বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেছেন, দল মত বিশ্বাস ও দর্শন যার-যার, কিন্তু দেশটা আমাদের সবার। তিনি বলেন, দেশটা কারো একার নয়, কারো বাবার নয়, আমাদের সবার।
মঙ্গলবার লন্ডনের রমফোর্ডে যুক্তরাজ্য বিএনপি আয়োজিত ইফতার মাহফিলে তিনি এ কথা বলেন।
তারেক রহমান বলেন, “বিশ্ব অর্থনীতির পালা বদলে এবং ভৌগোলিক কারণে গ্লোবাল ভিলেজে বাংলাদেশ এক অপার সম্ভাবনার নাম। কিন্তু এই সম্ভাবনার সফল বাস্তবায়ন নির্ভর করবে সবার কাজ, দায়বদ্ধতা, ঐক্য ও অর্জনের ওপর। তাই স্বনির্ভর বাংলাদেশ গড়তে প্রত্যেককে কিছু কিছু ক্ষুদ্র স্বার্থের ঊর্ধ্বে ওঠা প্রয়োজন। তাহলে একটি ধ্বংসস্তুপের মধ্য থেকেও একটি উৎপাদনশীল ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তোলা সম্ভব।”
তিনি বলেন, “ একজন রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে দুই দশকের বেশি সময়ের প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ অভিজ্ঞতার আলোকে আমার নিজেরও চিন্তা, চেতনা এবং কর্মকাণ্ডজুড়ে রয়েছে একটি সমৃদ্ধশালী ও উন্নত বাংলাদেশের স্বপ্ন ও পরিকল্পনা। বিশ্ব মানচিত্রে যার পরিচয় হবে কৃষিতে স্বয়ংসম্পূর্ণ, শিল্পায়নে স্বার্থক, অর্থনীতিতে গতিশীল, মানবসম্পদে ঐশ্বর্যমণ্ডিত, সামাজিকভাবে ঐক্যবদ্ধ ও মূল্যবোধ সম্পন্ন একটি উন্নত রাষ্ট্র হিসেবে।”
সভার শুরুতেই তারেক রহমান বোখারি শরিফের একটি হাদিস উল্লেখ করেন। ওই হাদিসে বলা হয়েছে “তোমাদের কেউ সিয়ামের দিন যেন অশ্লীল কথা না বলে এবং শোরগোল ও চেঁচামেচি না করে। কেউ তাকে গালমন্দ করলে বা তার সঙ্গে ঝগড়া করলে সে শুধু বলবে, আমি সিয়াম পালনকারী।”
এরপর তারেক রহমান তার প্রায় এক ঘণ্টার বক্তব্যে একটি সমৃদ্ধ ও উন্নত বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে কৃষি, শিক্ষা কর্মসংস্থান, শিল্পায়ন, পরিবেশ ও জ্বালানি, অবকাঠামো ও স্থানীয় উন্নয়নসহ বিভিন্ন বিষয়ে তার কিছু কর্মপরিকল্পনা তুলে ধরেন।
তিনি বলেন, “কারো বিরুদ্ধে কিছু বলতে চাই না, শুধু গতানুগতিক রাজনৈতিক বক্তব্যের বাইরে একটি সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার লক্ষে কিছু উন্নয়ন পরিকল্পনা তুলে ধরতে চাই।”
তিনি বলেন, “আন্তরিকভাবে চাইলে নানা সীমাবদ্ধতার মাঝেও এমন একটি বাংলাদেশ গড়ে তোলা সম্ভব যেখানে ক্ষুধা বা দারিদ্র থাকবে না। তবে এসব পরিকল্পনা তখই বাস্তবায়িত হতে পারে যখন দেশে গণতন্ত্র ও সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হবে। উন্নয়ন ও উৎপাদনের রাজনীতির প্রতি নিবেদিত সত্যিকার অর্থে নির্বাচিত একটি সরকারের ওপর রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব অর্পিত হবে।”
সভায় সভাপতিত্ব করেন যুক্তরাজ্য বিএনপির সভাপতি শায়েস্তা চৌধুরী কুদ্দুস। সভা পরিচালনা করেন সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক কয়সর এম আহমেদ। এ সময় মঞ্চে ছিলেন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ মানবাধিকার কর্মী ব্যারিস্টার হাসনাত হোসেন এমবিই, কার্ডিফ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ডক্টর এম এ মালেক, বিএনপির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক সাবেক এমপি নাজিমুদ্দিন আলম, ইউরোপভিত্তিক প্রবাসী বাংলাদেশিদের সংগঠন সিটিজেন মুভমেন্টের আহ্বায়ক এম এ মালেক এবং যুক্তরাজ্য বিএনপির সিনিয়র নেতারা।
