সদ্য বাংলাদেশে সফরে আসা ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ বলেছেন, “ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে এটাই আমার প্রথম বিদেশ সফর৷ আমি ভারতের নবনির্বাচিত সরকারের তরফ থেকে বন্ধুত্বের বারতা নিয়ে এসেছিলাম৷ এ সফরে আমি বাংলাদেশের জ্যেষ্ঠ নেতৃত্বের সঙ্গে ভারত-বাংলাদেশ দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করেছি৷ বাংলাদেশের নেতাদের সঙ্গে আমার আলোচনা অত্যন্ত ফলপ্রসূ হয়েছে৷ আন্তরিক ও সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে আমাদের আলোচনা হয়েছে, এ আলোচনা থেকে আমরা ভবিষ্যৎ সহযোগিতার ভিত রচনা করতে পারি৷ আমাদের আলোচনার ভিত্তিতে দুই দেশের বাণিজ্য, সংযোগ, বিদ্যুৎ খাতের সহযোগিতা ও জনগণের সঙ্গে জনগণের আরও যোগাযোগ বাড়বে বলে আশা করছি৷”
দৈনিক প্রথম আলোর সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে সুষমা স্বরাজ এসব কথা বলেন।
প্রসঙ্গত, ভারতে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ গত ২৫ জুন দুই দিনের সফরে বাংলাদেশে আসেন। সে সময় তার সাক্ষাৎকারটি নেয়া হয়।
সুষমা বলেন, “আমার মনে হয়, ভারত-বাংলাদেশ দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি গুণগত পরিবর্তন আনার সময় এসেছে৷ আমরা এ অঞ্চলে যেসব সমস্যার মুখোমুখি হই, সে প্রেক্ষাপটে কিছু কিছু ক্ষেত্রে ভারত-বাংলাদেশ সহযোগিতা আরও দৃঢ় হওয়া উচিত: দারিদ্র্য দূরীকরণ, নিরক্ষরতা দূরীকরণ, সন্ত্রাস, চরমপন্থা ও মৌলবাদ মোকাবিলায়৷”
এক প্রশ্নের জবাবে সুষমা বলেন, “ভারতের বিগত সরকারের আমলে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক যে জায়গায় ছিল, আমরা সেটাকে শুধু বজায় রাখতে চাই তা নয়, সেটাকে আমরা নতুন উচ্চতায় নিয়ে যেতে চাই৷ তিস্তার পানিবণ্টন নিয়ে আমরা আমাদের দেশে অভ্যন্তরীণ ঐকমত্য গড়ে তুলতে চাইছি৷ স্থল সীমানা চুক্তি করার জন্য সংবিধানের প্রয়োজনীয় সংশোধনীর জন্য রাজ্যসভায় বিল পেশ করা হয়েছে৷ এ মর্মে রাজনৈতিক ঐকমত্যে পৌঁছানোর জন্যও আলোচনা হচ্ছে৷”
লোকসভা নির্বাচনের প্রচারণায় মোদির অবৈধ বাংলাদেশি তাড়ানো ঘোষণা সম্পর্কে সুষমা বলেন, “অবৈধ অভিবাসন যেকোনো দেশের জন্যই খুবই স্পর্শকাতর একটি সমস্যা, খুব সতর্কতার সঙ্গে এটা সামলানো উচিত৷ সব পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে আমরা এ সমস্যা মোকাবিলা করতে চাই৷ এর মধ্য দিয়ে সীমান্তের উন্নততর ব্যবস্থাপনার দিকটিও উঠে এসেছে, এটা নিশ্চিত করা উভয় পক্ষেরই দায়িত্ব৷ যে কয়টি দেশের সঙ্গে ভারতের সীমান্ত রয়েছে, তার মধ্যে বাংলাদেশের সঙ্গেই তার সীমান্ত দীর্ঘতম৷ এ সীমান্ত নিশ্ছিদ্র নয়৷ এ সীমান্তে বসবাসকারী মানুষ দরিদ্র, পুরো এলাকা খুবই ঘনবসতিপূর্ণ৷ সে কারণে এখানে অনেক অবৈধ কাজ হয়৷ আমরা মনে করি, ভারত ও বাংলাদেশের নিরাপত্তা একই সূত্রে গাঁথা৷ দুই দেশেরই উচিত একত্রে কাজ করে সীমান্ত এলাকায় এসব অবৈধ কাজের রাশ টেনে ধরা৷ নিরাপদ হলেই আমাদের সীমান্ত এলাকা সমৃদ্ধ হয়ে উঠবে, তার জন্য আইনের শাসন জোরদার করতে হবে৷ অসহায় ও নির্দোষ মানুষদের বিবেকহীন কাজের শিকার হতে দেয়া যাবে না৷”
ভারত আওয়ামী লীগ সরকারের কাছ থেকে অনেক কিছু পেয়েছে, কিন্তু প্রতিদানে তেমন কিছু দেয়নি-এমন অভিযোগের জবাবে সুষমা বলেন, “এ ধারণা ঠিক নয়৷ ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক দ্বিমুখী সড়ক৷ আমাদের সম্পর্কের কিছু ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট অগ্রগতি হয়েছে৷ পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতেই আমরা এগিয়েছি৷ বাণিজ্য, বাজার সুবিধা, বিদ্যুৎ, সীমান্ত ব্যবস্থাপনা, উন্নয়ন সহযোগিতা, অবকাঠামো, তরুণদেরসহ দুই দেশের জনগণের সম্পর্ক, সংবাদকর্মীদের মধ্যকার যোগাযোগ প্রভৃতি ক্ষেত্রে আমরা নতুন রেকর্ড স্থাপন করেছি।”
