২০০৯ সালের ২৫-২৬ ফেব্রুয়ারি। ৩৬ ঘণ্টার নারকীয় বিডিআর হত্যাযজ্ঞে ঝরে গিয়েছিল বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ৫৭ জন চৌকস অফিসারসহ ৭৫টি তাজা প্রাণ। কোনো বিদেশি শত্রুর আক্রমণে নয়, নিজের দেশের একদল বিপথগামী বিডিআর সদস্যের হাতে প্রাণ দিতে হয়েছিল তাদের। রেহাই পাননি তাদের স্ত্রী-সন্তানরাও।
হত্যার আগে তাদের ওপর চালানো হয়েছে নির্যাতন। পানির ট্যাংকি, বাথরুম কিংবা গাড়ির ভেতরে লুকিয়েও প্রাণ রক্ষা করতে পারেননি তারা। শিকারি কুকুরের মত গন্ধ শুঁকে শুঁকে বের করে এনে একে একে হত্যা করা হয় তাদের।
ওই ঘটনায় ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৫ জন নিহত হওয়ার পর এ বাহিনীর নাম পাল্টে রাখা হয় বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। বাহিনীর উর্দিও (পোশাক) বদলে ফেলা হয়।
বিডিআর হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় লালবাগ থানার তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) পুলিশের পরিদর্শক নবজ্যোতি খীসা প্রথমে লালবাগ থানায় এবং পরে নিউমার্কেট থানায় মামলা করেন। এ হত্যা মামলার বিচার এখন সাক্ষীদের সাক্ষ্যগ্রহণ পর্যায়ে রয়েছে।
এছাড়া বিদ্রোহের ঘটনায় ৫৭টি ইউনিটের মধ্যে ৫১টি ইউনিটের জওয়ানদের বিদ্রোহের বিচার সম্পন্ন হয়েছে বিডিআরের (বিজিবি) নিজস্ব আইনে। ৫১টি ইউনিটের ৩ অভিযুক্ত ৩ হাজার ১১৩ জনের মধ্যে ৩ হাজার ৩৬ জনকে শাস্তি ও ৭৭ জনকে বেকসুর খালাস দেওয়া হয়েছে। উল্লেখ্য, ৫৭টি ইউনিটে মোট অভিযুক্ত করা হয় ৬ হাজার ৪৫ জন বিডিআর সদস্যকে। এর মধ্যে ঢাকায় অবিস্থত ইউনিট ১১টি এবং বাকি ৪৬টি ইউনিট দেশের বিভিন্ন স্থানে। ঢাকার পাঁচটি এবং সারা দেশের ৪৬টিসহ ইউনিটের বিচার কাজ সম্পন্ন হয়েছে।
ফৌজদারি আইনে হত্যা মামলা
ইতিহাসের বৃহত্তম এ ফৌজদারি মামলার তদন্ত কাজ ততোটা সহজ ছিলনা। মামলার আলামত মুছে ফেলতে লাশ পুড়িয়ে দেওয়া, গণকবর দেওয়া, ম্যানহোলে ফেলে দিয়ে নেওয়া হয়েছিল বিভিন্ন পদক্ষেপ। ঘটনার মাত্র ১ বছর সাড়ে ৪ মাস পর ২০১০ সালের ১৩ জুলাই হত্যা মামলায় ৮২৪ জনকে ও ২৭ জুলাই বিষ্ফোরক আইনের মামলায় ৮০৮ জনকে আসামি করে সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার আব্দুল কাহার আকন্দ আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন।
ডিএডি তৌহিদ, ডিএডি হাবিব, ডিএডি লতিফ, ডিএডি জলিল, বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য নাসির উদ্দিন আহমেদ পিন্টু ও আওয়ামী লীগ নেতা তোরাব আলীকেও এ মামলার আসামি করা হয়।
দুই মামলায় মোট আসামির সংখ্যা ৮৫৬ জন। আসামিদের মধ্যে তিনজন মারা গেছেন এবং ২০ জন পলাতক, চারজন জামিনে আছেন। বাকি ৮২৯ জন কারাগারে আটক আছেন।
