দেশকে আর্থিক সঙ্কট থেকে উদ্ধারের জন্য একজন মনমোহন সিংকে খুঁজে পেয়েছিলেন নরসিংহ রাও। অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব কোনো রাজনীতিকের হাতে না দিয়ে একজন আমলাকে দিয়ে আর্থিক উদারবাদকে বাস্তবায়িত করেছিলেন তিনি। সেটা ছিল ’৯১ সাল।
এবার দেশের আর্থিক মানচিত্রকে বদলে দিতে মনমোহন সিংয়ের মতোই একজনকে খুঁজে চলেছেন নরেন্দ্র মোদী। যে ব্যক্তি তার আর্থিক দর্শন বুঝবেন। কথায় কথায় তার পথ আটকে দাঁড়াবেন না। আবার একই সাথে দেশের মানুষের কাছে তার ভাবমূর্তি হতে হবে সৎ ও উজ্জ্বল।
প্রণব মুখোপাধ্যায় যখন অর্থমন্ত্রী ছিলেন, তখন নানা বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের সাথে তার মতপার্থক্য হয়েছিল। এই মতপার্থক্য আর্থিক নীতি রূপায়ণে যে সমস্যা সৃষ্টি করে, সেটা বোঝেন নরেন্দ্র মোদীও। তাই গোড়ার দিকে তার তালিকায় অর্থমন্ত্রী হিসেবে উঠে এসেছিলেন প্রাক্তন দুই ব্যাংক কর্তা কে ভি কামাথ ও দীপক পারেখের নাম। কিন্তু ওই দু’টি নামের ব্যাপারেই আরএসএস তথা সঙ্ঘ পরিবারের আপত্তি রয়েছে। শিল্পমহল থেকে এই দু’টি নাম ভাসিয়ে দেওয়া হলেও মোদী বুঝতে পারছেন, মনমোহনের সাথে এই দু’জনেরই বিরাট পার্থক্য রয়েছে।
ফারাকটা হল, মনমোহন রাজনীতিতে না থাকলেও আমলা হিসেবে প্রশাসনের নানা পদে ছিলেন। তিনি রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার গভর্নর ছিলেন। যোজনা কমিশনে ছিলেন। সে দিক থেকে দেখতে গেলে মনমোহন সিং কিন্তু প্রশাসনের অন্দরমহলের লোক ছিলেন। বিদেশে আন্তর্জাতিক অর্থ ভাণ্ডার (আইএমএফ)-এও কাজ করেছেন তিনি। কিন্তু যারা শুধু ভারতের বেসরকারি ক্ষেত্রে কাজ করেছেন, তারা সরকারি প্রশাসনের অন্দরমহলে কতটা স্বাচ্ছন্দ্যে কাজ করতে পারবেন, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।
বহিরাগতকে যদি না আনা হয়, রাজনৈতিক ব্যক্তিকেই যদি অর্থমন্ত্রী করতে হয়, তা হলে অরুণ জেটলিই মোদীর জন্য শ্রেষ্ঠ বাছাই হতে পারেন বলে মনে করছেন অনেকে। তাদের ব্যাখ্যা, অমিত শাহ বা পীযুষ গোয়েল যতই মোদীর অনুগত হন না কেন, তাদের অর্থমন্ত্রী করা মোদীর পক্ষে সম্ভব নয়। সে দিক থেকে মন্ত্রিসভার বৃহৎ চতুষ্টয়-র একজন হতে গেলে জেটলিই কিন্তু মোদীর সেরা বাছাই। আরএসএসের একাংশ অর্থমন্ত্রী হিসেবে অরুণ শৌরিরও কথা বলেছে।
ভোট প্রচারের সময় শৌরির বাড়িতে গিয়ে মোদী বলেছিলেন, আপনার এই আধা সন্ন্যাস জীবন ত্যাগ করে এ বার সক্রিয় হতে হবে। কিন্তু মোদী এটাও জানেন, বিভিন্ন বিষয়ে অরুণ শৌরির মতামত খুব গোঁড়া। সে সব নিয়ে বাজপেয়ী আমলে যথেষ্ট সমস্যাও হয়েছিল। তা ছাড়া অরুণ জেটলির সাথে শৌরির বিবাদও সুবিদিত। তাছাড়া সুষমা স্বরাজ, রাজনাথ সিংহ, যশবন্ত সিন্হার চেয়ে অরুণ জেটলি মোদীর কাছে অনেক বেশি কাছের।