ভারতে বাংলাদেশের বাণিজ্য-ঘাটতি সম্পর্কে সে দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, “বাণিজ্য-ঘাটতি নিয়ে বাংলাদেশের দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে আমরা সংবেদনশীল৷ ২০১২-১৩ অর্থবছরে সার্ক অঞ্চলে বাংলাদেশ ভারতের বৃহত্তর বাণিজ্য সহযোগীতে পরিণত হয়েছে৷ আগের বছরের তুলনায় এ বছর বাংলাদেশ থেকে ভারতে রপ্তানির পরিমাণ ১৩ দশমিক ৫ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৬৩ দশমিক ৯৬ মিলিয়ন ডলারে৷
জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ অন ট্রেড, জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ অন কাস্টমসসহ আরও নানা আয়োজনের মাধ্যমে দুই দেশের মধ্যকার বাণিজ্য বাধা দূর করার চেষ্টা করা হচ্ছে৷ এসব কমিটি বছরে একবার বসে৷ সাম্প্রতিক সময়ে এসব বৈঠকের কিছু ফলাফল দেখা যাচ্ছে, যেমন বেনাপোল-পেট্রাপোল সীমান্ত ও আগরতলা-আখাউড়া স্থলবন্দরে সাত দিনব্যাপী বাণিজ্য হওয়া৷ আরও ১৬টি স্থলসীমান্ত বন্দরে এরূপ বাণিজ্যের সম্ভাবনা খতিয়ে দেখা হচ্ছে৷ এদিকে, আমরা বিএসটিআইয়ের সঙ্গে কাজ করছি সংস্থাটির পরীক্ষা ও মানদণ্ড নির্ধারণের সক্ষমতা বাড়ানোর লক্ষ্যে৷ বাংলাদেশ থেকে ভারতে পণ্য রফতানির প্রবৃদ্ধি ভারত থেকে বাংলাদেশে পণ্য রফতানির প্রবৃদ্ধির চেয়ে বেশি৷ ভারত থেকে বাংলাদেশে যেসব পণ্য রপ্তানি হয়, সেগুলোর মধ্যে অনেকগুলোই বাংলাদেশের রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাকশিল্পের কাঁচামাল ও মধ্যবর্তী পণ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়৷”
তিনি বলেন, “এদিকে ভারত তার বাংলাদেশ সীমান্তের ১৬টি প্রধান স্থলবন্দরের অবকাঠামোগত উন্নয়ন ঘটিয়ে সেগুলোকে সমন্বিত চেকপোস্টে উন্নীত করতে চায়৷ সেখানে কাস্টমস থেকে শুরু করে অভিবাসন, পার্কিং, হিমাগার, অসুস্থদের জন্য পৃথক নিবাসসহ নানা ধরনের সুবিধা একটি স্থানেই পাওয়া যাবে৷ আগরতলায় এই যৌথ চেকপোস্টের কাজ ২০১৩ সালের নভেম্বরে শেষ হয়েছে, সেখানে এখন কাজও হচ্ছে৷
মেঘালয় সীমান্তে দুটি সীমান্ত হাট রয়েছে৷ এটা শুনে আমি খুশি হয়েছি যে এরূপ আরও দুটি হাট ত্রিপুরা সীমান্তে শুরু হতে যাচ্ছে৷ আর এ বছরের মার্চে অনুষ্ঠিত জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ অন ট্রেডের বৈঠকে আরও চারটি হাট স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে৷ বাংলাদেশ যাতে আরও রফতানি উদ্বৃত্ত তৈরি করতে পারে, সে মর্মে ভারত মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদে বাংলাদেশে আরও বিনিয়োগ করতে আগ্রহী৷ এর ফলে বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের ভান্ডারে আরও পণ্য যুক্ত হবে৷ আর বাংলাদেশ তার প্রতিবেশী ও অন্যান্য দেশের বাজারে প্রবেশ করতে সক্ষম হবে৷”
বাংলাদেশের মানুষ মনে করে, আওয়ামী লীগ ও কংগ্রেসের মধ্যে এক ‘বিশেষ সম্পর্ক’ রয়েছে৷ ভারতের সরকার পরিবর্তন হওয়ায় এ দুই দেশের সম্পর্কের মধ্যে কি কোনো গুণগত পরিবর্তন ঘটবে? এমন প্রশ্নের জবাবে সুষমা বলেন, “সেটা আপনাদের ধারণা৷ আমাদের সরকার বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরির চেষ্টা করবে৷ দুটি দেশের মধ্যকার সম্পর্ক নির্ভর করে দুই দেশের জনগণ ও সরকারের মধ্যকার সম্পর্কের ওপর৷ আমরা বাংলাদেশের সঙ্গে একটি ব্যাপকভিত্তিক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক অংশীদারত্ব তৈরি করার ইচ্ছা রাখি, আর সেটা সমাজের সবাইকে নিয়েই আমরা করতে চাই৷”
৫ জানুয়ারির নির্বাচন প্রসঙ্গে সুষমা বলেন, “দেখুন, বাংলাদেশের নির্বাচনের ওপর আমাদের রায় দেয়ার কিছু নেই৷ বাংলাদেশে রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ কী হবে, তা এই দেশের জনগণই নির্ধারণ করবেন৷ আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি ভবিষ্যৎমুখী৷ ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক এই দুই দেশের ভবিতব্য নির্ধারণে যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে, সেটাকে বিবেচনায় নিয়েই আমরা আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি নির্ধারণ করি৷”