মামলাটি তদন্তের সময়ই মারা যান বিডিআরের উপ-সহকারী পরিচালক (ডিএডি) রহিম ও হাবিলদার শফিকুল ইসলাম এবং চার্জ শুনানি চলাকালে গত বছরের ১৫ মে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে মারা যান আসামি হাবিলদার মতিউর রহমান।
কেস ডকেটসহ চার্জশিটের ওজন প্রায় আধা মণ। বড় ডিমাই সাইজের কাগজে খুব ছোট অক্ষরে অফসেট কাগজের উভয় পৃষ্ঠায় কম্পিউটার কম্পোজকৃত মূল চার্জশিটটি ১৩২ পৃষ্ঠার।
ইতিহাসের সর্ববৃহৎ এ চার্জশিটে আছে আদালতের আদেশ, ৫৪৩ জন আসামির ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী, ৯ জন সাক্ষীর ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় জবানবন্দী, আসামির স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী প্রত্যাহারের আবেদন, সাক্ষীর ১৬১ ধারায় জবানবন্দী, মৃত ব্যাক্তির সুরতহাল রিপোর্ট, পোস্টমর্টেম রিপোর্ট ইত্যাদি।
মামলা দায়েরের পর গ্রেফতার করা হয় ২ হাজার ৩০৭ জনকে। রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে ২ হাজার ২৮২ জনকে। রিমান্ড শেষে প্রায় ৫৪৩ জন ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দেন। এ পর্যন্ত ২০০ জন বিডিআর জওয়ান তাদের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছেন।
তদন্তে অভিযোগ প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত না হওয়ায় ১ হাজার ৫০৪ জনকে মামলার দায় থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। এদের মধ্যে বিডিআর জওয়ান নন এমন আসামির সংখা ১৭ জন এবং মামলা তদন্তকালে মারা যান ৭ জন আসামি।
১ হাজার ২৫২ জনকে এ মামলার সাক্ষী করা হয়েছে। সাক্ষী করা হয়েছে ঘটনার শিকার পরিবারের সদস্যদের, বিডিআর সদস্য, সাংবাদিক, সাধারণ নাগরিক, অস্ত্র ও মোবাইল ফোনসেট বিশেষজ্ঞ, পুলিশ সদস্য, ফায়ার সার্ভিসের সদস্য, রেডক্রিসেন্ট সদস্য, র্যাব সদস্য, জব্দ তালিকার প্রস্তুতকারী দলের সদস্য, ম্যাজিস্ট্র্রেট, মন্ত্রী, সংসদ সদস্য ও তিন বাহিনীর প্রধানদেরকে।
২০১০ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর মামলা দু’টির সাতাশি হাজার পৃষ্ঠার নথি মূখ্য মহানগর হাকিম আদালতে জেনারেল রেকর্ডিং অফিসার ইন্সপেক্টর রতন শেখ মহানগর দায়রা জজ আদালতের প্রশাসনিক কর্মকর্তা এবিএম আবুয়াল হোসেনের কাছে হস্তান্তর করেন।
গত বছরের ৫ জানুয়ারি পুরান ঢাকার বকশীবাজার এলাকায় কেন্দ্রীয় কারাগার ও আলিয়া মাদ্রাসা সংলগ্ন নবকুমার ইন্সটিটিউশন মাঠে স্থাপিত অস্থায়ী আদালতে এ মামলার বিচার শুরু হয়। মহানগর দায়রা জজ মো. জহুরুল হক বিচারক হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন।
মামলাটিতে আসামির সংখ্যাধিক্য হওয়ায় নিরাপত্তা ও আসামিদের নিয়ে যাওয়া-আসার বিড়ম্বনা এড়াতেই এ অস্থায়ী আদালত নির্মাণ করা হয়।
মামলার দ্রুত নিস্পত্তিতে প্রথমে সপ্তাহে একদিন প্রতি বুধবার আদালত সাক্ষ্যগ্রহণ করতেন। দেশের আদালত সমূহে সরকারি বন্ধ থাকা সত্ত্বেও গত বছর ডিসেম্বর মাসের প্রতিদিনই আদালতের কার্যক্রম চলে। এরপর থেকে সপ্তাহে দু’দিন সোমবার ও বুধবার সাক্ষ্যগ্রহণ করা হচ্ছে।
