নয়াদিল্লি: সারা পৃথিবীর রিয়েল এস্টেট এজেন্টদের মত রাহুল রিওয়ালও তার ক্লায়েন্টদের জিজ্ঞাসা করেন যে তাদের ছেলেমেয়ে কটা,পোষা প্রাণী কতগুলো। কারণ এতে তাদের জন্য বিকল্প নির্ধারণ সহজ হয়। কিন্তু ভারতে আরো একটি জটিল এবং প্রায় না বলা প্রশ্ন করা হয়:আপনি কী মুসলমান?
‘আমি একটি তালিকা তৈরি করে মুসলমানদের দেখাচ্ছি যে সেখানে অনেক বাড়িওয়ালা, এমনকি তাদের মধ্যবিত্ত প্রতিবেশীরাও তাদেরকে বাসা ভাড়া দেবে না’, বলছিলেন রাহুল।
তিনি বলেন, বেশিরভাগ লোকই তাদের ধর্মান্ধতা লুকানোর মত শিষ্টাচারটুকুও দেখায় না।
হিন্দুস্থান টাইমসের সহকারী সম্পাদক জিয়া হক বলছিলেন,কয়েক বছর আগে নয়া দিল্লিতে একটি অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া নেয়ার জন্য তিনি এক বছর খোঁজাখুঁজি করেন। তিনি হিন্দু অধ্যুষিত এলাকায় বাসা ভাড়া নিতে চেয়েছিলেন এবং তাকে ভাড়া দিতে অস্বীকৃতি জানানো হয়। অবশেষে মুসলমানদের একটি বস্তিতে তার ঠাঁই হয়।
জিয়া বলেন,‘ভারতের যেসব মধ্যবিত্ত মুলসমান শহরে বাস করার জন্য আসে তাদের প্রত্যেকের কাহিনী এ রকমই। অনেক সময় বাড়িওয়ালারা মুখের ওপর বলে দেয় যে তারা মুসলমানদের ভাড়া দেবেন না। অন্যরা হয়তো অজুহাত দেখিয়ে এড়িয়ে যায়।’
ভারতে মুসলমানদের বিরুদ্ধে বৈষম্য এতোটাই প্রকট যে তাদের বাড়ি ভাড়া দেয়া হয় না, চাকুরির জন্য আবেদন প্রত্যাখ্যান করা হয় এবং তারা ঋণ পান না।
মুসলমান সম্প্রদায় সাম্প্রতিক দশকগুলোতে শিক্ষা, কর্মসংস্থান,অর্থনৈতিক মর্যাদায় মারাত্মকভাবে পিছিয়ে পড়ছে। মুসলমানরা যেসব এলাকায় বাস করছেন সেখানে স্কুল নেই,নেই চিকিৎসা সুবিধা এবং তাদের জন্য ব্যাংক ঋণের সুবিধাও নেই।
এ অবস্থায় গত শুক্রবারের নির্বাচনের ফলাফলে হিন্দু জাতীয়তাবাদী ভারতীয় জনতা পার্টির বিপুল জয়ের ফলে অনেক মুসলমান বলছেন, তারা উদ্বিগ্ন যে ভারতে তাদের অবস্থান আরো ভঙ্গুর হতে পারে।
শুক্রবার এক সাক্ষাৎকারে বাড়ি মসজিদের ইমাম জহির আলম বলেন, ‘ সংখ্যালঘু কথাটির অর্থ আজকের মত স্পষ্ট কখনোই ছিল না।’
ভারতের সম্ভাব্য প্রধানমন্ত্রী হিন্দু নরেন্দ্র মোদির সাথে মুসলমানদের সম্পর্ক বিষাদময়, দেশটিতে যাদের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার প্রায় ১৫ শতাংশ।
২০০২ সালে পশ্চিমাঞ্চলীয় গুজরাট রাজ্যে অনিয়ন্ত্রিত দাঙ্গায় যখন প্রায় হাজারখানেক লোক নিহত হয় তখন মোদি ছিলেন এ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। নিহতদের বেশিরভাগই মুসলমান। তিনি একটি গুপ্ত পুলিশ বাহিনীর সদস্য ছিলেন বলে অভিযোগ আছে যাদের টার্গেট ছিল মুসলমানরা।
ধর্মীয় বিভাজনের কথা না বলে উন্নয়ন ও সুশাসনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে মোদি নির্বাচনী প্রচারণা চালিয়েছেন। তার মিত্ররা বলছেন, মোদির নেতৃত্বে ভারতে কেন্দ্রীয় সরকার হলে মুসলমানদের শঙ্কিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। অনেক মুসলমান একথা বিশ্বাসও করছেন।
