ক্রিকেটের ঝলমলে দুনিয়া থেকে কারাগারের অন্ধকার। মাঝে নাটকীয়তায় ভরা চোদ্দ মাস। গত বছরের লর্ডস টেস্টে স্পট ফিক্সিংয়ের দায়ে সেই করুণ ভবিতব্যের কুঠুরিতে আটকা পড়লেন পাকিস্তানের তিন তারকা- সলমান বাট, আসিফ ও আমের। দোষী সাব্যস্ত হয়ে গিয়েছিলেন দু’দিন আগেই।
বৃহস্পতিবার লন্ডনের সাউথওয়ার্ক ক্রাউন কোর্টের বিচারপতি জেরেমি কুক ঐতিহাসিক রায়ে কলঙ্কিত পাক-ত্রয়ীকে কারাদণ্ডে দণ্ডিত করেন। সর্বাধিক আড়াই বছর জেল হয়েছে ফিক্সিং কাণ্ডের ‘নাটের গুরু’ তথা তৎকালীন অধিনায়ক সলমান বাটের। আসিফ এবং আমেরের মেয়াদ যথাক্রমে এক বছর ও ছয় মাস। এছাড়া দুই বছর আট মাসের কারাদণ্ড হয়েছে গড়াপেটায় অভিযুক্তদের সঙ্গে জড়িত জুয়াড়ি মজিদ মাজহারের।
বাইশ গজে দুর্নীতি কো নো ঘটনা নয়। অতীতে ম্যাচ গড়াপেটায় দোষী সাব্যস্ত হয়ে ক্রিকেট থেকে নির্বাসিত হয়েছেন হ্যান্সি ক্রোনিয়ে, সেলিম মালিক, মহম্মদ আজহারউদ্দিনের মতো তারকারা। কিন্তু আদালতের বিচারে দুর্নীতির দায়ে কারাবাসের দৃষ্টান্ত খেলাটার সুপ্রাচীন ইতিহাসে নেই। সেইদিক থেকে বৃহস্পতিবারের রায় নিঃসন্দেহে ঐতিহাসিক।
২০১০-র আগস্টে ইংল্যান্ড ও পাকিস্তানের মধ্যে চতুর্থ টেস্টে ‘স্পট ফিক্সিং’ নামক যে চাঞ্চল্যকর জুয়া-বিতর্ক মাথাচাড়া দিয়েছিল, তার চরম পরিণতি নির্ধারিত হলো বাট, আসিফ, আমিরের কারাদণ্ডে। প্রায় তিন সপ্তাহ ধরে শুনানির পর বিচারপতি জেরেমি কুক এদিন শাস্তি ঘোষণা করতে গিয়ে বলেন, “এই ঘটনা শুধু ক্রিকেটের সুনাম নষ্টই করেনি, তার চেয়েও বড় আঘাত করেছে খেলাটার পেশাদারিত্ব এবং সমর্থকদের বিশ্বাসকে। তাই আইনের চোখে আপনাদের অপরাধ অত্যন্ত গুরুতর।” সেইসঙ্গে তিনি যোগ করেন, “খেলাটার ভাবমূর্তি ও পরিচ্ছন্নতায় আপনারা যে সন্দেহের বীজ পুঁতে দিলেন তা সহজে মুছবে না। আপনারা প্রতারক। প্রতারণা করেছেন ক্রিকেটের সঙ্গে, দর্শকদের সঙ্গে, আপনাদের দেশের সঙ্গে। এই অপরাধ ক্ষমার অযোগ্য। কারাদণ্ডই হবে আপনাদের দুষ্কর্মের উপযুক্ত শাস্তি।”
প্রাথমিক মন্তব্যের পর বিচারপতি একে একে তিন অপরাধীকেই আলাদাভাবে তীব্র ধিক্কারে বিদ্ধ করেন। প্রথমে ফিক্সিং ম্যাচে পাক দলের অধিনায়ক বাটকে উদ্দেশ্য করে জেরেমি কুক বলেন, “গোটা অপকর্মে নাটের গুরু আপনি। নিজে দুর্নীতিতে লিপ্ত হওয়ার পাশাপাশি ষড়যন্ত্রে জড়িয়েছেন সতীর্থদেরও। বিশেষ করে আমেরের মতো মাত্র ১৮ বছরের এক ক্রিকেটারকে এমন নিন্দনীয় কাজে শামিল করে আপনি ঘৃণ্য মানসিকতার পরিচয় দিয়েছেন। তাই আপনাকেই প্রধান আসামি চিহ্নিত করে আড়াই বছর হাজতবাসের দণ্ড দেওয়া হলো।”
প্রসঙ্গত, বাটের নির্দেশ মেনেই ওই টেস্টের বিশেষ বিশেষ মুহূর্তে নো-বল করে জুয়াড়িদের চাহিদা পূরণ করেন দুই পেসার আসিফ ও আমের। আসিফের উদ্দশ্যে বিচারপতি বলেন, “বাটের মতো আপনার কাছ থেকে কোনো নগদ অর্থ পাওয়া যায়নি ঠিকই, কিন্তু ফিক্সিংয়ে আপনার জড়িত থাকা সম্পর্কে আমরা নিঃসন্দেহ। আপনার সাজা এক বছরের জেল।”
তারপর তরুণ আমেরের প্রতি খানিকটা সহানুভূতির সুরে তিনি জানান, “শুরুতেই অপরাধ স্বীকার করে নেয়ার জন্য আপনার তারিফ করতে হবে। হয়তো অধিনায়কের চাপ আপনাকে এই ঘটনায় প্রভাবিত করে থাকবে। কিন্তু আইন তো আর সে কথা শুনবে না! তবু আপনার বয়স ও গ্রাম্য সাধাসিধে মনোভাবের কথা মাথায় রেখে ছয় মাসের কারাদণ্ড দেয়া হলো। অন্যথায় যা হতো নয় মাসের।” কারাদণ্ড ঘোষণার পাশাপাশি দোষীদের আইনী খরচ মেটানোর নির্দেশ দেন বিচারপতি।
ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ২০১০-র জুলাই-আগস্টে চার টেস্টের সিরিজে পাক দল সন্দেহজনক ভাবে ১-২পিছিয়ে পড়ার পর লর্ডসের শেষ ম্যাচে তারা স্ট্রিং অপারেশন (অন্তর্তদন্ত) চালিয়েছিল অধুনা বন্ধ হয়ে যাওয়া ‘নিউজ অব দ্য ওয়ার্ল্ড’। আর তাতেই ঝুলি থেকে বেরিয়ে পড়েছিল বেড়াল। জানা যায়, ম্যাচ না ছেড়েও খেলার একটি অংশের উপর বেটিং নির্ধারণে জুয়াড়ি মজিদ মাজহারের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধেছিলেন অভিযুক্তরা। ভিডিও প্রমাণ সমেত স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের কাছে যে অভিযোগ দায়ের করেছিল ‘নিউজ অব দ্য ওয়ার্ল্ড’, তাতে অর্থের বিনিময়ে তাদের স্পট ফিক্সিংয়ে জড়িত থাকার বলিষ্ঠ প্রমাণ ছিল। তার সঙ্গে বাটদের অপরাধ আরও সুনিশ্চিত করেছে স্ট্রিং অপারেশনে গ্রেফতার হওয়া জুয়াড়ি মজিদের স্বীকারোক্তি।
সাউথওয়ার্ক ক্রাউন কোর্টের ঘোষিত রায়ের বিরুদ্ধে আবেদন জানানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বাট ও আসিফ। তাদের পক্ষের দুই আইনজীবী জানিয়েছেন শুক্রবারই আবেদন জানানো হবে। আমের অবশ্য সে পথে হাঁটছেন না। তার বয়সের কারণে হাজতে না রেখে তাকে অপ্রাপ্তবয়স্কদের সংশোধনাগারে পাঠানো হয়েছে। বাট ও আসিফকে অবশ্য শাস্তি ঘোষণার পরেই কাঠগোড়া থেকে সরাসরি কারাগারে নিয়ে যায় স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড পুলিস। তবু নিজের দেশে বিন্দুমাত্র সহানুভূতি জোটেনি কলঙ্কিত নায়কদের। বরং সমস্যা জর্জরিত পাক মুলুকের ভাবমূর্তি আরও ধূলিসাৎ হওয়ার খেদে দ্রুত ক্ষোভের আগুন ছড়িয়ে পড়ে। পোড়ানো হয় বাটদের কুশপুত্তলিকা। বৃহস্পতিবারের রায়কে দৃষ্টান্তমূলক আখ্যা দিয়ে স্বাগত জানিয়েছে বিশ্ব ক্রিকেটের নিয়ামক সংস্থা আইসিসি।