রাজধানীর পল্লবীর কালশীতে আটকে পড়া পাকিস্তানি ক্যাম্পের বিহারীদের সাথে পুলিশ ও স্থানীয় জনতার সংঘর্ষ ও অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় একই পরিবারের ৯ জনসহ ১০ জন নিহত হয়েছেন। সংঘর্ষের এক পর্যায়ে পুলিশের উপস্থিতিতে স্থানীয় জনতা বিহারীদের কয়েকটি ঘরে আগুন ধরিয়ে দেয়। এতে একটি ঘরে আটকে পড়ে একই পরিবারের ৯ জন অগ্নিদগ্ধ হয়ে নিহত হন।
আজ শনিবার ভোর ৫টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত দফায় দফায় এ সংঘর্ষ চলে। তবে বিকাল ৩টার পর ঐ এলাকার পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়। শবে বরাতের রাতে আতশবাজির ঘটনাকে কেন্দ্র করে প্রথমে এ সংঘর্ষের সূত্রপাত হয়। শুক্রবার গভীর রাত থেকে শনিবার ভোর পর্যন্ত ঐ এলাকায় এতটাই আতশবাজি ফোটানো হয় যে স্থানীয় সাধারণ মানুষের মধ্যে আতংকের সৃষ্টি হয়।
স্থানীয় সংসদ সদস্য ইলিয়াস মোল্লার স্থাপিত রাজু বস্তিতে পাকিস্তানি ক্যাম্প থেকে বিদ্যুত লাইনের সংযোগ স্থাপন নিয়ে আগে থেকেই দ্বন্দ্ব ছিল। ঐ ক্যাম্প থেকে বিদ্যুত সংযোগ রাজু বস্তিতে দেয়া হয়নি। এর জের ধরে ভোরবেলা আতশবাজির প্রতিবাদকারী স্থানীয় জনতাদের সাথে যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা হামলায় অংশ নেয়। প্রায় দুই ঘণ্টা ধরে উভয় পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষের পর সকাল ৭টার দিকে স্থানীয় জনতারা ক্যাম্পের কয়েকটি ঘরে তালা ঝুলিয়ে দিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। এসময় আগুন নেভাতে আসা বিহারীদের ওপর স্থানীয় জনতা হামলা চালায়। পুলিশও নির্বিচারে গুলি চালায়। অগ্নিকাণ্ডের দেড় ঘণ্টা পর ঘটনাস্থলে ফায়ার সার্ভিসের ৩টি ইউনিট গিয়ে আগুন নেভায়। একটি ঘরেই একই পরিবারের ৮ জন পুড়ে অঙ্গার হয়। এরা হলেন, ইয়াসিন আলীর স্ত্রী বেবি আক্তার (৪৫), তিন মেয়ে শাহানি (২০), আফসানা (১৮), রুখসানা (১৪), যজম ছেলে লালু (১২) ও ভুলু (১২), পুত্রবধূ শিখা (১৯) ও শাহানির ছেলে মারুফ (৩)। ইয়াছিনের ঘরে তালা ঝুলিয়ে আগুন দেয়ার পর তার ছেলে আশিক তাদেরকে উদ্ধার করতে গিয়েছিলেন। এসময় হামলাকারীরা আশিকের মাথায় ধারালো অস্ত্র দিয়ে কোপ দেয়। সেখানেই আশিক অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা যান। পাশাপাশি ঘটনাস্থল থেকে অগ্নিদগ্ধ অবস্থায় বেবি আক্তারের আরেক মেয়ে ফারজানাকে (১৬) উদ্ধার করে ঢাকা মেডিক্যালে ভর্তি করা হয়।
