একটা লড়াই শুরু হচ্ছে৷ সেখানে থাকার কথা প্রচার, প্রসার, জায়গা দখল আর শেষে বিজয়ীর মুকুট কে জিতবেন তার জল্পনা৷ আর কী অদ্ভূত সমাপতন! এই লড়াইতেও যাদের মুখ প্রচারে ব্যবহার করা হচ্ছে, তাদের জোরদার পেশাদারী জোটটা কলকাতার বাঙালি দর্শকের কাছে টাটকা স্মৃতি৷ কিন্তু এই মুহূর্তে তারা ব্যক্তিগত জীবনে বন্ধু হলেও, পেশার দাবিতে দুই প্রতিদ্বন্দ্বী ক্যাম্পের বাসিন্দা৷ এবং দু’জনেই হেভিওয়েট৷ অর্থাৎ মে মাসের শেষ শুক্রবারটা আবারও হতে পারে টালিগঞ্জের আরেকটা দ্বিমুখী লড়াইয়ের প্রত্যক্ষ সাক্ষী৷ দুই যোদ্ধার নাম জিৎ আর কোয়েল মল্লিক৷
গোড়াপত্তন
সাল ২০০৩৷ ছবি ‘নাটের গুরু’৷ নায়ক-নায়িকা জিৎ-কোয়েল৷ এরপর ‘বন্ধন’৷ ‘মানিক’৷ ‘যুদ্ধ’৷ ‘শুভদৃষ্টি’৷ ‘হিরো’৷ ‘ঘাতক’৷ ছবির সংখ্যা মোটে ছয়৷ কিন্তু আঁচ তাতেই গনগনে হয়৷ ‘উত্তম-সুচিত্রা’ আর ‘প্রসেনজিৎ -ঋতুপর্ণা’-র পর কোন জুটি তাদের প্রায় ছুঁয়ে ফেলল? এমন প্রশ্নের উত্তরে বাঙালি দর্শকের মুখে তখন একটাই নাম, ‘জিৎ -কোয়েল’!
ঠিক এমন সময় জিৎ ছবি করলেন স্বস্তিকা এবং অন্যান্য নায়িকার সঙ্গে জুটি বেঁধে৷ আর কোয়েলের বিপরীতে তখন প্রধানত দেব আর অন্যান্য নায়করা৷ দর্শক মনটা হুহু করে উঠল৷ তাদের ‘জিৎ -কোয়েল’ জুটির বিরহে৷ সে কথা বুঝে ফেলেছিলেন টালিউডের প্রযোজকরা৷ প্রথম চেষ্টা করলেন প্রযোজক পীযূষ সাহা৷ ‘নীল আকাশের চাঁদনি’ ছবি জিৎ -কোয়েল জুটির ক্যামব্যাক ছবি হবে ঠিক হলেঅ৷ ঠিক এরকম সময়েই ‘ভেঙ্কটেশ ফিল্মস’ প্রযোজিত ‘সাত পাকে বাঁধা’-তেও কাজ করতে শুরু করলেন জিৎ -কোয়েল৷ প্রথমে মুক্তি পেল ‘সাত পাকে বাঁধা’৷ দ্বিতীয় ইনিংসে এই ছবিতে আবার ছক্কা হাঁকালেন জুটি৷ এরপর ‘নীল আকাশের চাঁদনি’৷ ‘দুই পৃথিবী’ আর ‘১০০ পার্সেন্ট লাভ’৷ তারপর? সাল ২০১৪৷ ৩০ মে৷ (তারিখটা এখনো পর্যন্ত যা শোনা যাচ্ছে) বড়পর্দায় আসছেন জিৎ৷ আসছেন কোয়েল৷ কিন্তু একসঙ্গে নয়৷ আলাদা আলাদা৷ অর্থাৎ মুখোমুখি৷ ‘গেম’ ছবি নিয়ে আসছেন জিৎ৷ ছবির একটি পোস্টারে নায়ক৷ হাতে পিস্তল৷ তারই পাশাপাশি ‘অরুন্ধতী’ নিয়ে আসছেন কোয়েল৷ ছবির সব পোস্টারেই নায়িকা একা৷ হাতে তরবারি৷
‘বন্ধু’ নাকি ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’?