এ মামলার অন্যতম প্রধান সরকারি কৌসুলি অ্যাডভোকেট মোশারফ হোসেন কাজল বাংলানিউজকে জানান, ‘অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে সরকার এ মামলার বিচার শেষ করতে বদ্ধপরিকর। এ মামলায় বিপুল সংখ্যক সাক্ষী থাকলেও সবাইকে সাক্ষ্য দিতে ডাকা হবে না। শুধুমাত্র অত্যন্ত প্রয়োজনীয় সাক্ষীদেরই ডাকা হবে।’
তিনি আরও জানান, ‘এ মামলায় এ পর্যন্ত ৪৫ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়েছে। সাক্ষীদের সাক্ষ্যে প্রায় ২৫০ জন আসামি হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত ছিলেন মর্মে সনাক্ত করা হয়েছে। ৫৮ জন সেনা কর্মকর্তাও এ মামলায় সাক্ষী আছেন। তাদের মধ্যে ১৮ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ করা হয়েছে। বাকিদের মধ্যে যারা মামলার প্রয়োজনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করা হবে, শুধু তাদেরই ডাকা হবে। ’
তিনি বলেন, ‘অনেক আসামি জেলখানায় আটক আছেন। তারা দ্রুত বিচার পাবার হকদার।’ মামলার দ্রুত নিষ্পত্তিতে তিনি আসামিপক্ষের আইনজীবীদেরও সহায়তা কামনা করেন।
বিডিআর আইনে বিদ্রোহের বিচার
অন্যদিকে পিলখানায় হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় বিডিআর আইনে বিদ্রোহের বিচারের লক্ষ্যে ২০০৯ সালের ১৫ নভেম্বর বিডিআর(বিজিবি) সারা দেশে ছয়টি বিশেষ আদালত গঠন করে। এর মধ্যে ঢাকায় সদর দফতর পিলখানায় দুইটি ও দেশের অন্যান্য স্থানে আরো চারটি আদালত স্থাপিত হয়েছে।
২০০৯ সালের ২৪ নভেম্বর রাঙামাটির রাজনগরে ১২ রাইফেল ব্যাটালিয়নের বিচার শুরুর মধ্য দিয়ে বিডিআর আইনে বিদ্রোহের বিচার-প্রক্রিয়া শুরু হয়।
বিজিবি সদর দফতর সূত্রে জানা গেছে, বিডিআর আইনে বিদ্রোহের বিচারে ৫৭টি ইউনিটের মোট অভিযুক্ত করা হয় ছয় হাজার ৪৫ জন বিডিআর সদস্যকে। এর মধ্যে ঢাকায় অবিস্থত ইউনিট ১১টি এবং বাকি ৪৬টি ইউনিট দেশের বিভিন্ন স্থানে।
ইতিমধ্যেই ঢাকার পাঁচটি এবং সারা দেশের ৪৬টিসহ মোট ৫১টি ইউনিটের বিচার কাজ সম্পন্ন হয়েছে। এসব ইউনিটে অভিযুক্ত তিন হাজার ১১৩ জনের মধ্যে তিন হাজার ৩৬ জনকে সর্বনিম্ন চার মাস থেকে সর্বোচ্চ সাত বছর পর্যন্ত বিভিন্ন সাজা দেওয়া হয়েছে। এছাড়াও ৭৭ জন বেকসুর খালাস পেয়েছেন।
৫৭টি ইউনিটের মধ্যে অবশিষ্ট ছয়টি ইউনিটের সবগুলোই ঢাকায় বিজিবি সদর দফতরে অবস্থিত। এসব ইউনিটের বিচার কাজ চলছে। ছয়টি ইউনিটে মোট অভিযুক্তের সংখ্যা দুই হাজার ৯৩২ জন।
এর মধ্যে বিজিবি হাসপাতাল ইউনিটে ২৫৬ জন, সদর ব্যাটালিয়নে ৭৩৫ জন, সকল পরিদফতরে ৩৩৬ জন, ১৩ রাইফেল ব্যাটালিয়নে ৬২১ জন, ৩৬ রাইফেল ব্যাটালিয়নে ৩১০ জন, ৪৪ রাইফেল ব্যাটালিয়নে ৬৭৪ জন অভিযুক্ত বিডিআর সদস্য রয়েছেন। |