তার জীবনের জন্য বড় হুমকি হয়ে দেখা দেয়। নির্মমভাবে খুনের মধ্য দিয়ে এ আশঙ্কাই সত্য প্রমাণিত হয়। আমরা সারা দেশের সব উলামা মাশায়েখ তার খুনিদের চিহ্নিত করে অবিলম্বে গ্রেপ্তারের দাবি জানাচ্ছি। 
সারা দেশে প্রতিবাদ কর্মসূচি: এর আগে বেলা ১২টায় প্রেস ক্লাবের ভেতর সংবাদ সম্মেলন করে সারা দেশে প্রতিবাদ কর্মসূচি ঘোষণা করে আহলে সুন্নাত ওয়াল জমা’আত। এ সময় হত্যাকাণ্ডের তীব্র নিন্দা জানিয়ে সংগঠনের সদস্য সচিব মোছাহেব উদ্দিন বখতিয়ার ৭ দিনের কর্মসূচি ঘোষণা করেন। এর মধ্যে রয়েছে বৃহস্পতিবার বিকালে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ, আজ শুক্রবার জুমার নামাজ শেষে মসজিদে দোয়া মাহফিল, শনিবার দেশব্যাপী প্রতিবাদ সমাবেশ, রোববার বিভাগীয় শহরে প্রতিবাদ সভা ও বিক্ষোভ মিছিল, ১লা সেপ্টেম্বর সারা দেশের মসজিদ মাদরাসায় কুলখানি ও দোয়া মাহফিল, ২রা সেপ্টেম্বর নগরীর লালদীঘি মাঠে প্রতিবাদ সভা ও বিক্ষোভ মিছিল। 
সংবাদ সম্মেলনে অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন আহলে সুন্নাত ওয়াল জমা’আতের প্রধান সমন্বয়ক এম এ মতিন, মুফতি ওবায়দুল হক নঈমী, মাওলানা আবুল কাসেম নুরী প্রমুখ। 
আমরা জড়িত নই -হেফাজত: মাওলানা নুরুল ইসলাম ফারুকীর হত্যাকাণ্ডে হেফাজতে ইসলাম জড়িত নয় বলে দাবি করেছে হেফাজতে ইসলাম। গতকাল দুপুরে বেশ কয়েকটি গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে তারা এ দাবি করেন। এসময় বিবৃতিতে হেফাজত আমীর আল্লামা শফীর বক্তব্য দিয়ে বলা হয়, হেফাজত এ ঘটনার সঙ্গে কোনভাবেই জড়িত নয়। তারা এ ঘটনা সমর্থন করে না। কতিপয় ইলেক্ট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ায় মাওলানা নুরুল ইসলাম ফারুকীর হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে হেফাজতে ইসলামকে দায়ী করে যে উদ্দেশ্যমূলক মিথ্যা সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে আমরা এর প্রতিবাদ জানাচ্ছি। 
হেফাজতে ইসলাম একটি অরাজনৈতিক সংগঠন। এই সংগঠন দেশে শান্তিশৃঙ্খলা, ন্যায় ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সর্বস্তরের তৌহিদি জনতাকে সঙ্গে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। আমরা হত্যা-সন্ত্রাস-খুন-রাহাজানি-জুলুম-নির্যাতনে বিশ্বাস করি না। এটা ইসলামের মৌলিক আদর্শের পরিপন্থী। হেফাজতে ইসলাম মহানবী (সা.)এর সুন্নাহ প্রতিষ্ঠায় নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। 
এদেশের আলেম-ওলামা কোনও অন্যায় কাজ কিংবা সামাজিক স্থিতিশীলতা বিঘ্নিত করার আইনবিরোধী কাজে জড়িত নয়। তাই মাওলানা ফারুকীর হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে হেফাজতে ইসলামকে জড়ানো উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং ধর্মপ্রাণ জনসাধারণের মাঝে বিভ্রান্তি সৃষ্টির মাধ্যমে দেশে সংঘাতময় পরিস্থিতি তৈরি করার একটি সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্র। 