যখনই কলকাতায় দু’টো হাই ভোল্টেজ বাংলা ছবি মুক্তি পেয়েছে একই দিনে, তখনই এমন প্রশ্ন উঠেছে, ভাই-ভাই, নাকি লড়াই? এবং সে ক্ষেত্রে প্রযোজক-পরিচালক-অভিনেতা সকলেই বারংবার যা বলেছেন, তার মোদ্দা কথাটা হলো, কারও সঙ্গেই কারও প্রতিযোগিতা নেই৷ তাই দর্শক দু’টো ছবিই দেখুন৷
কিছুদিন আগেও ‘রিলায়েন্স এন্টারটেইনমেন্ট’-এর ‘জাতিস্মর’ আর ‘ভেঙ্কটেশ ফিল্মস’-এর ‘চাঁদের পাহাড়’ মুক্তির তারিখ একই হবে কিনা, তাই নিয়ে চর্চা শুরু হয়েছিল টালিউডে৷ তবে শেষ পর্যন্ত তাদের ছবি ‘জাতিস্মর’-এর মুক্তির তারিখ পিছিয়ে দেয় ‘রিলায়েন্স এন্টারটেইনমেন্ট’৷ তবে এবার আর সেটা হচ্ছে না৷ দু’ পক্ষেরই ছবি মুক্তি পাচ্ছে একই দিনে৷ তা হলে কে কোন হল পাবে তা নিয়ে কি শুরু হয়েছে লড়াই? কলকাতার ‘মিত্রা’ সিনেমা হলের মালিক দীপেন মিত্র বলছেন, ‘এরকম তো হয়েই থাকে৷ ১০ বছর আগেও দু’টো-তিনটে বড় ছবি একদিনে মুক্তি পেত৷ এবারও তাই হবে৷ আর কোয়েল এবং জিতের ছবির ধরন আলাদা৷ সে কারণে তেমন অসুবিধা হবে বলে মনে হচ্ছে না৷ হল পাওয়া নিয়েও সেরকম কোনো লড়াই নেই, কারণ পর্যাপ্ত হল পাবে দু’টো ছবিই৷’
কিন্তু কোন ছবি এগিয়ে গেল সে প্রশ্ন তো আসেই? শুনে দীপেনবাবু বলছেন, ‘সেই ছবিটাই বেশি ব্যবসা করবে, যে ছবি ভালো৷ অর্থাৎ দর্শকের বেশি পছন্দের হবে৷ কারণ দু’টো ছবিই ভালো সংখ্যক হল পাবে, সেটা আশা করছি৷’ ‘গেম’ ছবি নিবেদন করছেন ‘রিলায়েন্স এন্টারটেইনমেন্ট’৷ একই দিনে ছবি মুক্তি পেলে তো একটা প্রতিযোগিতা এসেই যায়? প্রশ্ন শুনে ‘রিলায়েন্স এন্টারটেইনমেন্ট’-এর প্রতিনিধি জয়ন্ত কুমার রায় বলছেন, ‘এখন যে সংখ্যক বাংলা ছবি হচ্ছে, সেক্ষেত্রে দু’টো ছবির রিলিজ ডেট এক হতেই পারে৷ ভোটের কারণেও কিছুটা, বড় বাণিজ্যিক বাংলা ছবি বহুদিন মুক্তি পায়নি৷ তাই দর্শকদের মধ্যে চাহিদা রয়েছে৷’
কী কথা মাথায় রেখে ঠিক হয়েছে ‘গেম’-এর এই মুক্তির তারিখ? জয়ন্ত বলছেন, ‘একই গল্প নিয়ে তৈরি হওয়া হিন্দি ছবি ‘হলিডে’ মুক্তি পাচ্ছে ৬ জুন৷ সে কারণেই আমরা ৩০ মে ‘গেম’ রিলিজ করার প্ল্যান করছি৷ ৪ জুন জামাইষষ্ঠী থাকায় ছুটির দিন রয়েছে৷ ট্যাডিশনালি ওই দিন বাঙালি জামাইরা শ্যালক-শ্যালিকাদের নিয়ে সেই কাননদেবীর আমল থেকে সিনেমা দেখতে যান৷ সুতরাং ২০১৪তেও সেই ট্র্যাডিশন বজায় থাকবে বলে আশা করা যায়৷ অনেকেই পরিবার নিয়ে সেদিন সিনেমাদেখতে যেতে পারেন৷’
