কর্নেল জিয়ার বক্তব্য আদালত অবমাননার শামিল: হাইকোর্ট

কর্নেল জিয়ার বক্তব্য আদালত অবমাননার শামিল: হাইকোর্ট

jiya_k0গণমাধ্যমে দেয়া সাক্ষাৎকারে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‌্যাব) অতিরিক্ত মহাপরিচালক কর্নেল জিয়াউল আহসানের বক্তব্যকে আদালত অবমাননার শামিল হিসেবে চিহ্নিত করে উষ্মা প্রকাশ করেছেন হাইকোর্ট।

আদালত বলেছেন, শহীদ চেয়ারম্যানকে আসামি করার কথা বলে পরোক্ষভাবে তাকে হুমকি দেয়া হয়েছে। এমনটা হলে নিরপেক্ষ কোনো সাক্ষী পাওয়া যাবে না। এই শহীদ চেয়ারম্যানই সত্য উদঘাটন করেছেন। তাকেই হুমকি দেয়া হলো।

নারায়ণগঞ্জের প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলাম, আইনজীবী চন্দন সরকারসহ সাত খুনের ঘটনায় আদালতের নির্দেশ মোতাবেক বৃহস্পতিবার তদন্তের অগ্রগতি প্রতিবেদন দাখিল করার পর  অ্যাটর্নি জেনারেলকে উদ্দেশ করে এসব কথা বলেন আদালত।

আদালত আরো বলেন, সাক্ষীরা নির্বিঘ্নে যাতে সাক্ষ্য দিতে পারেন, সে পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে।

আদালত এ সময় নিহত নজরুল ইসলামের শ্বশুর শহীদ চেয়ারম্যানকে আসামি করার বিষয় নিয়ে র‌্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক জিয়াউল আহসানের মন্তব্যে উদ্বেগ প্রকাশ করেন।

বৃহস্পতিবার অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম সরকারি তদন্ত কমিটি, র‌্যাব, সিআইডি, পুলিশ মহাপরিদর্শকসহ সাত বিবাদীর পাঠানো অগ্রগতি প্রতিবেদন আদালতে তুলে ধরেন।

সম্প্রতি র‌্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক লে. কর্নেল জিয়াউল আহসান একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত সাক্ষাৎকারে বলেছেন, “সাত খুনের মামলার প্রধান আসামি নূর হোসেন এখন কলকাতায় অবস্থান করছেন। ঘটনার তিন দিন পর তিনি ভারতে পালিয়ে গেছেন। তাকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা হচ্ছে। তাকে গ্রেপ্তার করতে পারলেই সব রহস্য উন্মোচিত হবে। এ ছাড়া নজরুল ইসলামের শ্বশুর শহীদ চেয়ারম্যান এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত কি না, তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।”

ওই বেঞ্চের কনিষ্ঠ বিচারপতি গোবিন্দ চন্দ্র ঠাকুর সাক্ষাৎকারের অংশবিশেষ তুলে ধরে অ্যাটর্নি জেনারেলকে বলেন, “ঘটনা উন্মোচিত করার দায়িত্ব তার (জিয়া) নয়।”

বিচারপতি গোবিন্দ চন্দ্র  বলেন, “আমাদের সুস্পষ্ট আদেশ রয়েছে, এই হত্যাকাণ্ডের তদন্তের সঙ্গে র‌্যাব কোনোভাবেই সম্পৃক্ত হতে পারবে না। কিন্তু র‌্যাবের ওই কর্মকর্তা নজরুলের শ্বশুর ঘটনার সঙ্গে জড়িত কি না তা খতিয়ে দেখার কথা বলেছেন।” আদালত বলেন, এটা আদালত অবমাননার শামিল।

আদালত বলেন, শহীদ চেয়ারম্যানই প্রথমে সাহস করে সত্য বলেছেন। তার (জিয়া) এ বক্তব্যের মধ্য দিয়ে মামলার অন্যতম সাক্ষী শহীদ চেয়ারম্যানকে পরোক্ষভাবে হুমকি দেয়া হচ্ছে।  

এ পর্যায়ে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, “আপনি বিষয়টি সঠিকভাবেই চিহ্নিত করেছেন। তার (জিয়া) এ ধরনের বক্তব্য দেয়া ঠিক হয়নি।” আদালত অ্যাটর্নি জেনারেলকে উদ্দেশ করে বলেন, “আমরা এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় আদেশ দেব, নাকি আপনি বিষয়টি দেখবেন?”