একজন আলেম হত্যার ঘটনায় দেশের মানুষ গভীরভাবে মর্মাহত। সুতরাং এই নির্মম হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের বের করে আইনের আওতায় না আনা পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট সবাইকে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে কাউকে দায়ী করে প্রকৃত খুনিদের আড়াল করা কখনও দায়িত্বপূর্ণ কাজ হবে না।    
বিবৃতিতে আল্লামা শাহ আহমদ শফী বলেন, একজন আলেমকে জবাই করে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা একটি বর্বর দৃষ্টান্ত। এই জঘন্য হত্যাকাণ্ডের নিন্দা জানানোর ভাষা আমাদের নেই। আমি নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে মাওলানা ফারুকীর প্রকৃত  হত্যাকারীদের খুঁজে বের করে দৃষ্টান্তমূলক কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করার জন্য সরকারের প্রতি জোর দাবি জানাচ্ছি। তার শোকসন্তপ্ত পরিবারবর্গের প্রতি গভীর সমবেদনা জানাচ্ছি।     
নারায়ণগঞ্জে সড়ক অবরোধ
স্টাফ রিপোর্টার, নারায়ণগঞ্জ থেকে জানান, বাংলাদেশের সুন্নী আলেম আল্লামা নূরুল ইসলাম ফারুকী হত্যার প্রতিবাদে নারায়ণগঞ্জ শহরের প্রেস ক্লাবের সামনে বৃহস্পতিবার সকালে প্রায় পৌনে ১ ঘণ্টা রাস্তা অবরোধ করে বিক্ষোভ মিছিল করেন আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের নারায়ণগঞ্জ জেলা নেতৃবৃন্দ। এ সময় বক্তারা ৭১-এর পরাজিত শক্তি জামায়াত-শিবিরকে এ হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী করেন এবং অবিলম্বে এ হত্যাকারীদের গ্রেপ্তার করে ফাঁসি দেয়ার জন্য সরকারের প্রতি জোর দাবি জানান।
বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ১০টায় শহরের ডিআইটি বাণিজ্যিক এলাকায় আলী আহাম্মদ চুনকা পৌর পাঠাগারের সামনে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাত বাংলাদেশ নারায়ণগঞ্জ জেলা শাখার উদ্যোগে প্রথমে মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। পরে তারা ১১টা ১০ মিনিটে মানববন্ধন শেষে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে নারায়ণগঞ্জ প্রেস ক্লাবের সামনে রাস্তা অবরোধ করেন। এভাবে চলে প্রায় পৌনে এক ঘণ্টা। এসময় বিক্ষোভ মিছিল থেকে জামায়াত-শিবিরকে গ্রেপ্তার করার দাবি ও হেফাজত ইসলামের আমীর আল্লামা আহমেদ শফীর নামে কটাক্ষ করা হয় এবং ২৪ ঘণ্টার মধ্যে অপরাধীদের গ্রেপ্তার করে শাস্তি না দেয়া হলে বৃহত্তর আন্দোলনের হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করা হয়। 
আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের নারায়ণগঞ্জ জেলা শাখার সভাপতি মুফতি আলী আকবরের সভাপতিত্বে উপস্থিত ছিলেন সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক মাওলানা মহিউদ্দিন হামিদী আল কাদেরী, ইসলামী ছাত্র সেনা নারায়ণগঞ্জ জেলার সাবেক সভাপতি আবুল হোসেন। আর উপস্থিত ছিলেন মুফতি ইরাজুল ইসলাম মনির, মাওলানা হাফেজ আইয়ুব আলী, মাওলানা জামাল উদ্দিন নূরী, মাওলানা আনিসুর রহমান, মাওলানা তামিম বিল্লাহ, মাওলানা আবু নাসের মুসা, মাওলানা শহিদুল আবেদী, মাওলানা আনোয়ার হোসেন চাঁদপুরী, মাওলানা জাকারিয়া আত তাহেরী, মাওলানা সাইফুল আজিজ, মুক্তিযোদ্ধা আবু জাফর টিপু, মো. মোবারক হোসেন, মো. আবুল হোসাইন, মো. আফজাল হোসেন, মীর জয়নাল আবেদীন, সাইফুল ইসলাম জিহাদ, মো. মামুন, পারভেজ প্রমুখ।
আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের নারায়ণগঞ্জ জেলা শাখার সভাপতি মুফতি আলী আকবর বলেন, ইসলাম ধর্মের বিভ্রান্তি সৃষ্টিকারীদের থেকে ইসলামকে রক্ষা করার জন্য টেলিভিশনে ইসলামিক অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করে ইসলামের সঠিক পথ ও মত আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের মতাদর্শ প্রচারের মাধ্যমে দেশে ও বিদেশে একজন ইসলামী আইকন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। ইসলামের বিভ্রান্তি সৃষ্টিকারীদের সঠিক জবাব দেয়ার কারণেই এমন একজন আলেমকে হত্যা করা হয়েছে। আমরা এ হত্যাকারীদের প্রতি তীব্র ঘৃণা প্রকাশ করছি।
ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক অবরোধ
আশুগঞ্জ (ব্রাহ্মণবাড়ীয়া) প্রতিনিধি জানান, চ্যানেল আইয়ের হজ কাফেলা ও শান্তির পথ অনুষ্ঠানের উপস্থাপক মাওলানা নুরুল ইসলাম ফারুকীকে হত্যার প্রতিবাদে গতকাল দুপুরে আশুগঞ্জের গোলচত্বর এলাকায় ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক অবরোধ করেছে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের হাজারো নেতাকর্মী। এ সময় টায়ারে আগুন দিয়ে বিক্ষোভ মিছিল করেছে তারা। এ অবরোধের কারণে মহাসড়কের উভয় পাশে আটকা পড়ে শতাধিক যানবাহন। এ সময় অবরোধকারীরা একটি ট্রাকে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করে। দুপুর দেড়টা থেকে ৩টা পর্যন্ত প্রায় দেড়ঘণ্টা যান চলাচল বন্ধ থাকায় উভয় পাশে কয়েক হাজার বাসযাত্রী দুর্ভোগের শিকার হয়। পরে উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আবু আসিফ আহমেদ, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সন্দ্বীপ কুমার সিংহ ও স্থানীয় প্রশাসনের আশ্বাসের পর মহাসড়ক থেকে অবরোধ তুলে নেন অবরোধকারীরা। এদিকে, আগামী শনিবার এ হত্যাকাণ্ডের বিচারের দাবিতে প্রতিবাদ সমাবেশের ডাক দেয়েছে তারা। এবং এ সমাবেশে থেকে কঠোর আন্দোলনের কর্মসূচি দেয়া হবে বলে জানিয়েছেন নেতৃবৃন্দ। 
আশুগঞ্জ উপজেলা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের সভাপতি মাওলানা মহিউদ্দিন মোল্লার সভাপতিত্বে প্রতিবাদ সভায় বক্তব্য রাখেন মাওলানা নূরুল ইসলাম কাদেরী, মাওলানা বাকী বিল্লাহ, মিজানুর রহমান, সাইদুর রহমান, মনিরুজ্জামান হানাফি, মাওলানা এরশাদুল ইসলাম, হাফেজ আতাউল্লাহ, মাওলানা মহিউদ্দিন মোল্লা, মাওলানা মাসুম বিল্লাহ, মাওলানা আমিনুল হক, মাওলানা এমদাদুল হক প্রমুখ।      

অন্যান্য জেলা সংবাদ বাংলাদেশ