অন্যদিকে ‘অরুন্ধতী’-র অন্যতম প্রযোজক নিশপাল সিং বলছেন, ‘প্রতিযোগিতা নিশ্চয়ই আছে৷ আমরা প্রস্ত্ততি পর্বেও কোনো ত্রুটি রাখছি না৷ আমাদের বড় ছবি, যেভাবে প্রোমোশনের পর রিলিজ করা হয়, ‘অরুন্ধতী’-র রিলিজ প্ল্যানও সেরকম৷’ মানে আপনারা ‘অরুন্ধতী’ নিয়ে আত্মবিশ্বাসী? শুনে নিশপাল বলছেন, ‘একদম৷ কারণ ‘অরুন্ধতী’-র বিষয় অন্যারকম৷ এতদিন কোয়েল ছবিতে নাচ করেছে, কমেডি করেছে৷ একই ধরনের জিনিস বহুবার করেছে৷ কিন্ত্ত এবার কোয়েল বাণিজ্যিক ছবির পরিচিত ইমেজের বাইরে বেরিয়ে আলাদা রকম কিছু করল এই ছবিতে৷’
পশ্চিমবঙ্গের বাংলা ছবির বাজারে মুম্বাইয়ের মতো ট্রেড অ্যানালিস্ট ব্যাপারটা জলভাত নয়৷ অবশ্য বাজার বাড়ছে যখন, তখন তার বিশেষজ্ঞরাও হিসাব রাখা শুরু করেছেন৷ তেমনই একজন ট্রেড অ্যানালিস্ট পঙ্কজ লাডিয়া কী বলছেন এ প্রসঙ্গে? বলছেন, ‘দু’টো ছবিই দক্ষিণী ছবির রিমেক৷ তবে গল্পের ধরন আলাদা৷ তাই কোনো প্রতিযোগিতা নেই৷’ তবে কোন ছবির জনপ্রিয়তা বেশি এই পর্যায়ে? পঙ্কজ বলছেন, ‘রুরাল সেন্টারে ‘গেম’ ছবির চাহিদা কিছুটা বেশি হতে পারে৷ চাহিদা অনুসারেই আমরা ডিস্ট্রিবিউট করব ছবি৷ ইনিশিয়াল অর্থাৎ প্রাথমিক পর্বের ব্যবসা ‘গেম’-এর বেশি হতে পারে৷ কিন্ত্ত ‘অরুন্ধতী’ থেকেও প্রত্যাশা অনেক৷’
আর নায়ক-নায়িকা?
দু’ জনের জন্যই এই ছবি খুব গুরুত্বপূর্ণ৷ কেন? জিৎ , শুভশ্রীর সঙ্গে জুটি বেঁধে করেছিলেন ‘বস’৷ সেই ছবির পরিচালকও ছিলেন বাবা যাদব৷ সেই ছবি সুপারহিট হওয়ার পর এই জুটির কাছ থেকে দর্শকদের প্রত্যাশা তুঙ্গে৷ জিতের শেষ মুক্তি ‘রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার’ অন্য ধরনের ছবি ছিল৷ সেখানে জিতের ফ্যানেরা পরিচিত ঢঙে তাদের নায়ককে পাননি৷ সে কারণেই তাদের আবার পছন্দের নায়ককে চেনা-অবতারে দেখার একটা প্রত্যাশা রয়েছে৷ আর সেই চাহিদা সম্পর্কে নায়ক নিজেও যে অবগত তা আশা করাই যায়৷ ব্যবসায়িক দিকে থেকেও জিতের কাছে এই ছবি গুরুত্বপূর্ণ৷ কারণ ছবির প্রযোজক তার নিজের সংস্থা৷ তবে নায়কের সঙ্গে, এসব ঘটনার অনেক আগে, যখন ‘গেম’ ছবির শ্যুটিং সবে শুরু হব-হব করছে, সে সময়ে কথা বলেই বোঝা গিয়েছিল, ছবি নিয়ে তিনি আত্মবিশ্বাসী৷
তারই ছবির সঙ্গে মুক্তি পাচ্ছে কোয়েলের ‘অরুন্ধতী’৷ সেক্ষেত্রে কোয়েলকে কি তিনি বেস্ট অফ লাক বলবেন? অবশ্যই৷ কারণ টলিউডের সব ছবিকেই টুইট্যারে বেস্ট অফ লাক জানান জিৎ৷ যেসব ছবির পোস্টার তার চোখে পড়ে৷ ‘অরুন্ধতী’-র পোস্টার তার চোখে পড়েনি, এমন কি সম্ভব নাকি? আর জিতের বরাবরের বন্ধু কোয়েল হঠাত্ ঘাড়ে এসে পড়া এই ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’-র তকমাটা কোন চোখে দেখছেন?