ভোর থেকে চলা এ সংঘর্ষে পুলিশ শত শত রাউন্ড টিয়ার সেল ও রাবার বুলেট নিক্ষেপ করে। পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে এন্টি পারসুনেল কার (এপিসি) দিয়ে এই এলাকায় গুলি ছোঁড়ে। পুলিশের গুলিতে আজাদ (৩০) নামে এক অবাঙালি যুবক গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর তাকে ঢাকা মেডিক্যালে নেয়া হলে চিকিত্সকরা মৃত ঘোষণা করেন। পুলিশের গুলি ও স্থানীয় জনতার হামলায় অন্তত অর্ধশত ব্যক্তি আহত হন। এদের মধ্যে বদির উদ্দিন (৫৬), তার ছেলে আরজু (১৮), পুলিশের সোর্স আসলাম (৫৫), সরদার (৬০), নাদিম (৩০) ও আমজাদকে (৩৫) গুলিবিদ্ধ অবস্থায় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
আজ সকালে ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা গেছে, অগ্নিদগ্ধ হয়ে নিহতদের লাশ সকালেই ক্যাম্পের ভিতর তাদের স্ট্রাডেন্ড পাকিস্তানি জেনারেল রিপ্যাট্রিয়েশন কমিটির (এসপিজিআরসি) অফিসে রাখা হয়েছে। সকাল থেকে লাশগুলো নেয়ার জন্য পুলিশ চেষ্টা করতে থাকে। ক্যাম্পের বাসিন্দারা অভিযোগ করেন, স্থানীয় সংসদ সদস্য ইলিয়াস মোল্লার লোকজন এই হামলার সাথে জড়িত। লাশ নিতে হলে ঘটনাস্থলে সংসদ সদস্যকে আসার দাবি জানান তারা।
শুক্রবার রাত থেকে ঐ এলাকায় আতশবাজির ঘটনায় মুসল্লীরা বিরক্ত হন। ভোর ৫ টার দিকে আতশবাজি বন্ধ করার জন্য বাউনিয়া বাজার এলাকা থেকে স্থানীয় যুবলীগ নেতা জুয়েল রানা, গেসু, বিল্লাল, জাহিদ, হেলু, জালালসহ অন্তত ২০/২৫ জন যুবক আটকে পড়া পাকিস্তানি ক্যাম্পে যায়। তারা আতশবাজি বন্ধ করার দাবি করলে উভয় পক্ষের মধ্যে শুরু হয় ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া। এসময় টহল পুলিশের একটি দল দুই পক্ষকে ধাওয়া দিয়ে শান্ত করার চেষ্টা করে। এ ঘটনার প্রায় এক ঘণ্টা ধরে দুই পক্ষের মধ্যে পুলিশের সামনে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা চলে। কিছু সময় পরে পল্লবী ও মিরপুর থানা থেকে কয়েক প্লাটুন পুলিশ সেখানে উপস্থিত হয়। পুলিশ এক পর্যায়ে ক্যাম্প লক্ষ্য করে শর্টগানের গুলি ছুঁড়তে থাকে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে টিয়ার সেল ছোড়ে। এসময় বস্তির ভিতর স্থানীয় যুবলীগ, ছাত্রলীগের সাথে বিহারীদের ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া চলে। এক পর্যায়ে ক্যাম্পের বাসিন্দারা কোনঠাসা হয়ে পড়লে পুলিশ রাবার বুলেট ছুড়তে ছুড়তে কাছাকাছি চলে যায়। এসময় যুবলীগ ও ছাত্রলীগ বিশেষ করে রাজু বস্তির বাসিন্দারা কালশী রোডের সাথে বিহারী ক্যাম্পের কয়েকটি ঘরে তালা ঝুলিয়ে দেয়।
ক্যাম্পের প্রত্যক্ষদর্শীদের মধ্যে নাহিদ জানান, আগুন ধরিয়ে দেয়ার আগে একটি গ্যালন থেকে কেরোসিন ছিটানো হয়। আগুন ধরার সাথে সাথে দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকে। তার ঘরে রাখা মেয়ের বিয়ের জন্য ২ ভরি স্বর্ণালঙ্কার ও ৫০ হাজার টাকা লুট করে। প্রত্যক্ষদর্শী মমতাজ বেগম জানান, ক্যাম্পের ভিতর আত্মগোপন করার পর তাদের ধারণা ছিল যে পুলিশ টিয়ারসেল ছুড়ছে। কিন্তু কিছু সময় পর তারা দেখেন যে দাউ দাউ করে আগুন ঝলছে। কিন্তু ততক্ষণে সব শেষ।
