যাত্রাবাড়ির যানজট এড়িয়ে মেয়র হানিফ ফ্লাইওভার দিয়ে প্রতিদিন রাজধানীতে নির্বিঘ্নে প্রবেশ করে ৩০ হাজার গাড়ি। উদ্বোধনের দিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গাড়ি প্রবেশের মধ্য দিয়ে এই ফ্লাইওভারের যাত্রা শুরু। এই ফ্লাইওভার ছিল রাজধানীবাসী এবং দেশের পূর্ব-দক্ষিণ, দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ৩০ জেলার মানুষের জন্য প্রধানমন্ত্রীর উপহার।
গত বছরের ১১ অক্টোবর সবার জন্য এ ফ্লাইওভার খুলে দেয়া হয়। এ দিন ১৮ হাজার ৫শ’ বাইশটি গাড়ি টোলপ্লাজা অতিক্রম করে। এর মধ্যে প্রধানমন্ত্রীকে বহনকারী গাড়িটিও রয়েছে। টোল আদায় হয় ১১ লাখ ৩৫ হাজার ৬ শ’ ৭০ টাকা। এখন গড়ে প্রায় ৩০ হাজার গাড়ি প্রতিদিন এই টোলপ্লাজা দিয়ে বিভিন্ন গন্তব্যে যায়। টোল আদায় হচ্ছে প্রতিদিন গড়ে ২৩ লাখ ১৮ হাজার টাকা। গাড়ি যাতায়াতের সর্বোচ্চ সংখ্যা ৩২ হাজার ২৩১টি।
নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ওরিয়ন গ্রুপের সিনিয়র ম্যানেজার মোঃ আশিকুল আলম জানান, চলতি মাসে ফ্লাইওভারের বাকি দু’টো র্যামও উন্মুক্ত হবে। বর্তমানে শনির আঁখড়া-যাত্রাবাড়ি-সায়েদাবাদ-গুলিস্তান-ফুলবাড়িয়া-পলাশী অভিমুখে র্যামগুলো চালু রয়েছে। আর সায়েদাবাদ ও যাত্রাবাড়ি বাসস্ট্যান্ডের জনপথের কিছু কাজ বাকি রয়েছে। তবে তা এ মাসের মধ্যেই শেষ হবে। ফ্লাইওভারের সবগুলো এন্ট্রি এবং এক্সিট র্যাম উন্মুক্ত হলে গাড়ি যাতায়াতের সংখ্যা দ্বিগুণ হবে।
বাংলাদেশে পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি)’র প্রথম প্রকল্প এটি এবং দেশের দীর্ঘতম ফ্লাইওভার। আমেরিকান কোড ও স্টান্ডার্ড অনুসরণক্রমে আন্তর্জাতিক মানদন্ড বজায় রেখে যান্ত্রিক পদ্ধতিতে দৃষ্টিনন্দন অবকাঠামো নির্মাণে বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য নির্মাণ কাজ এটি। এই কাজে দেশের সড়ক নিরাপত্তার বিষয়টিও নজরে রাখা হয়েছে। বিদ্যমান অন্যান্য ফ্লাইওভারের সাথে এই ফ্লাইওভারের ব্যাপক পার্থক্য রয়েছে। জটিল, ঘনবসতিপূর্ণ ও কনজেস্টেড রাস্তার উপর বিদ্যমান তিনটি বাস টার্মিনাল অক্ষুন্ন এবং নির্মাণকালীন রাস্তায় যান চলাচল স্বাভাবিক রেখে মেয়র হানিফ ফ্লাইওভার নির্মাণ করা হয়। যা কেবল বাংলাদেশেই নয়; গোটা বিশ্বে বিরল। এসব প্রতিবন্ধকতা ছাড়াও ফ্লাইওভার নির্মাণ পথে শত বছরের বিদ্যমান বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাস, পয়ঃনিষ্কাশন ও টেলিফোন লাইনসহ ভূগর্ভস্থ অন্যান্য স্থাপনা যথাস্থানে রেখে সর্বাধুনিক প্রযুক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে ফ্লাইওভারটি নির্মাণ করা হয়।
হেড অব টোল অপারেশন্স এন্ড মেইনটেইন্যান্স কূলদ্বীপ সিং-এর নেতৃত্বে ১০০ জনের বেশী দক্ষ কর্মী টোল আদায় ও ফ্লাইওভার রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে রয়েছেন।
