খুব ভোরে নয়াদিল্লির কীর্তিনগর রেলস্টেশনে দাঁড়িয়ে আছেন লোকজন। কমিউটার ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছেন তারা। দিনের কাজ শুরু করার জন্য তারা যাবেন যার যার কর্মস্থলে। এর পাশাপাশি রেললাইন বরাবর আরেক দল জড়ো হয়েছেন। তারা অবস্থান নিয়েছেন কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে। ভারতীয়দের মধ্যে তাদের সংখ্যা কম নয়। প্রায় ৪৮ শতাংশ, যাদের প্রাকৃতিক কাজ সারার কোনো জায়গা নেই। কাছাকাছি বস্তি থেকে তারা আসেন। অবস্থান নেন গাছ কিংবা কোনো ঝোপের আড়ালে। এরপর এদিক-সেদিক চেয়ে উবু হয়ে বসে খোলা আকাশের নিচে সারেন প্রাতঃকর্ম। এর ফলে ডায়রিয়া ও হেপাটাইটিসের মতো রোগবালাই ছড়িয়ে পড়ছে। কিন্তু থেমে নেই তাদের এই কর্ম। প্রতিদিন সকালে দেখা যাচ্ছে একই ধরনের দৃশ্য। মেয়েদের জন্য তো এভাবে খোলা জায়গায় প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেওয়া আরও বিপজ্জনক। যৌন নির্যাতনের শিকার হতে পারেন তারা। অতি সম্প্রতি উত্তর প্রদেশ রাজ্যে দুই কিশোরীকে পালাক্রমে ধর্ষণ করা হয়। এরপর হত্যা করা হয় তাদের ফাঁসিতে ঝুলিয়ে। তারা গিয়েছিলেন বাড়ির বাইরে নিজেদের হালকা করে নিতে। কেননা তাদের বাড়িতে টয়লেট নেই। শুধু তাদের নয়, আক্ষরিক অর্থেই ভারতে লাখ লাখ বাড়িতে কোনো টয়লেট নেই। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নতুন রিপোর্টে বলা হচ্ছে, ভারতে ৫০ কোটিরও বেশি মানুষ এখনো গাছ কিংবা ঝোপের আড়ালে অথবা খাল-বিলের ধারে প্রাকৃতিক কর্ম সারেন। একাকী নিরুপদ্রবে এই কর্মটি সারার কোনো উপায় নেই তাদের সামনে।
খোলা আকাশের নিচে এই কাজ বন্ধ করা আসলেই ভারতের রাজনীতিবীদদের কাছে সব চেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। সদ্য সমাপ্ত লোকসভা নির্বাচন সামনে রেখে কংগ্রেস ও ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি), উভয় দলই তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে ঘোষণা দেয় যে, খোলা আকাশের নিচে প্রাকৃতিক কর্ম সারা বন্ধ করবেন তারা। অন্য কথায়, বাড়িতে বাড়িতে তারা টয়লেট নির্মাণের ব্যবস্থা নেবেন। এ ছাড়া সর্বসাধারণের ব্যবহারের জন্য পর্যাপ্ত শৌচাগার নির্মাণের ব্যবস্থাও নেবেন তারা। প্রচারাভিযানের সময় বিজেপি নেতা নরেন্দ্র মোদি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, টয়লেট আগে, মন্দির পরে। এখন তিনি প্রধানমন্ত্রী। আর সাবেক পল্লী উন্নয়নমন্ত্রী কংগ্রেসের জয়রাম রমেশ বলেছিলেন, পূজা করার জন্য স্বাস্থ্য বিধি অনুসরণ করা গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। ভারত সরকার টয়লেট নির্মাণের জন্য আর্থিক সহায়তা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এ ছাড়া লোকজনের মধ্যে সচেতনতা গড়ে তোলার জন্য ব্যাপক প্রচারাভিযানও চালিয়ে যাচ্ছে। ২০০৫ সালে হরিয়ানা রাজ্যে প্রচার কাজে চমৎকার একটি স্লোগান ব্যবহার করা হয় টয়লেট নেই, বিয়েও নেই। সেখানকার বাড়িতে টয়লেট না থাকলে বিয়ে না বসার জন্য মেয়েদের প্রতি আহ্বানও জানানো হয় প্রচারাভিযানে। টয়লেট নির্মাণে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে গেটস ফাউন্ডেশনও। তারা মূলত টয়লেট নির্মাণ করছে যেখানে পানি, পয়ঃনিষ্কাশন কিংবা বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থা নেই, সে সব এলাকায়। মানুষের বর্জ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ ব্যবস্থার উন্নয়নেও সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন তারা। ফাউন্ডেশন সম্প্রতি দিল্লিতে একটি টয়লেট মেলারও আয়োজন করে। মেলায় দেখানো হয়, ছাদে রিয়েক্টর বসানো টয়লেট। এই রিয়েক্টর বর্জ্য পদার্থকে সারে রূপান্তর করে থাকে। এ ছাড়া আরেক ধরনের টয়লেট দেখানো হয়। তাতে রয়েছে স্বয়ংক্রিয় জীবাণু মুক্তকরণ ব্যবস্থা। খোলা আকাশের নিচে এসব কর্ম সাধনের কারণ হিসেবে শৌচাগার না থাকার কথা উল্লেখ করা হয়। এ ছাড়া সব চেয়ে বড় কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয় ভারতের কোনো কোনো এলাকায় এটি সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। আর সমাজ তা মেনেও নিয়েছে। শুধু মাত্র টয়লেট নির্মাণই এই সমস্যার সমাধান নয়। কেননা খোলা আকাশের নিচে মল-মূত্র ত্যাগ করা অভ্যাসে পরিণত হয়েছে, যখন থেকে একটি শিশু হাঁটতে শেখে তখন থেকেই। আপনি যখন এ রকম একটা পরিবেশে বেড়ে উঠবেন, তখন পরবর্তীতে যথাযথ টয়লেট সুবিধা পেলেও আপনি ফিরে যাবেন আপনার আগের অভ্যাসে-বলেন ইউনিসেফ কর্মকর্তা সু কোয়েটস। তিনি মনে করেন, ভারত তখনই এই ব্যাধি থেকে মুক্ত হবে, যখন সমাজ টয়লেট ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করতে পারবে এবং টয়লেট ব্যবহারে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হবে। সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল প্লানিং অ্যান্ড টেকনোলজির অধ্যাপক মিরা মেহতা এ ব্যাপারে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেন, এ পর্যন্ত বেশ কিছু টয়লেট নির্মাণ করে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সেগুলো জনগণের মধ্যে কোনো প্রভাব ফেলতে পারেনি। অর্থাৎ সেগুলো ব্যবহারে তারা উৎসাহী নন। সচেতনতামূলক প্রচারাভিযান চালানোর অভাবের কারণে এমনটা ঘটছে বলে মনে করেন তিনি। তিনি বলেন, সঠিক নীতি ও যথাযথ রাজনৈতিক উদ্যেগ নেওয়া হলে ভারতে খোলা জায়গায় প্রাকৃতিক কর্ম সারা দশ বছরের মধ্যে বন্ধ হয়ে যাবে।