খায় দায় ফজর আলী, মোটা হয় জব্বার’—বাংলাদেশে এটি একটি সুপ্রচলিত বুলি। আশংকা দাঁড়িয়েছে যে, বঙ্গোপসাগরের কম বা বেশি যেটুক এলাকার ওপর বাংলাদেশ আন্তর্জাতিকভাবে বৈধ অধিকারের স্বীকৃতি পেয়েছে সেই অর্জনের অবস্থা না আবার ‘ফজর আলী’ ও ‘জব্বারের’ মতো হয়ে ওঠে!
গত সপ্তাহে আন্তর্জাতিক সালিশী ট্রাইব্যুনাল বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সমুদ্রসীমা নিয়ে দীর্ঘদিনের বিরোধ নিষ্পত্তি করে রায় প্রদান করেছে। এতে বাংলাদেশের প্রাপ্তি কম হয়েছে না বেশি হয়েছে তা নিয়ে তুমুল বিতর্ক চলছে। কিন্তু ‘ফজর আলীদের’ পেরেশানের ফসল দিয়ে ‘জব্বাররা’ মোটা হওয়ায় পাঁয়তারা করছে, তা নিয়ে রাষ্ট্রের নেতাদের ও ‘বড়’ দলগুলোর যেন কোনো মাথাব্যথাই নেই। অথচ সেই বিষয়টিই এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। একদল মানুষ বলছে, বাংলাদেশ ‘সমুদ্র-জয়’ করেছে। আরেক দলের কথা, বাংলাদেশের ‘সমুদ্র-পরাজয়’ ঘটেছে। সরকারপক্ষীয়রা বলছে, প্রদত্ত সালিশী রায়ের দ্বারা বাংলাদেশ বিতর্কিত সাগর এলাকার চার-পঞ্চমাংশের ওপর তার বৈধ অধিকারের স্বীকৃতি পেয়েছে। অতএব, বাংলাদেশের ঐতিহাসিক ‘সমুদ্র-বিজয়’ সম্পন্ন হয়েছে। এই যুক্তির বিপরীতে যুক্তি দিয়ে বিএনপি বলছে যে, বাংলাদেশ বিতর্কিত সাগর এলাকায় তার ‘ন্যায্য’ দাবির এক-পঞ্চমাংশ ভারতের কাছে হারিয়েছে। এমনকি যে তালপট্টি দ্বীপ নিয়ে (ভারতীয়রা যাকে নিউ মূর নামে অভিহিত করে থাকে) একসময় দু’দেশের নৌবাহিনী ‘মুভ’ করেছিল এবং তাদের মধ্যে সংঘাত লাগে-লাগে অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল, সালিশের রায়ে সেই তালপট্টিও ভারত পেয়ে গেছে। এটি একথাই প্রমাণ করে যে, সালিশের রায় দ্বারা বাংলাদেশের ‘সমুদ্র-পরাজয়’ ঘটেছে।
বিএনপির মতামতের জবাবে সরকার পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে যে, আশির দশক পর্যন্ত তালপট্টি বলে যে দ্বীপটির অস্তিত্ব ছিল তা এখন সাগরবক্ষে বিলীন হয়ে যাওয়ায় অস্তিত্বহীন হয়ে পড়েছে। সুতরাং ‘ভারতকে তালপট্টি দিয়ে দেয়া হয়েছে’—এমন অভিযোগ সম্পূর্ণ কাল্পনিক। সরকারপক্ষীয়দের এসব কথা সঠিক। তালপট্টি দ্বীপকে এখন আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না। কিন্তু কথা হলো, সাগরের যে স্থানে একসময় এই দ্বীপটি ছিল সেই এলাকাটি কোন দেশের ভাগে পড়েছে? এ বিষয়টিই হলো সমুদ্র এলাকা পাওয়া-না পাওয়ার হিসেব কষার ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক। তালপট্টি দ্বীপ সাগর জলের উপরে থাকলো, নাকি তা সাগর জলে ডুবে গেল—সেটি বড় কথা নয়। যে এলাকায় তালপট্টি দ্বীপ ছিল তা যে ভারত পেয়েছে— একথা সোজাসুজি স্বীকার করতে সরকারের কি অসুবিধা? তালপট্টির এলাকাটি ভারতকে দেয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশ যে বিরোধপূর্ণ সাগর এলাকার প্রায় চার-পঞ্চমাংশ পেয়েছে সে প্রাপ্তির হিসেব কি তার ফলে নাকচ হয়ে যাবে? সেটুকুই কি বাংলাদেশের জন্য একটি নিট ‘অর্জন’ নয়?