সভায় আরো বক্তব্য দেন যুক্তরাজ্য বিএনপির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক মাহিদুর রহমান, যুক্তরাজ্য বিএনপির ভাইস প্রেসিডেন্ট আখতার হোসেন, ছাত্র বিষয়ক সম্পাদক নাজমুল হোসেন জাহিদ এবং ধর্মবিষয়ক সম্পাদক আব্দুল মুকিত খান।
তারেক রহমান বলেন, “বিশেষজ্ঞদের ধারণা বর্তমান হারে বাড়তে থাকলে আগামী ২৫ বছরে জনসংখ্যা ২৫ থেকে ৩০ কোটি ছাড়িয়ে যাবে। কমে যাবে কৃষি ও আবাসন জমির পরিমাণ। কোটি কোটি মানুষ বঞ্চিত হবে খাদ্য, বাসস্থান, চিকিৎসা ও শিক্ষা সুবিধা থেকে। ঘনীভূত হবে পানি, গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকট। যোগাযোগ ও যানজট সমস্যা আরো প্রকট হয়ে উঠবে । শিক্ষা উপকরণ এবং অব্যবস্থাপনায় কমবে শিক্ষার হার। সঠিক কর্মসংস্থানের অভাবে শিক্ষিত বেকারের হার বাড়বে। দরিদ্র জনগণ হবে আরও দরিদ্র। ক্ষমতাধর দুর্নীতিবাজ ধনীরা হয়ে উঠবে আরও ধনী। সন্ত্রাস আচ্ছন্ন করে তুলবে সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রতিটি অঙ্গনকে। নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়বে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি। বাড়তে থাকবে সামাজিক অস্থিতিশীলতা। চলতে থাকবে রাজনৈতিক অচলাবস্থা। সব মিলিয়ে ঘটতে পারে পরিস্থিতির অনাকাঙ্ক্ষিত ও নজিরবিহীন অবনতি।”
তারেক রহমান আরো বলেন, ‘বর্তমানে বাংলাদেশ যেভাবে চলছে তাতে এমনটিই হবে অবশ্যম্ভাবী পরিণতি। তবে ভবিষ্যত আমাদের নিজেদেরই হাতে। আমরা আশা করি এমন পরিস্থিতি হবে না। হলেও একটি ধ্বংসস্তুপ থেকে আমরা গড়ে তুলবো একটি উৎপাদনশীল বাংলাদেশ, ইনশাআল্লাহ।”
তারেক রহমান বলেন, “পাবলিক সেক্টরের নানা অব্যবস্থাপনা ও অকার্যকারিতার মাঝেও দেশটা কিছু-কিছু ক্ষেত্রে ভালো করছে, তার সম্পূর্ণ কৃতিত্ব দেশের প্রাইভেট সেক্টরের। পাশাপাশি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে দেশটিকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন সাধারণ খেঁটে খাওয়া মানুষেরা। তাদের পরিশ্রম, দেশপ্রেম ও আত্মত্যাগ আমাদের প্রতিনিয়ত আশান্বিত করে তোলে। সাধারণ মানুষের প্রেরণা নিয়ে এবং তাদের চেতনাকে অন্তরে ধারণ করে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে যদি উন্নয়ন উৎপাদনের রাজনীতি নিশ্চিত করা হয় তাহলে নিশ্চিতভাবে আমাদের ভবিষ্যত হয়ে উঠবে উজ্জ্বল। ”
তারেক রহমান তার কর্মপরিকল্পনা তুলে ধরে আরো বলেন, “দেশের আনাচে-কানাচে পরিকল্পনামাফিক গড়ে তোলা সম্ভব ছোট-খাট ব্যবসা ও শিল্প প্রতিষ্ঠান। সৃষ্টি করা সম্ভব অর্ধকোটিরও বেশি কর্মক্ষেত্র। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প প্রতিষ্ঠানের বিকাশে সরকারি সহায়তা বাড়াতে হবে। শহরগুলোতে প্রয়োজনীয় নাগরিক সুবিধার পাশাপশি গ্রামগুলোতেও আধুনিক জীবনের উপকরণ নিশ্চিত করা সম্ভব। তাতে করে বিশ্ব মানচিত্রে বাংলাদেশ পরিচিত হয়ে উঠবে উন্নয়নশীল বিশ্বের কাছে একটি উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রার মডেল হিসেবে। তবে এরজন্য এখন থেকেই কাজ শুরু করতে হবে।”
কৃষি ও কৃষকদের উন্নয়নে তারেক রহমান কিছু নীতিমালা তুলে ধরে বলেন, “উন্নত দেশগুলোর মতো বাংলাদেশেও কৃষিকে একটি প্রযুক্তিনির্ভর শিল্পে পরিণত করা এখন সময়ের দাবি “ কুষি ভর্তুকির কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, “নিশ্চিত করতে হবে যাতে কৃষি খাতের সব ভর্তুকি আমদানীকারক ও মধ্যসত্বভোগীদের কাছে চলে না যায়।”
