এ বিষয়ে দ্বিমত থাকতে পারে না৷ তার মধ্যে ভারতের কয়েকটি রাজ্যের আমের খ্যাতি ভুবনজোড়া৷ স্বাদে, গন্ধে আর রঙের বাহারে মন কেড়ে নেয়৷ উত্তর প্রদেশের দশেরি, ল্যাংড়া আর চৌষা জাতের আম তো ‘একম অদ্বিতীয়ম’!
উত্তর প্রদেশের আমের সঙ্গে জড়িয়ে আছে বাদশাহি খানদানের ইতিহাস৷ যেমন আমের রাজা দশেরির কথাই ধরা যাক৷ উত্তর প্রদেশের রাজধানী লক্ষৌ থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার রাস্তা পার হলে পড়ে মালিহাবাদ নামে একটা জায়গা৷ উন্নত প্রজাতির আম দশেরির জন্য এই এলাকা চিহ্নিত৷ এখানে ৩৫ হাজার হেক্টর জমি জুড়ে আছে আমের বাগান৷ রাজ্যের মোট আমের ফলনের ১২.৫ শতাংশ আম এই মালিহাবাদেই হয়৷ তাই মালিহাবাদকে বলা হয় ‘‘আমের রাজধানী”৷
ভারতের আম উৎপাদক সংস্থার সভাপতি ইনসরাম আলি বলেন, এই মালিহাবাদেই আছে সবথেকে প্রাচীন আম গাছ৷ একই পরিবারের বংশধরেরা দেড়শো থেকে দু’শো বছর ধরে এই আম বাগানের দেখাশোনা এবং আমের ব্যবসা করে আসছেন৷
মালিহাবাদি আম বাগানের দশেরি, ল্যাংড়া, চৌসা, সফেদা এবং অন্যান্য বিখ্যাত জাতের আমের কাছে অন্য জাতের আম টিকতে পারে না৷ তাই আম রসিকদের কাছে মালিহাবাদ হলো, ‘‘গার্ডেন অফ ইডেন”৷ মালিহাবাদি দশেরি আমকে ২০১০ সালে দেয়া হয় ভৌগলিক বিশেষত্বের মর্যাদা বা জিওগ্রাফিক্যাল ইন্ডকেশন স্টেটাস, জিআই৷ অষ্টাদশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে এখানে হতো ১,৩০০ জাতের আম৷ এখন তা নেমে এসেছে ৭০০-তে৷
মালিহাবাদ আম বাগানের বর্তমান মালিক আমের জাদুকর পদ্মশ্রী কলিমুল্লা খান জানান, লক্ষৌ থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে কাকোরি বলে একটা গ্রাম আছে – যেখানে ৩০০ বছরের পুরানো একটা দশেরি আম গাছ আছে, যার মালিক ছিলেন লক্ষৌ-এর নবাব৷ প্রবাদ আছে, ওই বিরল জাতের আম গাছ অন্য কোথাও অন্য কেউ যাতে লাগাতে না পারে, তার জন্য ওই গাছের আমের আঁটিতে ফুটো করে দিতেন৷ পাখিরা যাতে মুখে করে অন্যত্র নিয়ে যেতে না পারে, তার জন্য পুরো আম বাগান ঘেরা থাকতো জাল দিয়ে৷ সেই থেকে ওই গ্রামের নাম হয় দশেরি গাঁও৷
স্থানীয় লোকজনদের মতে অবশ্য মালিহাবাদ এবং দশেরি আম নিয়ে নানা গল্পকথা আছে৷ কেউ কেউ বলেন, প্রায় ২০০ বছর আগে ফকির মহম্মদ খান ওরফে গয়া মালিহাবাদির নেতৃত্বে একদল আফ্রিদি পাঠান ভাগ্যান্বেশনে আফগানিস্তানের সীমান্তে খাইবার গিরিপথের এক গ্রাম থেকে পেশাওয়ার হয়ে হিন্দুস্থানে আসে৷ প্রথমে তাঁরা আসে উত্তর প্রদেশের ফারুকাবাদে৷ সেখান থেকে অবধ-লক্ষৌ-এ৷ মহম্মদ খানের বীরত্ব এবং যুদ্ধ বিদ্যার নৈপূণ্য দেখে অবধের নবাব খুশি হন৷ বকশিস হিসেবে মহম্মদ খান ফলের বাগান করার অনুমতি প্রার্থনা করেন নবাব বাহাদুরের কাছে৷ সঙ্গে সঙ্গে তা মঞ্জুর হয়৷ কথিত আছে, মহম্মদ খান প্রথম মালিহাবাদে আমের চারা রোপণ করেন৷
তবে দশেরি আম বাগান সবই এককালে ছিল নবাবদের৷ পরে অন্যদের ইজারা দেয়া হয়৷ বাংলায় আমের খ্যাতি এককালে ছিল মুর্শিদাবাদের নবাব আমলে৷ এখনো বাংলার হিমসাগর, ল্যাংড়া, ফজলি আমের কদর আছে যথেষ্ট৷ কিন্তু সংরক্ষণের সুবিধা না থাকায় আম চাষিরা মার খায়৷
ভারতে ১২ লাখ হেক্টরে আমের ফলন হয় গড়ে বছরে ১১ লাখ টন৷ সবথেকে বেশি হয় অবিভক্ত অন্ধ্রপ্রদেশ ও উত্তর প্রদেশে প্রায় ২৬ শতাংশ৷ তারপর বিহার পশ্চিমবঙ্গ, কেরালা, মহারাষ্ট্র ও তামিলনাড়ুতে৷ জাতীয় হর্টিকালচারাল বিভাগ বিভিন্ন সংকর জাতের আম নিয়ে গবেষণা করছে৷ যেমন নীলম ও দশেরির সংকর জাতের আম হলো মল্লিকা৷ আম্রপালিও তাই৷ রত্না হলো আলফনসো আর নীলমের সংকর৷
আমের ফলন ভালো এবং উন্নত মানের হয় যেখানে গ্রীষ্ম মণ্ডলীয় আবহাওয়া আছে৷ অর্থাৎ বৃষ্টি, আদ্রতা ও কুয়াশা থাকে৷ এই সব ভৌগলিক কারণে ভারত বিশ্বের বৃহত্তম আম উৎপাদক দেশ৷ বিশ্বের ৬০ শতাংশ আম ভারতেই হয়৷ এর মধ্যে ৪০ শতাংশ আম রপ্তানি হয় প্রধানত ইউএই, কুয়েত ও মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশে৷ কিছুটা হয় ইওরোপিয়ান ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলিতেও৷ রফতানি বাজারের বিশেষ চাহিদা আলফনসো আর দশেরি আমের৷ সূত্র: ডিডব্লিউ