ডাঃ মোঃ বজলুল করিম চৌধুরী
সহযোগী অধ্যাপক, ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ
/দীর্ঘ বিরতির পর সেদিন রহমান সাহেবের সাথে দেখা, অবসর গ্রহণের পর দীর্ঘ দিন এমুখো হননি। কুশল বিনিময়ের পর শারীরিক অবস্থা জানতে চাইলে হতাশ হয়ে বললেন, নারে ভাই শরীরটা ভালো না। বেশ ক’দিন হলো খুব কাশি হয়েছে। কাশির চোটে গা-বুক ব্যথা হয়ে গেছে। সহ্য করতে না পেরে কাশির ঔষধ খাচ্ছি। তাতে কাশি কিছুটা দমন হলেও দেখা দিয়েছে অন্য উপসর্গ……..
সেটা কি? কৌতুহল নিয়ে আমি জিজ্ঞাসা করলাম।
না, মানে কাশি এখন কিছুটা কম কিন্তু বুক ভার হয়ে গেছে। জ্বর জ্বর ভাবটা বেড়েছে। এখন সব সময়ই জ্বর থাকে। খেতে পরছি না, কি যে হলো। আমার বোধ হয় সময় শেষ হয়ে এসেছে।
আপনার কাশিটা কি রকম ছিল, শুকনা নাকি সাথে কফ উঠছিল?
না, শুকনা কাশি নয়। সাথে ভালোই কফ উঠছিল।
তা চিকিৎসাটা কার কাছ থেকে নিয়েছেন? একটু খোঁচা দিয়ে আমি জানতে চাইলাম।
না, নিজেই দোকান থেকে কফ সিরাপ কিনে খাচ্ছি ৫ দিন হলো, কিন্তু কিছুই হচ্ছে না, উন্নতিতো নয়ই..। বেশ গর্বের সাথে রহমান সাহেব নিজেই চিকিৎসার বিষয়টি জাহির করতে চাইলেন।
এখানেই তো সমস্যা দাদা। আপনি কাশি বন্ধ করার জন্য ঔষধ খাচ্ছেন, আর সে জন্যই তো এখন আপনার এ দশা। আসলে কি ভাই কাশি কিন্তু অভিশাপ নয়, এটা হচ্ছে আমাদের শ্বাস যন্ত্রের রোগ মুক্তির জন্য একটি নিয়ামক।
কি! আমি কাশির যন্ত্রণায় মরি আর আপনি বলছেন আশির্বাদ! রহমান সাহেবের চোখে-মুখে বিষ্ময়।
জ্বি, ঠিক তাই। কাশিকে বিতাড়নের জন্য অনেক কিছু করা হলেও এ ব্যবস্থাগুলো আমাদের ভ্রান্ত ধারণার প্রতিফলন এবং এই সুযোগে ঔষধ কোম্পানীগুলো কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। আর ব্যাপক জনগোষ্ঠি কাশির ঔষধ সেবন করে ক্রমশঃ রোগগুলোকে জটিল করে জীবনী শক্তি হারাচ্ছে।
কি যে বলেন মাথা-মুন্ডু কিছুই বুঝতে পারছি না, একটু খোলে বলুন তো। রহমান সাহেব অনেকটা বিনয়ের সাথে জানতে চাইলেন।
তা হলে শুনুন। আমি বলতে শুরু করলাম….
/কাশি আসলে কোনো রোগ নয়। আমাদের নিচের শ্বাসযন্ত্র lower respiratory tract) যার শুরু স্বরযন্ত্র (larynx) থেকে ফুসফুসের ঝিল্লি (alveoli) পর্যন্ত, তার যে কোনো জায়গা উদ্দীপিত হলে (irritate) সে অবস্থা থেকে নিষ্কৃতি পাবার জন্য শরীরের স্বাভাবিক সুরক্ষা ব্যবস্থা (protective machenism)সক্রিয় হয়ে কাশির মাধ্যমে তা উপশম করে থাকে। যেমন ধরা যাক আমাদের নিম্ন শ্বাসযন্ত্র যে কোনো ধরনের জীবাণু যেমন ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস, ফাংগাস কিংবা প্যারাসাইট দিয়ে আক্রান্ত হলো; অথবা ধরুন যে কোনো ধরনের বাহিরের বস্তু (foreign body),ধুলা, বালি, ধোঁয়া কিংবা খাদ্যকণা (food particle), কোনো উদ্দীপক তরল অথবা গ্যাসীয় পদার্থ শ্বাস নালীর ভেতরে ঢুকে গেল, এমতাবস্থায় এই ধ্বংশাত্নক জীবাণু বা পদার্থগুলো তাৎক্ষণিক শ্বাসযন্ত্রের ক্ষতি করা ছাড়াও জীবাণুগুলো সেখানে আবাস গড়ে তোলে সংখ্যায় বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং সেখানে ক্ষত, ঘা (infection) কিংবা abscess সৃষ্টি করে, যা এমন কি আমাদের মৃত্যুরও কারণ হতে পারে। কিন্তু সৃষ্টিকর্তাকে অসংখ্য ধন্যবাদ, এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের জন্য তিনি আমাদের কাশি নামক একটি নিয়ামক প্রতিরোধ ব্যবস্থা দান করছেন। যখনি আমাদের শ্বাসযন্ত্রে সেই উদ্দীপক পদার্থগুলো ঢুকে পড়ে তখনি আমরা কাশি অনুভব করি এবং তার মাধ্যমে তাৎক্ষণিক সেই বস্তুগুলো আমাদের শ্বাসযন্ত্র থেকে বের হয়ে আসে এবং আমরা সম্ভাব্য মহাবিপদ থেকে পরিত্রাণ পেয়ে যাই।
একান্তই যদি আমাদের এই প্রতিরোধ ব্যবস্থা ভেদ করে কোনো বহিঃ শত্রু শ্বাসযন্ত্রে অবস্থান করতে থাকে তখনই দীর্ঘ মেয়াদি কাশির অবতারণা হয়। এক্ষেত্রে বহিঃ শক্র সেখানে অবস্থানের জন্য যুদ্ধ লিপ্ত হয় এবং আমাদের কাশি নামক প্রতিরোধ ব্যবস্থা তাকে নির্মূল করার জন্য সার্বক্ষণিক তার কাজ চালিয়ে যায়। যদি জীবাণু ঘটিত সংক্রমণ হয় তাহলে শরীরের প্রতিরোধ ব্যবস্থা (immune system)এবং জীবাণুর মধ্যে সংগঠিত যুদ্ধাবস্থায় সেখানে নান ধরনের রাসায়নিক মেডিয়েটর, পূঁজ-পানি ইত্যাদি জমা হয় এবং কাশির সাথে সেগুলো বেড়িয়ে আসে। যদি রোগ জীবাণুগুলো আরো সঙ্গবদ্ধ হয়ে তাদের অবস্থান সুদৃঢ় করে তাহলে সেখানে তারা পূঁজ জাতীয় পদার্থ সৃষ্টি করে এবং সেই অবস্থায়ই তারা সংখ্যায় অতিদ্রুত বৃদ্ধি পেতে থাকে, যা কাশির মাধ্যমে হলুদ কালো কিংবা ঘন পাতলা কফ হিসেবে বের হয়ে আসে। সুতরাং সহজেই বুঝতে পারছেন কাশির সাথে যে কফ বের হয়ে আসে তা আর কিছুই নয়, শ্বাসযন্ত্রে নিঃসৃত পূঁজ জাতীয় তরল এবং অজস্র জীবাণুর সংমিশ্রণ মাত্র, যা কাশির সাহায্যে বের হয়ে এসে আমাদের শ্বাসযন্ত্রকে পরিষ্কার করে রোগ জীবাণু মুক্ত করে। সেজন্যইতো দীর্ঘদিন আমাদের দেহে জীবাণু অবস্থান করলেও তা সহসা ভয়ঙ্কর হয়ে উঠে না, আর তাই সেক্ষেত্রে কফ বের হয়ে এলে আমরা সাচ্ছন্দ অনুভব করি। যদি কখনো সেই জীবাণুসমূহ বের না হয় এবং শ্বাসযন্ত্রের কোনো অংশে বসত গড়ে তবে অল্প সময়ের মধ্যেই জীবাণু এবং পূঁজ জমা হতে হতে শ্বাসযন্ত্রে abscess সৃষ্টি হতে পারে যার পরিণাম হয়তো মৃত্যু। এছাড়াও শ্বাসযন্ত্রের স্বাভাবিক অবস্থা ব্যাহত হবার কারণে শ্বাসকষ্ট হয় এবং শরীরের নানা ধরনের জটিলতা তো রয়েছেই।
আমার এই দীর্ঘ বক্তৃতা রহমান সাহেব খুব আগ্রহ নিয়ে নিঃশব্দে শুনে যাচ্ছেন তাই আবার বলতে শুরু করলাম। এবার আসুন দেখা যাক এই কাশির ব্যবস্থা আমাদের দেহে কিভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়।
যখনই কোনো উদ্দীপক পদার্থ আমাদের শ্বাসযন্ত্রে ঢুকে পড়ে তখনই সেখানকার সংবেদনশীল স্নায়ুতন্ত্র উদ্বেলিত হয় ও সেখানকার অনুভূতিগুলোকে অনুভূতি প্রেরণকারী স্নায়ু (afferent nerve) মাধ্যমে মস্তিষ্কের hypothalamus-এ অবস্থিত cough center-এ পাঠায়। সেই cough center তখন তার কার্য ঠিক করে এবং মুহূর্তে নানা ধরনের জটিল প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে কার্য সম্পাদনকারী স্নায়ু (efferent nerve)এর মাধ্যমে প্রয়োজনীয় নির্দেশাবলী কাশি উদ্দীপনাকারী পেশীসমূহে পাঠায় এবং সেই বিভিন্ন মাংস পেশীর সম্মিলিত কাজ হলো ’কাশি’ যার মাধ্যমে শ্বাসযন্ত্র থেকে উদ্দীপক পদার্থসমূহ বের হয়ে আসে। তাহলে বুঝতেই পারছেন কত অল্প সময়ে, কত জটিলতা শেষে এই কাশি প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হয়।