শিক্ষাব্যবস্থার আধুনিকায়ন সম্পর্কে তারেক রহমান বলেন “বর্তমানে শিক্ষাব্যবস্থার আধুনিকায়ন দূরে থাক দেশের তথাকথিত সরকার পাবলিক পরীক্ষাগুলোর আগের রাতেই প্রশ্নপত্র ফাঁস করে দিয়ে পরীক্ষায় জিপিএ – ৫ প্রাপ্তির তথাকথিত বিশ্বরেকর্ড গড়ে দেশীয় মেধার মানদণ্ডকে শুধু নষ্টই করছে না, বরং আন্তর্জাতিক শিক্ষা প্রতিযোগিতায় দেশকে হাসির পাত্রে পরিণত করছে।”
তিনি বলেন, “শিক্ষাব্যবস্থায় আমূল সংস্কার প্রয়োজন। শিক্ষাব্যবস্থাকে করতে হবে একাধারে আধুনিক, গণমুখী, কর্মমুখী ও প্রযুক্তিনির্ভর।”
চাকরিতে কোটা প্রথা প্রসঙ্গে তারেক রহমান বলেন, “মেধাবীরাই পারে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিতে। সেই মেধাবীদের সুযোগ করে দিতে সরকারী চাকরিতে কোটার হার সর্ব্বোচ্চ শতকরা পাঁচভাগে নামিয়ে আনা যেতে পারে।”
শিল্প ও বিনিয়োগ প্রসঙ্গে তারেক রহমান বলেন, “গত ছয় বছরে বর্তমান অবৈধ সরকারের ভ্রান্তনীতি আর চাটুকারিতার রাজনীতির বলি হয়ে দেশের গার্মেন্টস আর শ্রম রপ্তানিতে ধ্বস নেমেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশ পা দিয়েছে বিনিয়োগবিহীন প্রবৃদ্ধির ফাঁদে। দেশে বেসরকারি বিনিয়োগ এখন শূন্যের কোঠায়। গত কয়েক বছরে বন্ধ হয়েছে একের পর এক শিল্প ও কল-কারখানা।”
তিনি বলেন, “পরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়ন করা গেলে দেশে বর্তমানে ত্রিশ লাখ বেকারের সংখ্যা তিন লাখে নামিয়ে আনা সম্ভব। সম্ভব জনসংখ্যাকে জনশক্তিতে পরিণত করে রেমিটেন্স বাড়ানো।”
তিনি বলেন, “শ্রম, আবাসন, বিদ্যুৎ, বিপণন ও শিক্ষা এই পাঁচটি সুবিধার দিক থেকে স্বয়ংসম্পূর্ণ কয়েকটি শিল্প পার্ক নির্মাণ কাজ শুরু করা প্রয়োজন। একইসঙ্গে আরেকটি সাবমেরিন ক্যাবল বসানো দরকার, দরকার ইন্টারনেট স্পিড বাড়ানো, কমানো প্রয়োজন ব্যান্ডউইথ প্রাইস। ”
অপরিকল্পিত নগরায়ন সম্পর্কে তারেক রহমান বলেন, “দেশের প্রধান দুটি শহর ঢাকা ও চট্টগ্রামকে কেন্দ্র করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কের আদলে মেট্রোপলিটান এরিয়া গড়ে তোলা সম্ভব। ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ-গাজীপুর এই তিনটি জেলা নিয়ে গঠিত হতে পারে ঢাকা মেট্রোপলিটন এরিয়া এবং পুরো চট্টগ্রাম জেলাজুড়ে গঠিত হতে পারে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটান এরিয়া। ঢাকার ওপর থেকে চাপ কমাতে চাকরি, শিক্ষা নিরাপত্তা ও অবকাঠামো এই চারটি বিষয় বিবেচনায় রেখে ঢাকার কাছের জেলাগুলোয় কয়েকটি আধুনিক স্যাটেলাইট শহর গড়ে তোলা এখন সময়ের দাবি।”
তিনি আরো বলেন, “এমন ২০টি আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন স্যাটেলাইট শহর তৈরি করে প্রতিটিতে বর্তমানে ঢাকায় বসবাসকারী পাঁচ লাখ লোককে স্থানান্তর করা গেলে ঢাকার ওপর চাপ অনেকাংশে কমে যাবে। তবে এইসব স্যাটেলাইট শহর এমনভাবে নির্মিত হতে হবে যাতে চাষযোগ্য জমি নষ্ট না হয়। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে ঘণ্টায় ৬০ মাইল বেগে এমনভাবে রেল সংযোগ স্থাপন করার পরিকল্পনা করতে হবে যাতে রাজধানীর ৫০ থেকে৬০ মাইল দুরত্বের জেলাগুলোতেও মাত্র এক ঘণ্টায় চলে যাওয়া সম্ভব হয়।”
সভায় যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন শহর থেকে সহস্রাধিক মানুষ ইফতার মাহফিলে অংশগ্রহণ করেন।