ইলেকট্রনিক মিডিয়া (টেলিভিশন ও বেতার) নিয়ন্ত্রণে কয়েকটি শর্ত দিয়ে জাতীয় সমপ্রচার নীতিমালা-২০১৪ চূড়ান্ত করেছে সরকার। সংশোধিত নতুন খসড়ায় বলা হয়েছে, সরাসরি বা বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে কোনভাবেই দেশবিরোধী এবং জনস্বার্থবিরোধী বক্তব্য প্রচার করা যাবে না। গতকাল সর্বশেষ প্রস্তুতকৃত সমপ্রচার নীতিমালাটির ওপর মতামত দিতে জনপ্রশাসন, অর্থ, ডাক ও টেলিযোগাযোগ, তথ্য প্রযুক্তি এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিবের কাছে পাঠিয়েছে তথ্য মন্ত্রণালয়। এ নীতিমালার বিষয়ে তিন কার্যদিবসের মধ্যে মতামত দেয়ার অনুরোধ করে চিঠির শেষে বলা হয়েছে, ‘বিষয়টি অত্যন্ত জরুরি’। বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাইলে তথ্য মন্ত্রণালয়ের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা মানবজমিনকে জানান, নীতিমালাটির উপর মতামত নেয়ার জন্য বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেয়া হয়েছে। তাদের কাছ থেকে মতামত পাওয়ার পর পরবর্তী পদক্ষেপ নেয়া হবে। তথ্য মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, নীতিমালাটি ২০১৩ সাল থেকে নড়াচড়া হচ্ছে। ওই নীতিমালার উপর মতামতও নেয়া হয়েছে। এখন বেশ কিছু কাঁটছাট করে নতুন সমপ্রচার নীতিমালা করা হয়েছে। আগের খসড়া নীতিমালাটি ১৪ পাতার হলেও নতুন নীতিমালাটি ১১ পাতার। তাই জারির আগেই নীতিমালাটি সংশোধন করা হয়েছে। কয়েকটি ধারা বাদ দিয়ে নিয়ন্ত্রণমূলক ধারা যোগ করা হয়েছে। নতুন নীতিমালায় সংবাদ ও অনুষ্ঠান সমপ্রচারে ২৯টি এবং বিজ্ঞাপন সমপ্রচারে ২৪টি শর্ত দেয়া হয়েছে। নীতিমালার তৃতীয় অধ্যায়ে সংবাদ ও তথ্যমূলক অনুষ্ঠান অংশের দ্বিতীয় শর্তে বলা হয়েছে, আলোচনামূলক অনুষ্ঠানে কোন প্রকার বিভ্রান্তিকর ও অসত্য তথ্য বা উপাত্ত দেয়া পরিহার করতে হবে। এ ধরনের অনুষ্ঠানে সকল পক্ষের যুক্তিগুলো যথাযথভাবে উপস্থাপনের সুযোগ থাকতে হবে। সরকার অনুমোদিত বেশ কিছু অনুষ্ঠান বাধ্যতামূলকভাবে প্রচার করার নিয়ম নীতিমালায় যোগ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, সরকার কর্তৃক অনুমোদিত বিভিন্ন জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠান, যেমন- রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানের ভাষণ, জরুরি আবহাওয়া বার্তা, স্বাস্থ্য বার্তা, গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা, প্রেস নোট ও অন্যান্য জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠান জনস্বার্থে যথাযথভাবে সমপ্রচার বা প্রচার করতে হবে। এছাড়া জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিন, জাতীয় শোক দিবস, জাতীয় ও স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ইত্যাদি উপলক্ষে যথাযথ মর্যাদার সঙ্গে অনুষ্ঠান প্রচার করতে হবে। নীতিমালা বলা হয়েছে, মানবিক অনুভূতিতে আঘাত করে এমন দৃশ্য যেমন হত্যাকা-, দুর্ঘটনায় নিহত ও আত্মহত্যাকারীর মৃতদেহ, মানুষ ও প্রাণী নির্যাতন এবং ধর্ষণ ও ব্যাভিচার দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত কোন নারী বা শিশুর স্থির বা চলচ্চিত্র প্রদর্শন করা যাবে না। এছাড়া কোন প্রকার অশোভন উক্তি বা আচরণ করা এবং অপরাধীদের কার্যকলাপের কৌশল প্রদর্শন যা অপরাধ সংগঠনের ক্ষেত্রে নতুন পদ্ধতি প্রবর্তনে সহায়ক হতে পারে এমন দৃশ্য প্রচারের ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। ইলেকট্রনিক মিডিয়াতে বিজ্ঞাপন প্রচারেও সরকারের নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়েছে খসড়া সমপ্রচার নীতিমালায়। বলা হয়েছে, বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই)-এর তালিকাভুক্ত পণ্য সামগ্রীর বিজ্ঞাপন প্রচারের ক্ষেত্রে ওই প্রতিষ্ঠানের মান নিয়ন্ত্রণ সনদপত্র উপস্থাপন করতে হবে। অন্যান্য ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের মান নিয়ন্ত্রণ সনদপত্র উপস্থাপন করতে হবে। এছাড়া জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও জাতীয় নেতৃবৃন্দ এবং ভাষা আন্দোলন, গণঅভ্যুত্থান, মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা দিবস ও বিজয় দিবসের মতো তাৎপর্যপূর্ণ বিষয়গুলোর মর্যাদা সমুন্নত রাখতে এগুলো প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বাণিজ্যিক বিজ্ঞাপনচিত্রে অন্তর্ভুক্ত করা থেকে বিরত থাকতে হবে। বিজ্ঞাপনের ভাষা, দৃশ্য বা নির্দেশনা ধর্মীয় অনুভূতি, অসামপ্রদায়িক চেতনা এবং রাজনৈতিক অনুভূতির প্রতি পীড়াদায়ক হতে পারবে না। নীতিমালায় বলা হয়েছে, বিজ্ঞাপনে প্রতিযোগী পণ্যের তুলনা বা নিন্দা করে শ্রেষ্ঠত্ব দাবি করা যাবে না এবং এমন কোন বর্ণনা বা দাবি প্রচার করা যাবে না যাতে জনগণ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে প্রতারিত হতে পারেন। সংবাদ আকারে এবং কোন অনুষ্ঠানের অংশ হিসেবে বিজ্ঞাপন প্রচার থেকে বিরত থাকতে হবে। বিজ্ঞাপনের অডিও মানসম্মত এবং শ্রুতিমধুর হতে হবে এবং বিজ্ঞাপনে নোংরা ও অশ্লীল শব্দ, উক্তি, সংলাপ, জিঙ্গেল ও গালিগালাজ পরিহার করতে হবে। একই সঙ্গে অংশগ্রহণকারী মডেলদের পোশাক-পরিচ্ছদ শালীনতাপূর্ণ হতে হবে। ৭ ধরনের বিজ্ঞাপন প্রচার করা যাবে বলে নীতিমালায় শর্ত দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের ছাড়পত্রবিহীন বা অননুমোদিত অর্থলগ্নীকারী প্রতিষ্ঠান, সামাজিক ও আইনগতভাবে স্বীকৃত নয় এমন ক্লাব বা সমিতি, লাইসেন্সবিহীন ব্যবসায়িক কর্মকা- এবং কর্মসংস্থান প্রতিষ্ঠান, বাজি ধরা, জুয়া খেলা বা এ সংক্রান্ত সংস্থা, কোম্পানি বা ব্যক্তি, তামাক ও তামাকজাত পণ্য, মদ বা অ্যালকোহল মিশ্রিত নেশা জাতীয় পণ্য (অ্যালকোহলের পরিমাণ যাই হোক না কেন) এবং মাদক বা নেতা জাতীয় পণ্য, পুরুষ, মহিলা ও শিশু-কিশোরদের স্লিমিং, ওজন হ্রাস বা সীমিতকরণ ও ফিগার নিয়ন্ত্রণের জন্য ব্যবহৃত অননুমোদিত ওষুধপত্র ও চিকিৎসা এবং যৌন দুর্বলতা, অকাল বার্ধক্য ইত্যাদি সংক্রান্ত চিকিৎসা, স্বপ্নে পাওয়া ওষুধ, মাদুলি, কবচ, জাদু ইত্যাদি এবং সরকারের অনুমোদনবিহীন আবাসিক ভবন বা স্থাপনা। নীতিমালায় বলা হয়েছে, বিজ্ঞাপন সমপ্রচারের ক্ষেত্রে জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি ও জাতীয় শিশুনীতিসহ অন্যান্য প্রাসঙ্গিক নীতিসমূহ এবং মাতৃদুগ্ধ বিকল্প, শিশুখাদ্য, বাণিজ্যিকভাবে প্রস্তুতকৃত শিশুর বাড়তি খাদ্য ও তা ব্যবহারের সরঞ্জামাদি (বিপণন নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০১৩ অনুসরণ করতে হবে। যে কোন খাদ্য বা পানীয়ের বিজ্ঞাপনে ওই খাদ্য বা পানীয়ের পুষ্টি ও খাদ্যগুণ এবং স্বাস্থ্যগত প্রভাব সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করতে হবে এবং সুপার ইম্পোজ করে স্পষ্টাক্ষরে দেখাতে হবে। বিজ্ঞাপনে ধর্ষণ, ব্যাভিচার, অশ্লীল ছবি বা চলচ্চিত্র, নির্যাতন, স্নায়ুর উপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে এমন দৃশ্য যেমন: ফাঁসি, শ্বাসরোধ, আত্মহত্যা, অঙ্গবিচ্ছেদ ইত্যাদি নারী, শিশু, কিশোর, বৃদ্ধ বা অসুস্থ ব্যক্তির প্রতি সহিংসতা বা তাদের প্রতি শারীরিক, মানসিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক নেতিবাচক মনোভাব সৃষ্টি করে এ ধরনের দৃশ্য দেখানো পরিহার করতে হবে। ওদিকে সমপ্রচার নীতিমালাটির প্রথম অধ্যায়ে এর পটভূমি, উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য এবং কৌশল বর্ণনা করা হয়েছে। দ্বিতীয় অধ্যায়ে সমপ্রচার লাইসেন্সের বিষয়ে বলা হয়েছে। খসড়ায় বলা হয়েছে, নীতিমালার কার্যক্রম বাস্তবায়ন ও পরীবিক্ষণের জন্য স্বাধীন সমপ্রচার কমিশন গঠন করা হবে। কমিশন অনুষ্ঠান সমপ্রচারের জন্য প্রয়োজনীয় বিধিমালা প্রণয়ন এবং সমপ্রচারের মান নির্ধারণ ও তার বাস্তবায়ন নিশ্চিত করবে। ভবিষ্যতে এ কমিশনের মাধ্যমেই লাইসেন্স দেয়ার কার্যক্রম চলবে। তার আগে তথ্য মন্ত্রণালয় কাজগুলো করবে।