উল্লেখ্য, এই ফ্লাইওভারে ৩১৫টি পিয়ার (কলাম) ফাউন্ডেশন, এর একটি থেকে অন্যটি আলাদা। অর্থাৎ একটির সাথে অন্যটির কোনো মিল নেই। প্রত্যেকটিকে আলাদা আঙ্গিকে ভিন্ন ডিজাইনে নির্মাণ করতে হয়েছে।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ও এই প্রকল্পের সিটি কর্পোরেশন পক্ষের প্রকল্প পরিচালক আশিকুর রহমান জানিয়েছেন, এ ধরনের পিয়ার (কলাম) দিয়ে ফ্লাইওভার নির্মাণ বিশ্বে বিরল। এই ফ্লাইওভার চালুর মধ্য দিয়ে ঢাকার যানজট নিরসন এবং দেশের পূর্ব-দক্ষিণ, দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশিমাঞ্চলের প্রায় ৩০ জেলার সঙ্গে রাজধানীর যোগাযোগ ক্ষেত্রে যুগান্তকারী অধ্যায়ের সূচনা হয়েছে।
আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট ক্ষমতায় আসার পর ২০১০ সালের ২২ জুন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন। সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে (পিপিপি) নির্মিত এটিই দেশের বৃহত্তম ফ্লাইওভার। এ ফ্লাইওভারের সঙ্গে প্রধান প্রধান সড়ক ও বাস টার্মিনালের সংযোগ রাখা হয়েছে। ফ্লাইওভারে প্রবেশের জন্য ছয়টি এবং বের হওয়ার জন্য পাঁচটি পথ রয়েছে। চার লেনবিশিষ্ট আধুনিক সকল সুযোগ-সুবিধা সম্পন্ন এই ফ্লাইওভার দৈর্ঘ্যে ৭ কি. মি. হওয়ার কথা ছিল; কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ব্যক্তিগত উদ্যোগে ফ্লাইওভারের দৈর্ঘ্য ১১.৮ কিলোমিটারে বৃদ্ধি পেয়েছে। যার প্রেক্ষিতে ফ্লাইওভারের পরিধি ও সুযোগ-সুবিধা বেড়ে হয়েছে দ্বিগুণ।
উদ্বোধনের পর ফ্লাইওভারের গুলিস্তান, পলাশী, মতিঝিল ও কুতুবখালী পর্যন্ত পথ খুলে দেয়া হয়। আর সায়েদাবাদ ও যাত্রাবাড়ি বাসস্ট্যান্ডের জনপথের কিছু কাজ বাকি রয়েছে তবে তা চলতি জুন মাসের মধ্যেই শেষ হচ্ছে।
৩০টি জেলার সংযোগ সড়ক এটি। উদ্বোধনীর দিন নিজ গাড়িতে করেই প্রধানমন্ত্রী যাত্রাবাড়ি-কুতুবখালী প্রান্তে টোল প্লাজায় পৌঁছান এবং ফলক উন্মোচন করে এ পথের যাত্রা ঘোষণা করেন। এরপর বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি-অঙ্কিত ৫০ টাকার স্মারক মুদ্রা দিয়ে টোল টিকিট কেনেন। পিপিপি ভিত্তিতে এ প্রকল্পের নির্মাণ কাজই নয় পরিচালনার দায়িত্বও ওরিয়ন ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেড’র। ওরিয়ন গ্রুপই এ প্রকল্পের অর্থায়ন করেছে। এখানে সরকারের কোনো অর্থ ব্যয় করতে হয়নি। দেশের বৃহত্তম এ ফ্লাইওভারের নির্মাণকাজের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ভারতের সিমপ্লেক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচারাল লিমিটেড। কনসাল্টেন্ট হচ্ছে লি ইন্টারন্যাশনাল (কানাডা) ও লি অ্যাসোসিয়েটস (ভারত)।
বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে ওরিয়ন গ্রুপ এ ফ্লাইওভারের ব্যবস্থাপনা, টোল আদায় ও রক্ষণাবেক্ষণ করছে। চালু হওয়ার পর থেকে ২৪ বছরে পাওয়া টোলের ভিত্তিতে নির্মাণ ব্যয় তুলে নেবে তারা। প্রতিদিনের আদায় করা টোলের পাঁচ শতাংশ ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের তহবিলে জমা হবে। ২৪ বছর পর এর দায়িত্ব নেবে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। হানিফ ফ্লাইওভারের আয়ুষ্কাল ধরা হয়েছে ১০০ বছর। চট্টগ্রাম ও সিলেটসহ দক্ষিণ, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের প্রায় ৩০টি জেলার যানবাহন ঢাকার প্রবেশ পথের যানজট এড়িয়ে এ ফ্লাইওভার দিয়ে প্রবেশ করতে পারবে। যাত্রাবাড়ীর শনির আখড়া থেকে গুলিস্তানের নিমতলী মোড় পর্যন্ত এ ফ্লাইওভারে যানবাহন প্রবেশের পর বের হওয়ার পথে টোল দিতে হয়।