/এবার দেখা যাক কাশি প্রতিরোধি প্রচলিত ঔষধগুলো কিভাবে কাজ করে। কাশি নিরোধক ঔষধগুলো সেবনের পর অন্ত্র থেকে শোষিত হয়ে (absorbe) তা আমাদের রক্তে মিশে এবং রক্ত সরবরাহের মাধ্যমে সেই ঔষধি উপাদানসমূহ ব্রেইনের hypothalamus-এ গিয়ে নির্ধারিত কফ সেন্টারের কার্যকারিতা কমিয়ে দেয় কিংবা কখনো কখনো নিষ্ক্রিয় করে দেয়। এমতাবস্থায় শ্বাসযন্ত্র থেকে যতই বার্তা (signal)পাঠানো হোক না কেন কফ সেন্টার নিষ্ক্রিয় থাকায় মস্তিষ্ক আর তাতে সাড়া দিতে পারে না, কোনো ধরনের কাশি উদ্দীপক নির্দেশনাও পাঠাতে পারে না। তাই কাশি অনুভূত না হওয়ায় সেই উদ্দীপক পদার্থগুলো শ্বাসযন্ত্রে জমা হয়ে তাদের ধবংসলীলা চালাতে থাকে এবং স্বল্প সময়ে আমাদের রোগটি তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকে। আপনার বেলাও সেটিই হয়েছে। কাশি নিরোধক ঔষধ সেবনে আপনার কফ সেন্টার নিষ্ক্রিয় থাকায় আপনার কাশির মাত্রা হয়তো কিছুটা কমেছে, কিন্তু শ্বাসযন্ত্রে জীবাণু-পূঁজসহ নানা ধরনের inflammatory complex জমা হওয়ায় আপনি আরও বেশি অসুস্থতা অনুভব করছেন।
াব্বা! এতো! তাহলেতো কাশির সিরাপ খেয়ে আমি মারাত্বক ভুল করেছি! রহমান সাহেবের বিস্ময়।
অবশ্যই। এখন থেকে আপনি আর কাশি নিরোধক সিরাপ না খেয়ে কাশি উদ্রেককারী রোগটির চিকিৎসা করান। কাশি এমনিতেই ভালো হয়ে যাবে।
আমাকে দেন না একটি পরামর্শ! কি করতে পারি?
সে জন্য দরকার প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা। তার পরই প্রকৃত করণীয় নির্ণয় করে চিকিৎসা দেয়া যাবে। মনে হচ্ছে আপনার অবস্থা এখনো মারাত্মক আকার ধারণ করেনি। আশা করি, specific চিকিৎসায় আপনি অচিরেই ভালো হয়ে যাবেন।
তাহলে বাজারে প্রচলিত কোনো কাশির ঔষধই কি কার্যকর নয়? প্রশাসনিকভাবেই কেন সেগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না?
তা হয়তো নয়, কিছু কিছু কাশি আছে বিশেষ করে allergic কফগুলো যেখানে হয়তো শ্বাসনালী irritate হয় ঠিকই, কিন্তু কোনো জীবাণু না থাকায় এবং তরল কোনো mediator নিঃসৃত না হওয়ায় শুধু যন্ত্রণারই উদ্রেক করে। বের হওয়ার মতো কিছু থাকে না বিধায় সেসব ক্ষেত্রে এই কফ সিরাপগুলো কোনো ক্ষতিকর প্রভাব না ফেলে কাশি থেকে নিষ্কৃতি দিতে পারে। তবে তার ব্যাপ্তি অনেক কম এবং দক্ষতার সাথে সে অবস্থা নির্ধারণ করা না গেলে ক্ষতির সম্ভাবনাই বেশি।
তাহলে তো কোন অবস্থায়ই দক্ষজনের পরামর্শ ছাড়া কফ সিরাপ খাওয়া ঠিক নয়।
অবশ্যই, আর সে কারণেই কফ সিরাপগুলো কঠিনভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। শুধু তাই নয়, এই সুযোগে এক শ্রেণির লোক এই কাশির সিরাপগুলোকে নেশা হিসেবে সেবন করে থাকে। এর ফলে এই কফ সিরাপগুলো ঔষধ প্রতিষ্ঠানসমূহের আরও একটি বড় ব্যবসায়িক উপাদানে পরিণত হয়েছে