বিএনপি যে যুক্তি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সামনে আনছে তাহলো বাংলাদেশ তার দাবিকৃত সমুদ্রসীমার সর্বাংশ পায়নি। আর সর্বাংশ না পাওয়ার অর্থ হলো অপর পক্ষকে কিয়দংশ দিয়ে দেয়া। অর্থাত্, দাবির সর্বাংশ না পাওয়ার অর্থ হলো ‘পরাজয়’ বরণ করা। সে হিসেবে বাংলাদেশের ‘সমুদ্র-পরাজয়’ হয়েছে। কিন্তু এই যুক্তি দেয়ার ক্ষেত্রে বিএনপি এই বিবেচনাটি সযত্নে আড়াল করছে যে—সমুদ্রসীমা নিয়ে বিরোধের গোটা বিষয়টি একটি আন্তর্জাতিক সালিশী আদালতের কাছে ‘সালিশী রায়ের’ জন্য ন্যস্ত করা হয়েছিল। সালিশের দ্বারস্থ হওয়ার পর যদি ‘সালিশ মানি, কিন্তু তালগাছটি আমার’ মনোভাব ও যুক্তি দ্বারা কেউ যদি পরিচালিত হয়, তাহলে তা মোটেও যুক্তিগ্রাহ্য বলে বিবেচনা করা যায় না। সালিশের মাধ্যমে কোনো একটি পক্ষই সবটুকু দাবি পেয়ে যাবে, এমন ভাবাটা নিছক যুক্তিহীন ছেলেমানুষী ছাড়া অন্য কিছু নয়। বিএনপি সেই ছেলেমানুষী ভাবাবেগকে উস্কে দিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা নিতে চাচ্ছে।
বিষয়টিকে ‘সমুদ্র-জয়’ বা ‘সমুদ্র-পরাজয়ের’ আঙ্গিকে মূল্যায়ন না করে রায়টিকে গ্রহণ করা হলো কি হলো না, সেটিই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এই রায়কে ভারত ‘জয়’ বা ‘পরাজয়’ হিসেবে চিহ্নিত না করে কেবল একথাই বলেছে যে, তারা রায় মেনে নিয়েছে। রায়টিকে সালিশী মীমাংসার ফসল হিসেবে বিবেচনা করাটাই যুক্তিযুক্ত। তাতে দু’পক্ষই তাদের দাবির কিয়দংশ পাবে আর কিয়দংশ পাবে না। বিরোধপূর্ণ সাগর এলাকার দাবিকৃত অংশের ৮০% শতাংশ পেয়েছে বাংলাদেশ এবং ২০% শতাংশ পেয়েছে ভারত। বাংলাদেশের এই প্রাপ্তি দেশ ও জাতির জন্য কতোটা নতুন সম্পদের সমাহার ও সুযোগের দ্বার উন্মোচিত করলো এবং তা কার স্বার্থে কিভাবে ব্যবহূত হবে— সেটিই প্রধান বিবেচনার বিষয় হওয়া উচিত। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এই বিষয়টি সম্পর্কে উভয়পক্ষ প্রায় সম্পূর্ণ নিশ্চুপ। ‘অর্জনকে’ দেশ ও জনগণের স্বার্থে সর্বাংশে কাজে লাগানো হবে কিনা সে বিষয়টি নিয়ে তাদের কারো যেন কোনো মাথাব্যথা নেই।
‘জয়’ ও ‘পরাজয়’ নিয়ে নিজ-নিজ অবস্থান উঁচুগলায় তুলে ধরে আবেগী বিতর্কে লিপ্ত হওয়ার পেছনের আসল কারণ হলো দেশ ও জাতির স্বার্থের বিবেচনার চেয়ে ক্ষমতার প্রশ্নে লড়াইয়ে একে-অপরকে কাবু করতে পারার প্রয়াস। তাই, সরকার পক্ষ সুযোগমতো বলে চলেছে যে ‘৫ জানুয়ারির নির্বাচন না হলে এই সমুদ্র-জয় সম্ভব হতো না’। অন্যদিকে বিএনপি বলে চলেছে যে, ‘সরকারের দুর্বলতা ও ভারত-প্রীতির কারণে তালপট্টি হাতছাড়া করে এরূপ সমুদ্র-পরাজয় ঘটেছে। উভয় পক্ষের কথাবার্তায় ক্ষমতার জন্য কামড়া-কামড়ি প্রসূত কুযুক্তি ও আস্ফাালনের প্রাধান্য বেশ স্পষ্ট। মিয়ানমার ও ভারতের সাথে সমুদ্রসীমা বিরোধটি আমরা উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছি। বিরোধটি বছরের পর বছর ঝুলে থাকলেও আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে তা নিরসনের চেষ্টা তেমন কোনো সফলতা আনেনি। বিরোধ নিষ্পত্তির ভিন্নতর কোনো পন্থায় কোনরূপ পদক্ষেপও এ সময়কালে নেয়া হয়নি। ২০০৮ সালে মিয়ানমারের সাথে বাংলাদেশের নৌ-সংঘর্ষের উপক্রম ঘটেছিল। তখনই সরকার এই বিরোধ মীমাংসার জন্য জার্মানীর হামবুর্গে স্থায়ী ‘সমুদ্র আইন বিষয়ক আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে’ (ITLOS) মামলা করে। এই আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল দু’পক্ষের যুক্তি-তর্ক শুনে রায় দেয়। সেই রায় অনুযায়ী যে ৮০ হাজার বর্গ কিলোমিটার সাগর এলাকা নিয়ে মিয়ানমারের সাথে বাংলাদেশের বিরোধ ছিল তার মধ্যে বাংলাদেশ পায় ৭০ হাজার বর্গ কিলোমিটার। সে সময়ই বাংলাদেশ ও ভারত উভয় দেশ তাদের মধ্যকার সমুদ্রসীমা নিয়ে বিরোধের বিষয়টি ITLOS-এর বদলে এডহক আন্তর্জাতিক সালিশের মাধ্যমে নিষ্পত্তির বিষয়ে একমত হয়। সেই অনুসারে বিরোধীয় গোটা বিষয়টি UNCLOS-এর বিধান অনুসারে হেগের স্থায়ী সালিশ আদালত বা পার্মানেন্ট কোর্ট অব আর্বিট্রেশনের (PCA) সমীপে রায়ের জন্য ন্যস্ত করা হয়। সেই সালিশী আদালত গত ৮ জুলাই তাদের রায় প্রদান করেছে। সেই রায় ৯ জুলাই জনসম্মুখে প্রকাশ করা হয়েছে। সেই রায়ের মাধ্যমে সাগর অঞ্চলের ক্ষেত্রে প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি নিয়েই জয়-পরাজয়ের বিতর্ক।
এককালে সমুদ্র-সাগর ছিল প্রধানত দূর-দূরান্তে যাতায়াতের পথ হিসেবে গুরুত্ববাহী। তাছাড়া তা ছিল মত্স্য সম্পদসহ আরো কিছু সামুদ্রিক সম্পদের জন্য মূল্যবান। তেমন অবস্থায় বিভিন্ন দেশের নিজ-নিজ সমুদ্রসীমা চিহ্নিত করার কোনো গুরুত্ব তেমন ছিল না। কিন্তু সাম্প্রতিক কালে সমুদ্রবক্ষ থেকে তেল-গ্যাসসহ জৈব জ্বালানি উত্তোলনের পথ তৈরি হয়েছে এবং সমুদ্র তলদেশ অন্যান্য মহামূল্যবান প্রাকৃতিক ও খনিজ সম্পদের উত্স হতে পারে বলে আবিষ্কৃত হয়েছে। ফলে সমুদ্রসীমা চিহ্নিতকরণের বিষয়টি ছোট-বড় সব দেশের জন্যই এখন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
ব্রিটিশ আমলে সমুদ্রসীমা চিহ্নিতকরণের বিষয়টি তাই তেমন গুরুত্ব পায়নি। গোটা পাকিস্তান আমলে মিয়ানমারের সাথে সমুদ্রসীমা চিহ্নিতকরণ নিয়ে কোনো পদক্ষেপ নেয়া যায়নি। বিষয়টি আগাগোড়াই ঝুলে ছিল। ১৯৪৭ সালে পার্টিশনের সময় দেশ-ভাগের সীমানা এঁকে দেয়ার দায়িত্ব পড়েছিল স্যার সিরিল র্যাডক্লিফের ওপর। তিনি পূর্ববাংলা (পূর্ব পাকিস্তান) ও ভারতের ভূখণ্ডীয় সীমানা নির্ধারণ করে মানচিত্রে যে লাইন টেনে দিয়েছিলেন সেটিই হয়ে ওঠে ‘বৈধ’ আন্তর্জাতিক সীমান্ত রেখা। তার আঁকা পশ্চিমদিকের পার্টিশন লাইনটি দক্ষিণে সুন্দরবন এলাকা অতিক্রম করে বঙ্গোপসাগরের উপকূলের