তবে অমৃতসর কেন্দ্র থেকে অরুণ যদি জিততে না পারেন, তা হলে কি তিনি রাজ্যসভার সদস্য হিসেবে অর্থমন্ত্রী হবেন? প্রণব মুখোপাধ্যায় হেরে যাওয়ার পরেও ইন্দিরা গান্ধী তাকে অর্থমন্ত্রী করেছিলেন। তখন তিনি রাজ্যসভার সদস্যও ছিলেন না। পরে গুজরাত থেকে প্রণববাবুকে রাজ্যসভার সাংসদ করেন ইন্দিরা। যেমন শিবরাজ পাটিল হেরে যাওয়ার পরে সনিয়া গান্ধী তাকে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী করেছিলেন। আবার যশোবন্ত সিংহ হেরে যাওয়ার পরেও তাকে অর্থমন্ত্রী করতে চেয়েছিলেন অটলবিহারী বাজপেয়ী। কিন্তু বাদ সেধেছিলেন আরএসএস প্রধান কে এস সুদর্শন। তিনি বলেছিলেন, হেরে যাওয়া ব্যক্তিকে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী করা যাবে না। যশোবন্ত সে দিন অর্থমন্ত্রী হতে পারেননি।
বিজেপির এক শীর্ষ নেতা অবশ্য বলেন, “নীতি অনেক সময়েই নির্ধারিত হয় সম্পর্কের উপরে। আরএসএস যশোবন্তকে অপছন্দ করত। মোহন ভাগবত কিন্তু অরুণ জেটলি প্রশ্নে আপত্তি করবেন না। তা ছাড়া অরুণের ভাবমূর্তিও উজ্জ্বল। শিল্পমহলও তাকে পছন্দ করে।” পি চিদম্বরমকে অর্থমন্ত্রী করার আগে প্রথম ছ’মাস অর্থ মন্ত্রক নিজের হাতে রাখতে চেয়েছিলেন মনমোহন। কিন্তু সনিয়া তাতে রাজি হননি। মোদী সে পথে এগোবেন কিনা, সেটাও অবশ্য স্পষ্ট নয়।
অন্য পদের মধ্যে লালকৃষ্ণ আদভানিকে স্পিকার করার বিষয়ে আলাপ-আলোচনা অনেকটাই এগিয়েছে। আরএসএস নেতাদের সাথে বিজেপি নেতাদের বৈঠক চলছে। সুষমা স্বরাজ, রাজনাথ সিংহ দু’জনেই গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী হচ্ছেন বলে বিজেপি সূত্র জানিয়েছে। সুষমাকে বিদেশমন্ত্রী করে রাজনাথকে প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের দায়িত্ব দেওয়া হলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের দায়িত্ব কে নেবেন, সেটাও একটা বড় প্রশ্ন। রাজনাথ নিজে অবশ্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক চাইছেন। শুধু তাই নয়, তিনি প্রণববাবুর মতো মন্ত্রিসভার ‘নাম্বার টু’ হতে চাইছেন। গুজরাতের মন্ত্রী সৌরভ পটেলকেও দিল্লিতে আনার কথা হচ্ছে। তাকে বাণিজ্য মন্ত্রীর পদ দেওয়া হতে পারে। মন্ত্রী হতে ইচ্ছুক নিতিন গডকড়ীও। রেল বা নগরোন্নয়ন মন্ত্রকের দায়িত্ব নিতে আগ্রহী তিনি।
কিন্তু প্রশ্ন উঠছে, আরএসএস তা হলে বিজেপি সভাপতি কাকে করবে? রাজনাথকে মন্ত্রী করে নিতিনকে দলের সভাপতি করার ইচ্ছা রয়েছে ভাগবতের। তাতে অবশ্য আপত্তি রয়েছে আডবাণীর। অন্য দিকে মানেকা গান্ধী স্বাস্থ্যমন্ত্রী হতে চান। পরিবেশ মন্ত্রীর দায়িত্ব নিতে ইতোমধ্যেই তিনি অনিচ্ছা প্রকাশ করেছেন। আবার পেশায় চিকিৎসক দিল্লির বিজেপি নেতা হর্ষবর্ধন চান স্বাস্থ্য মন্ত্রীর দায়িত্ব। রেল মন্ত্রকের দায়িত্ব নিতে আগ্রহী রামবিলাস পাসোয়ান। কিন্তু তার বিরুদ্ধে সিবিআই তদন্ত চলছে। তাই তার পুত্র চিরাগকে প্রতিমন্ত্রী করে রামবিলাসকে মন্ত্রিসভায় না-ও আনা হতে পারে।
দার্জিলিং থেকে জিতলে সুরিন্দর সিংহ অহলুওয়ালিয়া জায়গা পেতে পারেন মন্ত্রিসভায়। চন্দ্রবাবু নাইডু এনডিএ-তে ফিরলে তিনি শরদ যাদবের পরিবর্তে এনডিএ-র আহ্বায়ক হতে পারেন। আইনমন্ত্রী হতে পারেন রবিশঙ্কর প্রসাদ। নবীন প্রজন্মের প্রতিনিধি হিসেবে মন্ত্রিসভায় জায়গা পেতে পারেন স্মৃতি ইরানি ও অনুরাগ ঠাকুর। আর মুসলিম সমাজকে বার্তা দিতে গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীর পদ দেওয়া হতে পারে শাহনেওয়াজ হুসেন ও মোক্তার আব্বাস নকভিকেও। সূত্র : আনন্দবাজার পত্রিকা