ঘটনার পর লাশগুলো ক্যাম্পের বাসিন্দারা উদ্ধার করে তাদের এসপিজিআরসি অফিসে রাখে। এরপর এই লাশ উদ্ধার নিয়ে সকাল ৮ টা দিয়ে বিকাল ৩ টা পর্যন্ত পুলিশের সঙ্গে ক্যাম্পবাসীদের কয়েক দফা ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া চলে।
বিকাল ৩ টার দিকে ঢাকা জেলা প্রসাশক শেখ ইউসুফ হারুনের উপস্থিতিতে পুলিশ লাশগুলো উদ্ধার করে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ মর্গে নিয়ে যায়। সেখানে নিহত প্রত্যেকের জন্য ক্ষতিপূরণ বাবদ ২০ হাজার টাকা দেয়ার ঘোষণা দেন জেলা প্রশাসক। এছাড়া যাদের বাড়ি পুড়ে গেছে, তাদের একটি তালিকা করে ক্ষতিপূরণ দেয়া হয়।
ঘটনার পর ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিত্সাধীন আহতদের দেখতে যান স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী, পুলিশের আইজি হাসান মাহমুদ খন্দকার ও ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার বেনজীর আহমেদ। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেন, যে ঘটনা ঘটেছে তা অত্যন্ত দুঃখজনক। এ ঘটনা কারো কাম্য নয়। ঘটনায় উস্কানিদাতাদের আইনের আওতায় আনা হবে।
এ ঘটনা তদন্তের জন্য ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের যুগ্ম কমিশনার মীর রেজাউল ইসলামকে প্রধান করে চার সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিকে ঘটনা তদন্ত করে পুলিশ কমিশনারের কাছে তদন্ত রিপোর্ট জমা দিতে বলা হয়েছে।
এদিকে, আটকে পড়া পাকিস্তানি ক্যাম্পে এ ধরনের ঘটনার ব্যাপারে স্থানীয় সংসদ সদস্য ইলিয়াস মোল্লা জানান, যে ঘটনা ঘটেছে তা দুঃখজনক। এ ঘটনার সাথে তাকে জড়িয়ে যে অভিযোগ করা হচ্ছে তা মিথ্যা। ঘটনার সাথে কারা জড়িত তা তদন্ত করা হোক। তিনি আরো বলেন, ভোরে নামাজ পড়ে ঘুমিয়ে ছিলেন। আতশবাজির ঘটনায় পুলিশ একজন অবাঙালিকে আটক করে। এসময় অবাঙালিরা পুলিশের ওপর হামলা চালালে স্থানীয় মুসল্লীরা পুলিশের পক্ষ নেয়। আতশবাজির ঘটনার প্রতিবাদ করতেই এ ঘটনার সূত্রপাত।
পল্লবী থানার ওসি জিয়াউজ্জামান জানান, আতশবাজি ফুটানো নিয়ে ক্যাম্পে বিহারীদের দুই গ্রুপের মধ্যে মারামারি হয়। এ মারামারি বাঙালিদের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়ে। খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে তাদের নিবৃত করার চেষ্টা করে। এসময় বিহারীরা পুলিশের ওপর হামলা চালায়। তারা পুলিশের গাড়ি ভাংচুর করে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার পর পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে ৫২ জনকে আটক করার পর যাচাই বাছাই করে ৮ জনকে থানায় রাখা হয়েছে।