একটু নিচে এসে শেষ হয়ে যায়। সমুদ্রের ভেতর তা আর প্রসারিত করা হয়নি। র্যাডক্লিফের নির্ধারিত লাইন ধরেই বাংলাদেশের ভূখণ্ড চিহ্নিত। তা নিয়ে প্রশ্ন তোলার কোনো অবকাশ নেই। কিন্তু যে বিষয়টি বিরোধীয় হয়ে ওঠে সেটি হলো এই যে, র্যাডক্লিফের লাইন যেখানে শেষ হয়েছে সেটিকে বেইস পয়েন্ট হিসেবে ধরে নিয়ে সমুদ্রের সীমারেখাটি কতো ডিগ্রি বরাবর টেনে চিহ্নিত করা হবে? বাংলাদেশের দাবি ছিল ১৮০ ডিগ্রি। আর ভারতের দাবি ছিল যে তা ১৬২ ডিগ্রি ধরে সেই সীমান্ত রেখা নির্ধারণ করা হোক। সালিশী ট্রাইব্যুনাল তা ১৭৭.৩ ডিগ্রি ধরে নির্ধারণ করে দিয়েছে। তাতে বাংলাদেশের তুলনামূলক প্রাপ্তি বেশি হয়েছে। এক্ষেত্রে ন্যায্যতার (equity) নীতি অনুসারে এ্যাডজাস্ট করে সমদূরত্ব (equidistant) নীতি অনুসরণ করে বাংলাদেশের অনুকূলে সীমান্ত রেখা টানা হয়েছে।
প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির হিসাব করার পাশাপাশি এই হিসাবটিও কি গুরুত্বপূর্ণ নয় যে, সমুদ্রসীমা নিয়ে বিরোধের একটি শান্তিপূর্ণ আইনী মীমাংসা হয়েছে? যুদ্ধ ছাড়াই তিনটি দেশই বঙ্গোপসাগরে তাদের নিজ-নিজ সাগর-সীমানা বুঝে পেয়েছে। যুদ্ধে লোকক্ষয় ও বিপুল ধ্বংসযজ্ঞের বিনিময়ে কোনো দেশেরই বা কতোটুকু ‘নিশ্চিত অর্জনের’ গ্যারান্টি ছিল? সমুদ্রসীমা নিয়ে এরূপ শান্তিপূর্ণ আইনী নিষ্পত্তি বাংলাদেশ, ভারত, মিয়ানমার—এই তিনটি দেশের জন্যই যে গুরুত্বপূর্ণ অর্জন, সেকথা নিশ্চিত করেই বলা যায়।
আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল ও সালিশী সংস্থার রায়ে ভারত ও মিয়ানমারের দাবিকৃত সাগর-এলাকার ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গ কিলোমিটার টেরিটোরিয়াল সমুদ্র, ২০০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত একচ্ছত্র অর্থনৈতিক অঞ্চল ও ৩৫৪ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত মহীসোপানের তলদেশে অবস্থিত সব ধরনের প্রাণিজ ও অপ্রাণিজ সম্পদের ওপর বাংলাদেশের সার্বভৌম অধিকার প্রতিষ্ঠা হয়েছে। গুরুতর প্রশ্নটি আসলে এখন জয়-পরাজয় নিয়ে বিতর্কের নয়। আসল বিষয় হলো, বাংলাদেশ তার এই অর্জনকে সর্বাংশে নিজে ধরে রাখবে, নাকি তা পরদেশী অর্থনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় শক্তির হাতে তুলে দেয়ার পথ নিবে? বাংলাদেশের ‘সমুদ্র-জয়’ কি সাম্রাজ্যবাদ ও সাম্রাজ্যবাদী বহুজাতিক কোম্পানির শোষণের লালসার কাছে বলি দেয়া হবে? ‘সমুদ্র-জয়ের’ ফসল কি জনগণের মাঝে ‘সমান পরিমাণে’ বন্টনের ব্যবস্থা করা হবে? না, তাকে কি দেশের মুষ্টিমেয় লুটেরা চক্রের ধন স্ফীতির উেস পরিণত হতে দেয়া হবে? এখন আসল প্রশ্ন হলো এটিই। অথচ তা নিয়ে কোনো কথাবার্তাই সরকার বা বিএনপি নেতাদের মুখে নেই।