কোয়েল বলছেন, ‘আমি তো জিত্কে বেস্ট অফ লাক বলেছি৷ ট্রেলর, গান যখনই দেখেছি, মনে হয়েছে, খুব ভালো হবে জিতের ছবি৷ আমার তরফ থেকে জিৎ আর শুভশ্রী দু’জনকেই বেস্ট অফ লাক৷’ নায়কের মতোই নায়িকার কেরিয়ারেও এই ছবি খুব গুরুত্বপূর্ণ৷ কারণ? ‘এটা লাইফটাইম চরিত্র৷ বাংলা ছবিতে এমন চরিত্র খুব কম তৈরি হয়েছে৷ অন্য ছবিতে গ্ল্যামার থাকে৷ এই ছবিতে কিন্তু পরতে পরতে নারীশক্তির প্রকাশ৷ সে কারণেই এই ছবি খুব স্পেশ্যাল’ বলছেন নায়িকা স্বয়ং৷
কোয়েল এই ছবিতে তরবারি হাতে৷ যুদ্ধে প্রস্ত্তত৷ তেমনভাবেও তো কোয়েলকে আগে দেখেনি তার ফ্যানেরা৷ পোস্টারে এই নতুন লুকে দেখে ফ্যানেদের মনে তৈরি হয়েছে প্রত্যাশা৷ ব্যবসায়িক দিক থেকেও কোয়েলের কাছে এই ছবি গুরুত্বপূর্ণ৷ কারণ কোয়েলের বরই এই ছবির অন্যতম প্রযোজক৷ আর মজার ব্যাপার হল, জিতের মতোই একই আত্মবিশ্বাস চলকে পড়ছে কোয়েলের গলাতেও৷ তবে একটা প্রশ্ন যে থেকেই যায়৷ জিত্ -কোয়েল এতদিন যে জুটি বেঁধে এসেছেন, তারা এবার তো মুখোমুখি৷ তা হলে? কোয়েল হেসে বলছেন, ‘দু’টো ছবির বিষয় তো একেবারেই আলাদা৷ তাই ফ্যানেদের জন্য ভ্যারাইটি রয়েছে৷ ওরা খুশি হবে যে জিত্ আর কোয়েল দু’ জনকেই দেখতে পাবে আবার৷ একসঙ্গে না হলেও৷’
একনজরে
জিৎ
ছবির ধরন: পারিবারিক বিনোদন, দক্ষিণী ছবির রিমেক
জিতের সঙ্গে আছেন: শুভশ্রী
ছবির পরিচালক: বাবা যাদব
নৃত্য পরিচালনা: বাবা যাদব
গান: জিৎ গঙ্গোপাধ্যায়
প্রযোজক: জিৎ নিজে
কেরিয়ারের বয়স: ১২ বছর
শেষ মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি: রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার
কোয়েল
ছবির ধরন: পুনর্জন্মের গল্প, দক্ষিণী ছবির রিমেক
কোয়েলের সঙ্গে আছেন: ইন্দ্রনীল সেনগুপ্ত
ছবির পরিচালক: সুজিত মণ্ডল
নৃত্য পরিচালনা: বাবা যাদব
গান: জিৎ গঙ্গোপাধ্যায় আর সালুরি কোটেস্বারা রাও (কোটি)
প্রযোজক: অন্যতম প্রযোজক স্বামী নিশপাল সিং
কেরিয়ারের বয়স: ১১ বছর
শেষ মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি: রংবাজ