রয়টার্সের বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, ভারতের যেসব স্থানে মুসলমানদের সংখ্যা প্রায় ২০ ভাগ সেখানে বিজেপি এবার ১০২টি আসনে জয়ী হয়েছে। ২০০৯ সালে এর মধ্যে মাত্র ২৪টি আসনে জিতেছিল বিজেপির প্রার্থীরা।
যেমন বারানসিতে ফ্যানের যন্ত্রাংশ বিক্রেতা মোহাম্মদ সাবির (২৫) বলেন, তিনি মোদিকে ভোট দেননি কিন্তু তার প্রশাসন নিয়ে তিনি শঙ্কিত নন।
‘তিনি এখন একজন জাতীয় নেতা এবং তার উচিৎ জাতি বিনির্মাণে মনোযোগ দেয়া। তিনি যদি সবাইকে নিয়ে এগিয়ে না যান তবে সফল হতে পারবেন না,’ বলছিলেন সাবির।
রাজনৈতিক ভাষ্যকার নির্জা চৌধুরী বলেন, ভারতের নির্বাচনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উত্তর প্রদেশ রাজ্যে বিপুল বিজয় পেয়েছে মোদির বিজেপি। কারণ, গত বছর সেখানে এক ভয়াবহ দাঙ্কায় ফলে নিম্নবর্ণের হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে যে ভোটের ঐক্য ছিল তা ভেঙ্গে যায়। কিন্তু এখন যেহেতু মোদি জয়ী হয়েছেন তাকে ভারতীয় মুসলমানদের আশ্বস্ত করতে হবে।
‘আগামী দিনগুলোতে তিনি (মোদি) সংখ্যালঘুদের কাছাকাছি পৌঁছান কিনা তার দিকে নজর রাখবে সারা দুনিয়ার বহু মানুষ।’
তবে ভারতীয় লেখক এবং মোদির অনুরাগী তাবলীন সিংহ বলেন, মোদির সমালোচকরা শুধু দাঙ্গা এবং হত্যাযজ্ঞে তার সংশ্লিষ্টতা খুঁজে বেড়ান। তারা স্বীকার করতে চান না যে এ ধরণের সহিংসতা ভারতীয় সমাজে দীর্ঘদিন ধরেই চলে আসছে।
১৯৪৭ সালে এক রক্তাক্ত অধ্যায়ের মধ্যে মুসলিম অধ্যুষিত পাকিস্তান এবং হিন্দু অধ্যুষিত ভারত জন্মলাভ করে। ১৯৮৪ সালে শিখ দেহরক্ষীর হাতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী নিহত হওয়ার পর হাজার হাজার শিখকে হত্যা করা হয়। হত্যাযজ্ঞে কংগ্রেস নেতারাও অংশ নেন। ভারতের গ্রামীণ এলাকায় বিভিন্ন বর্ণের মধ্যে সহিংসতা নিয়মিত ঘটনা।
তাবলীন সিংহ বলেন, ‘এটা একটা কুৎসিত ভারতীয় বাস্তবতা।’
ভারতের শীর্ষস্থানীয় হিন্দু পত্রিকার সাবেক সম্পাদক সিদ্ধার্থ ভারাদারাজন বলেন, এসব কারণেই মোদি একটি দুর্বল পছন্দ।
তিনি বলেন, ভারতের অনেক উদারপন্থী বুদ্ধজীবী মোদিকে ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতি হুমকি মনে করেন। অথচ সংবিধানই ধর্মনিরক্ষেপতাকে মহিমান্বিত করেছে।
তিনি বলেন, ‘ ভারতের যেসব খারাপ জিনিস আছে তার কোনো সমাধান মোদি দিতে পারবেন না। যদি কিছু হয় তা হলো অবস্থার আরো অবনতি।’
১৯৯০ সালে কুয়েতে ইরাকি আগ্রাসনের সময় ৭২২ জন ভারতীয়কে রক্ষায় এ বছর এক জাহাজ ক্যাপ্টেনকে সম্মানিত করা হয়েছে। তিনি বলছেন, শহরের অভিজাত এলাকায় একটি ফ্ল্যাট কিনতে চেয়েও তিনি ব্যর্থ হয়েছেন। কারণ, তিনি মুসলমান এবং কেউ তার নিকট ফ্ল্যাট বিক্রি করতে চান না।