জবাবে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, “আমিই পারব। এটা আমাকে বলা মানেই আদেশ দেয়া হলো।”

আদালত বলেন, “নজরুলের শ্বশুরকে আসামি করার হুমকি, তাহলে কি কেউ সাক্ষ্য দেবেন?” অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ডিবি-সিআইডি তদন্ত করছে।

আদালত বলেন, “র‌্যাব, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, সরকারের ভাবমূর্তির স্বার্থে সেখানে র্যা ব না থাকলে ক্ষতি কী? এ মুহূর্তে ওই এলাকায় র‌্যাবের প্রয়োজন আছে কি? কারণ, না থাকলে মানুষ একটু নির্ভয়ে সাক্ষ্য দেবে। ”

আদালত বলেন, “এ ব্যাপারে আমরা আদেশ দিতে পারি, তবে না দিলেই ভালো হয়।” আদালত অ্যাটর্নি জেনারেলকে উদ্দেশ করে বলেন, “আপনি বিষয়টি প্রশাসনকে জানাবেন।”

আদালত এ পর্যায়ে বলেন, “র‌্যাবের দু-একজন খারাপ হয়ে গেলে গোটা বাহিনী কি খারাপ হয়ে যাবে? বিচার বিভাগের দু-একজন বা সাংবাদিকদের দু-একজন খারাপ হলে পুরো পেশার সবাই কি খারাপ হয়ে যাবে? বিষয়টি তা নয়। এ জন্য আমরা আদেশ দেয়ার সময় শব্দচয়নে সচেতন ছিলাম।”

এরপর বরখাস্তকৃত তিন কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তারের বিষয়ে হাইকোর্টের অন্য একটি বেঞ্চের অন্তর্বর্তীকালীন আদেশ উপস্থাপন করেন অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী। উপস্থাপনের শুরুতেই কঠোরভাবে বিরোধিতা করে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, কেউ কেউ সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করতে উঠেপড়ে লেগেছে।

এ সময় আদালত বলেন, ওই বেঞ্চের আদেশেই আছে, আদেশটি এই বেঞ্চকে অবহিত করতে হবে। এ বিষয়ে রিটকারীদের প্রতি আদেশ রয়েছে। এ সময় আদালত আরও বলেন, “আপনাদের কিছু বলার থাকলে ওই বেঞ্চে যান। অথবা আপিল বিভাগে যান। ” এরপর সুব্রত চৌধুরী পুরো আদেশটি পাঠ করে শোনান। আদালত তা নথিভুক্ত করেন।

এসব কথোপকথনের আগে অ্যাটর্নি জেনারেল সাতটি প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন। সরকারি তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে এজাহারকারী, নিহতদের নিটকাত্মীয়সহ ২৫ জনের সাক্ষ্য নেয়া হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

এ ছাড়া ডিবি অফিসে সংরক্ষিত মামলার আলামত পরিদর্শন ও গণশুনানির আয়োজন করা হয়েছে। প্রতিবেদনে তারা তদন্ত সম্পন্ন করতে চার সপ্তাহ সময় চান। এ প্রসঙ্গে আদালত বলেন, “আমরা তাদের সময়সীমা বেঁধে দেয়নি। তার মানে তারা হয়তো চার সপ্তাহের মধ্যে পারবে। আমরা দুই সপ্তাহ সময় দিচ্ছি, অগ্রগতি প্রতিবেদন দেয়ার জন্য। সিআইডির প্রতিবেদনে কয়েকজন আসামিকে গ্রেপ্তার, আলামত জব্দ, উদ্ধারকৃত গাড়ির ফরেনসিক পরীক্ষা বিষয় তুলে ধরা হয়। বলা হয়, অভিযান চলছে। এ ছাড়া প্রতিবেদনে বলা হয়, ওই এলাকার আশপাশের লোকজন কিছুটা আতঙ্কগ্রস্ত রয়েছে। এ ছাড়া এই প্রতিবেদনে ঘটনার দিন আদালত চত্বরে নজরুল ইসলাম ও তার সহযোগী কর্তৃক একজন সাদা পোশাকধারী ব্যক্তিকে আটক ও একজন র‌্যাবের পোশাক পরিহিত ব্যক্তির পক্ষ থেকে ওই ব্যক্তিকে উদ্ধারের ঘটনা তুলে ধরা হয়েছে।

এ ছাড়া আইজি মহাপরিদর্শক ও র‌্যাব মহাপরিচালকের প্রতিবেদন সম্পর্কে আদালত বলেন, “ওই দুটি প্রতিবেদনের ধরন দেখুন। এখানে যা দেয়া হয়েছে, তা হলো নিজেদের মধ্যে কী হয়েছে তা একজন আরেকজনকে জানাচ্ছেন। কিন্তু আদালতকে বা অ্যাটর্নি জেনারেলকে  সম্বোধন করে কিছু বলেনি। এটা করলে কি তাদের সম্মান কমে যায়? এ থেকেই তাদের মানসিকতা বোঝা যায়। তাতে বুঝতে বাকি থাকে না যে তারা কতটুকু কাজ করবে।”

পরে আদালত আগামী ৪ জুন পরবর্তী অগ্রগতি প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দিয়ে শুনানি মুলতবি করেন।

বাংলাদেশ