বছরের পর বছর ধরে যাত্রাবাড়ি-সায়েদাবাদ দিয়ে রাজধানীতে প্রবেশপথে যে ধরনের ভোগান্তি পোহাতে হতো ফ্লাইওভার নির্মাণের পর এখন তার অবসান ঘটেছে। ভুক্তভোগী মানুষেরা হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছে। এখন আর ঘণ্টার পর ঘণ্টা রাস্তার যানজটে আটকে থাকতে হয় না।
২০০০ সালে বিশ্বব্যাংকের আর্থিক সহযোগিতায় যোগাযোগ মন্ত্রণালয় যাত্রাবাড়ি-সায়েদাবাদ এলাকায় যানজটসহ অন্যান্য বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের একটি প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্বে সমীক্ষা পরিচালনা করে। সেই সমীক্ষায় যানজটের কারণে মানুষের কর্মঘণ্টা অপচয়, গাড়ির জ্বালানি অপচয়সহ একটি প্রতিবেদন দাখিল করা হয়। সেই তথ্যানুসারে মেয়র হানিফ ফ্লাইওভার নির্মাণের ফলে লাখো মানুষের প্রতিদিন লাখো লাখো কর্মঘণ্টা বেঁচে যাচ্ছে। পাশাপাশি যানজটে গাড়ির অতিরিক্ত জ্বালানি ব্যয় কমে যাওয়ার ফলে এই খাতে সরকারের ব্যয়ও হ্রাস পেয়েছে, মানুষের চলাচল নির্বিঘ্ন হয়েছে।
মাতুয়াইল এলাকার চায়ের দোকানদার সামসুল এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘গেল সপ্তাহে আমার পাশের বাসার শাকিল ভাই হঠাৎ স্ট্রোক করে। অ্যাম্বুলেন্স ডেকে তাকে দ্রুত ঢাকা মেডিক্যালে পাঠানো হয়। শনির আঁখড়া থেকে পলাশীর দিকে যাওয়া ফ্লাইওভার অতিক্রম করে ৮-১০ মিনিটের মধ্যেই তাকে নিয়ে ঢাকা মেডিকেলে পৌঁছি। সেখানে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ায় তিনি বেঁচে যান। ডাক্তাররা বলেন, রোগীর যা অবস্থা ছিল, তাতে আর ১৫ মিনিট দেরি হলে তাকে বাঁচানো যেত না। এ কারণে শাকিল ভাই, আশপাশের লোকজন ও তার আত্মীয়-স্বজন খুবই খুশি। তার আত্মীয়-স্বজনের বক্তব্য, ‘ফ্লাইওভার না হলে শাকিলকে বাঁচনো যেত না’। এ জন্য তার পরিবার-পরিজন দোয়া ও মিলাদের ব্যবস্থা করে।’
অন্যদিকে উৎসব গাড়ির ড্রাইভার মানিক এই প্রতিবেদকের সাথে আলাপকালে জানান, গত ১৪ বছর ধরে তিনি নারায়ণগঞ্জ টু ঢাকা পথে গাড়ি চালান। তিনি বলেন, ‘এক বছর আগেও আমরা গুলিস্তান থেকে নারায়ণগঞ্জ যেতাম যাত্রাবাড়ি হয়ে। কোনো কোনো সময় দেখা যেত রায়েরবাগ থেকে রাস্তায় এমন যানজট যে, যাত্রাবাড়ি পার হতেই লেগে যেত দুই-তিন ঘণ্টা। গাড়িতে বসে থেকে গাড়ির হর্ণ, কোলাহল আর ধুলাবালিতে মানুষের মেজাজ বিগড়ে যেত। তখন দিনে এক ট্রিপের বেশি দু’টি দেয়া কঠিন হতো। মালিককে সন্ধ্যায় টাকা বুঝিয়ে দেয়ার সময় বকাঝকা করত। আর এখন শনির আঁখড়া থেকে ফ্লাইওভারে ওঠা মানেই গুলিস্তান পৌঁছে গেছি। মাত্র ১০ মিনিট। মানুষও খুশি আমরাও নির্বিঘ্নে রাস্তায় গাড়ি চালিয়ে ক’টা পয়সা পাচ্ছি।’
এই ফ্লাইওভার নির্মাণের ফলে রাজধানীসহ দেশের পূর্ব-দক্ষিণ, দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ৩০ জেলার মানুষের যাতায়াতে যুগান্তকারী অগ্রগতি হয়েছে। সূত্র: বাসস