বঙ্গোপসাগরের উপকূল, অগভীর সমুদ্রাংশ ও গভীর সমুদ্রাংশের ওপর এবং সেখানকার যাবতীয় সম্পদের ওপর বাংলাদেশের আইনী অধিকার এখন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এই অর্জিত সমুদ্র এলাকায় যে বিপুল সম্পদ রয়েছে তার মধ্যে বর্তমানে সবচেয়ে মূল্যবান হলো:(১) প্রাকৃতিক গ্যাস ও তেল সম্পদ, (২) মাছ ও অন্যান্য জৈব সম্পদ, (৩) সামরিক স্ট্র্যাটেজিক কাজে এই সাগর এলাকাকে ব্যবহারের সুযোগ। এসব ক্ষেত্রে পরদেশী, বিশেষত সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্র ও পুঁজি ভাগ বসাতে চেষ্টা করছে। বাংলাদেশের আপেক্ষিক আর্থিক ও সামরিক দুর্বলতা ও পরনির্ভরতাকে সুযোগ হিসেবে ব্যবহার করে তারা ‘আমাদের অর্জনকে’ ‘তাদের অর্জন’ হিসেবে পরিণত করার চেষ্টা করছে। সে পাঁয়তারা আগে থেকেই চলছিল। তা এখন আরো জোরদার হচ্ছে ও হবে।
অর্জিত ‘আইনী’ সাগর এলাকাকে কয়েকটি ব্লকে ভাগ করে তেল-গ্যাস সম্পদ লুটে নেয়ার জন্য তত্পরতা ইতোমধ্যেই জোরদার করা হয়েছে। বিদেশি লুটেরাদের স্থানীয় ‘পদলেহনকারীরা’ ইতোমধ্যেই লুটপাটের ভাগ পাওয়ার লালসায় ‘লুঙ্গি কাছা দিয়ে’ নেমে পড়ার কসরত্ শুরু করে দিয়েছে। অন্যদিকে বাংলাদেশের জন্য সামুদ্রিক নিরাপত্তার ক্ষেত্রে সহায়তা প্রদানের কথা বলে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ এখন বঙ্গোপসাগরে তার নৌ-ঘাঁটি স্থাপন ও নৌ-উপস্থিতি বাড়ানোর জন্য তত্পরতা আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় মার্কিন সামরিক উপস্থিতি এদেশের নিরাপত্তা নিশ্চিত না করে বরঞ্চ বাংলাদেশকে মার্কিন-চীন-ভারতীয় স্ট্র্যাটেজিক দ্বন্দ্বে বাংলাদেশকে অহেতুক যুক্ত করার দ্বারা দেশের নিরাপত্তাকে আরো বিপদসংকুল করে তুলবে।
সাগর এলাকায় যে অর্জন বাংলাদেশের হয়েছে তার সবটুকু দেশ ও দেশবাসীর জন্য নিশ্চিত করার পথ গ্রহণ করতে হলে তেল-গ্যাস সম্পদ উত্তোলন, মত্স্য সম্পদ আহরণ ও সমুদ্র নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কাজগুলো অন্য কোনো রাষ্ট্র বা কোম্পানির হাতে তুলে না দিয়ে তা নিজেদের পরিপূর্ণ কর্তৃত্ব করার পথ গ্রহণ করতে হবে। এসব কাজে জাতীয় সক্ষমতা দ্রুত বাড়ানোর ব্যবস্থা করতে হবে। প্রয়োজনে বাংলাদেশেরই নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণে বিদেশি প্রযুক্তি ও বিশেষজ্ঞ ভাড়ায় এনে ব্যবহার করতে হবে। যেভাবে আমরা এখন পদ্মা সেতু নির্মাণের পথ গ্রহণ করেছি—সেভাবে। এই পথ গ্রহণ না করে যদি ‘ইজারা দিয়ে’ সুবিধার একাংশ গ্রহণের পথ অব্যাহত রাখা হয় তাহলে বাংলাদেশের অর্জন হাইজ্যাক হয়ে তা পরদেশীদের অর্জনে পর্যবসিত হবে। বাংলাদেশের সমুদ্র-জয় পরিণত হবে বিদেশের সমুদ্র জয়ে। সেক্ষেত্রে মাথা চাপড়িয়ে গাইতে হবে ‘ডিম পাড়ে হাঁসে, খায় বাগডাশে’। তা হতে দেয়া যায় না। বাগডাশ ও তার পদলেহনকারীদের এহেন ‘ডাকাতি-প্রয়াস’ রুখতেই হবে।
লেখক :সভাপতি, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি)