বাড়িওয়ালাদের দুঃসংবাদ, কিছুটা স্বস্তি মধ্যবিত্তের

বাড়িওয়ালাদের দুঃসংবাদ, কিছুটা স্বস্তি মধ্যবিত্তের

budget14_15আগামী অর্থবছরে বাজেটে শুল্ক ও মূল্য সংযোজন করের (মূসক) চেয়ে আয়কর খাতেই বেশি পরিবর্তন হচ্ছে। উদ্যোক্তাদের দাবি মেনে করপোরেট কর হারে পরিবর্তন, মধ্যবিত্তকে খানিকটা স্বস্তি দিতে করমুক্ত আয়সীমা বৃদ্ধি এবং রাজস্ব বাড়াতে ব্যাংকের মাধ্যমে বাড়িভাড়া পরিশোধের বিধানসহ বেশ কিছু বড় পরিবর্তন আনা হচ্ছে নতুন বাজেটে।

আসন্ন বাজেটে অপ্রদর্শিত আয় ঘোষণার সুযোগও থাকছে। আর শুল্ক খাতে এক হাজার ৬৬২টি পণ্যের ওপর সম্পূরক শুল্ক প্রত্যাহার করা হচ্ছে। আগামী ৫ জুন ২০১৪-১৫ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা করা হচ্ছে। বাজেটে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) এক লাখ ৪৯ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য দেওয়া হতে পারে।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘আমার নিজস্ব হিসাব অনুযায়ী, আগামী অর্থবছরে এনবিআরের রাজস্ব লক্ষ্য হওয়া উচিত এক লাখ ৪৩ হাজার কোটি টাকা। তবে করপোরেট করের হার কমানো, করমুক্ত আয়সীমা বাড়ানোসহ কর ছাড়ের দাবিগুলো মেটানো হলে এই লক্ষ্য অর্জন সম্ভব না-ও হতে পারে। তাই করের হার না বাড়িয়ে করের আওতা বাড়ানো উচিত।’

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) দায়িত্বশীল সূত্রে জানা গেছে, নন-পাবলিক ট্রেডেড কোম্পানির (শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত নয়) ক্ষেত্রে করপোরেট করের হার করা হচ্ছে ৩৫ শতাংশ। বর্তমানে এসব কোম্পানিকে সাড়ে ৩৭ শতাংশ হারে কর দিতে হয়। অন্যদিকে পাবলিকলি ট্রেডেড কোম্পানির ক্ষেত্রে (শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানি) করের হার আড়াই শতাংশ কমিয়ে ২৫ শতাংশ করা হচ্ছে। তবে কোনো কোম্পানি ১০ শতাংশের কম লভ্যাংশ দিলে ৩৫ শতাংশ কর দিতে হবে। আর ২০ শতাংশের বেশি লভ্যাংশ দিলে ওই কোম্পানিকে দিতে হবে সাড়ে ২২ শতাংশ কর।

অন্যান্য কোম্পানির ক্ষেত্রে অবশ্য করের হার অপরিবর্তিত থাকবে। সেই বিবেচনায় নতুন করপোরেট কর হারে মোবাইল ফোন অপারেটর কোম্পানিকে ৪৫ শতাংশ ও শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হলে ৪০ শতাংশ; ব্যাংক, বিমা, আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে সাড়ে ৪২ শতাংশ; মার্চেন্ট ব্যাংককে সাড়ে ৩৭ শতাংশ; নন-পাবলিকলি ট্রেডেড কোম্পানিকে ৩৫ শতাংশ এবং পাবলিকলি ট্রেডেড কোম্পানিকে ২৫ শতাংশ হারে কর দিতে হবে।

অন্যদিকে করপোরেট করের ক্ষেত্রে তৈরি পোশাক খাতের কোম্পানিগুলোকে দেওয়া বিশাল ছাড় আগামী অর্থবছরেও অব্যাহত থাকবে। সম্প্রতি তৈরি পোশাক খাতের কোম্পানির জন্য উৎসে কর দশমিক ৮০ শতাংশ থেকে কমিয়ে দশমিক ৩০ শতাংশ করা হয়েছে। মূলত দশমিক ৩০ শতাংশ হারে উৎসে করকে চূড়ান্ত কর হিসেবে বিবেচনা করা হয়। আর বছর েশষে উৎসে করকে ওই কোম্পানি ১০ শতাংশ কর দিয়েছে বলে ধরে নেওয়া হয়।

করপোরেট করের ৯৭ শতাংশই আসে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) বৃহৎ করদাতা ইউনিট (এলটিইউ) থেকে। আগামী অর্থবছরে করপোরেট কর হিসেবে প্রায় ১৮ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব লক্ষ্য নির্ধারণ করা হচ্ছে। চলতি অর্থবছরে করপোরেট কর হিসেবে ১৫ হাজার ১৭৫ কোটি টাকা আদায়ের লক্ষ্য রয়েছে। এর মধ্যে মোবাইল ফোন অপারেটর, ব্যাংক, বিমা, আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকেই প্রায় ৮০ শতাংশ কর পায় এনবিআর। এসব কোম্পানির ক্ষেত্রে করের হার পরিবর্তন করা হবে না। তাই নতুন দুটি ক্ষেত্রে করপোরেট কর হার কমানোর ফলে খুব বেশি রাজস্ব ক্ষতি হবে না বলে মনে করে এনবিআর।

করমুক্ত সীমা বাড়ছে: আগামী অর্থবছরে ব্যক্তিশ্রেণির করদাতাদের করমুক্ত সীমা বাড়ানো হচ্ছে। তবে আয়ের স্তর ও করের হার অপরিবর্তিত থাকবে। আগামী অর্থবছর থেকে দুই লাখ ৪০ হাজার টাকা পর্যন্ত করমুক্ত রাখার ঘোষণা দেওয়া হতে পারে। আর নারী ও ৬৫ বছরের বেশি বয়সী করদাতার করমুক্ত সীমা দুই লাখ ৭৫ হাজার টাকা আর প্রতিবন্ধীদের সীমা সোয়া তিন লাখ টাকা উন্নীত করা হতে পারে।
বর্তমানে সাধারণ করদাতাদের ন্যুনতম করমুক্ত সীমা দুই লাখ টাকা ২০ হাজার টাকা। নারী ও জ্যেষ্ঠ নাগরিকদের ক্ষেত্রে এই সীমা দুই লাখ ৫০ হাজার টাকা।

ব্যাংক হিসাবে বাড়িভাড়া: আগামী অর্থবছরের বাজেটে অন্যতম বড় একটি সিদ্ধান্ত হলো, বাড়িওয়ালাদের ওপর নজরদারি বাড়ানো হচ্ছে। কর ফাঁকি রোধে ব্যাংক লেনদেনের মাধ্যমে বাড়িভাড়া নিতে হবে বাড়ির মালিকদের। বছর শেষে আয়কর বিবরণী বা রিটার্নের সঙ্গে সেই হিসাবের লেনদেন মিলিয়ে দেখবেন কর কর্মকর্তারা। কেননা, আয়কর অধ্যাদেশের ২(৩) ধারা অনুযায়ী, কোনো করদাতা বাড়িভাড়া থেকে প্রাপ্ত অর্থ যদি যুক্তিসংগত না হয়, তবে কর কর্মকর্তা ওই এলাকার সমতুল্য অন্য বাড়িভাড়ার মূল্যের ওপর ভিত্তি করে ওই করদাতা বাড়িভাড়া বাবদ আয় নির্ধারণ করতে পারবেন।

এ ছাড়া এই প্রক্রিয়ায় ভাড়াটিয়ার আয়ও নজরদারিতে আনা যাবে বলে মনে করছেন এনবিআরের কর্মকর্তারা।
বাড়িভাড়ার ওপর উৎসে কর বসানোর চিন্তাভাবনা থাকলেও তা থেকে এনবিআর এখন সরে আসছে বলে জানা গেছে। ভাড়া দেওয়ার সময় উৎসে কর কেটে রাখা বেশ জটিল প্রক্রিয়া বলেই এ পথে আর হাঁটছে না এনবিআর। আর বাড়িওয়ালাদের করজালে আনতে টিআইএন বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে। এ ছাড়া রাজধানী ঢাকাসহ বড় শহরে নতুন হোল্ডিং নম্বর, ব্যক্তি পর্যায়ে (বাণিজ্যিক নয়) গ্যাস, বিদ্যুৎসহ অন্যান্য পরিষেবা নেওয়ার সময় টিআইএন থাকা বাধ্যতামূলক করা হতে পারে।

জরিপ চালিয়ে রাজধানী ঢাকা ও চট্টগ্রামে এক লাখ ৬২ হাজার টিআইএন নেই এমন বাড়িওয়ালার সন্ধান পেয়েছে এনবিআর। এসব বাড়িওয়ালাকে টিআইএন নেওয়ার জন্য চিঠি দেওয়া শুরু করেছে এনবিআর। আগামী বাজেটে এসব বাড়িওয়ালাকে করজালে আনার বিশেষ ঘোষণা থাকবে।

অপ্রদর্শিত আয় থাকছেই: আগামী অর্থবছরে অবৈধ বা কালোটাকা সাদা করার নতুন কোনো বিশেষ সুযোগ থাকছে না। এ বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত ফ্ল্যাট কিনে বিনা প্রশ্নে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল, এর মেয়াদও আর বাড়বে না।

তবে ২০১২-১৩ অর্থবছরের বাজেটে আয়কর অধ্যাদেশে ১৯ই নামে একটি ধারা সংযোজন করে বৈধ অপ্রদর্শিত আয় ঘোষণা দেওয়ার স্থায়ী সুযোগ করে দেওয়া হয়েছিল। এই ধারা অনুযায়ী, প্রদেয় করের ১০ শতাংশ অতিরিক্ত জরিমানা দিতে হয়। যদিও গত দুই অর্থবছরে এই সুযোগ নিয়ে কেউই অপ্রদর্শিত আয় ঘোষণা দেননি বলে জানা গেছে।

অপ্রদর্শিত আয় বৈধ করার স্থায়ী সুযোগ প্রসঙ্গে মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘এই সুযোগের অপব্যবহার হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। সুযোগের অপব্যবহার ঠেকাতে প্রশাসনিক ব্যবস্থা কঠোর করতে হবে। কেউ সত্যিকার অর্থে বৈধ আয় প্রদর্শন করেছেন কি না, তা-ও খতিয়ে দেখা উচিত।’

অন্যান্য প্রস্তাব: নতুন বাজেটে প্লাস্টিকশিল্পকে কর অবকাশ সুবিধায় আনা হতে পারে। এ ছাড়া মংস্য ব্যবসায় কর বাড়ছে। বর্তমানে মৎস্য খাত থেকে আয়ের ওপর ৩ শতাংশ কর রয়েছে। এটা ৫ বা ৭ শতাংশ করা হতে পারে। গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় প্রার্থীরা কম কর হারের সুবিধা নিয়ে মৎস্য খাত থেকে বিপুল আয় দেখিয়েছেন। এ ছাড়া কর প্রত্যর্পণের জন্য একটি আলাদা তহবিল গঠনের ঘোষণা থাকবে বাজেটে।

রাজধানী ঢাকা ও এর আশপাশের জেলাসমূহের পরিবেশ রক্ষায় এবার বিশেষ ধরনের করারোপের নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে এনবিআর। রাজধানী ঢাকা ও এর পাশাপাশি জেলা গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জে নতুন শিল্প কারখানা করলে বিদ্যমান কর হারের পাশাপাশি অতিরিক্ত করারোপ হতে পারে। আবার কোনো মালিক যদি কারখানা এসব জায়গা থেকে সরিয়ে নেন, তাহলে কর রেয়াত সুবিধা পাবেন। তবে করের হার এখনো চূড়ান্ত হয়নি।

১১৬২টি পণ্যে সম্পূরক শুল্ক প্রত্যাহার: গাড়ি, তৈরি পোশাক, সিরামিকস পণ্য, স্যানিটারি পণ্য, রেফ্রিজারেটর, শীতাতপনিয়ন্ত্রণ যন্ত্র, যন্ত্রাংশসহসহ এক হাজার ৩৬২টি পণ্যের ওপর ২০ থেকে ৬০ শতাংশ পর্যন্ত সম্পূরক শুল্ক রয়েছে। আগামী অর্থবছরে এক হাজার ১৬২টি পণ্যের ওপর সম্পূরক শুল্ক প্রত্যাহার হচ্ছে। বাকি ১৭০টি পণ্যের ওপর সম্পূরক শুল্ক থাকবে। এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, তৈরি পোশাক ও গাড়ি ছাড়া অন্য সব পণ্যের ওপর সম্পূরক শুল্ক প্রত্যাহার করা হতে পারে।

যাত্রীর ব্যাগেজ বিধিমালায় কিছু পরিবর্তন এনে সোনার ওপরও শুল্ক বাড়ানো হচ্ছে। প্রতি ১১ দশমিক ৬৬ গ্রাম (এক ভরি) ওজনের স্বর্ণপিণ্ডের ওপর তিন হাজার ৩০০ টাকা শুল্ক আরোপ হচ্ছে। বর্তমানে এই শুল্কের পরিমাণ মাত্র ১৫০ টাকা। তবে ২০০ গ্রাম পর্যন্ত স্বর্ণালংকার আনলে কোনো শুল্ক দিতে হয় না।

এ ছাড়া আগামী বাজেট অধিবেশনে মূল্য সংযোজন কর আইন পাস হচ্ছে। তাই আগামী অর্থবছরে মূসকে খুব বেশি পরিবর্তন হবে না। তবে স্থানীয় পর্যায়ে (সরবরাহ ও উৎপাদন) পর্যায়ে কিছু পণ্যের ক্ষেত্রে নতুন করে মূসক আরোপ হতে পারে৷

সূত্র : প্রথম আলো

বাংলাদেশ