বাংলাদেশের অনুমতি ছাড়া টিপাইমুখে বাঁধ নয়

বাংলাদেশের অনুমতি ছাড়া টিপাইমুখে বাঁধ নয়

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের আন্তরিকতায় তিস্তা নদীর পানিবণ্টন চুক্তির সব কিছু চূড়ান্ত ছিল। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আপত্তির কারণে শেষ পর্যন্ত এ চুক্তি স্বাক্ষর হয়নি-যা খুবই দুঃখজনক। তবে তার সরকার প্রতিবেশী এ দেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখেই পানির ন্যায্য হিস্যা আদায়ে কাজ করছে। আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে এ সমস্যা সমাধান হবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন। এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় আসার পর গঙ্গার পানি চুক্তি সম্পাদন করে বাংলাদেশের ন্যায্য হিস্যা আদায়ের কথা উল্লেখ করেন।

গতকাল রবিবার পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় পরিদর্শনে গিয়ে মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে প্রধানমন্ত্রী এ কথা বলেন। নতুন সরকার গঠনের পর বিভিন্ন মন্ত্রণালয় পরিদর্শনের ধারাবাহিকতায় প্রধানমন্ত্রী রবিবার পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে অফিস করেন। প্রসঙ্গত, ২০১১ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংয়ের বাংলাদেশ সফরের সময়েই তিস্তা চুক্তিটি হওয়ার কথা থাকলেও তা হয়নি। এরপর এই চুক্তির ব্যাপারে নানা সময়ে ইতিবাচক মন্তব্য করে আসলেও গতকালই সরাসরি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে দায়ী করে বক্তব্য দিলেন প্রধানমন্ত্রী।

প্রকৃতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নদী শাসন এবং বন্যা নিয়ন্ত্রণে পদক্ষেপ নেয়ার জন্য সংশ্লিষ্টদের প্রতি নির্দেশ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, নদীর স্বাভাবিক গতি-প্রবাহ অক্ষুণ্ন, নাব্যতার উন্নয়ন এবং বাঁধ ও স্লুইস গেট নির্মাণে আরো সতর্ক হতে হবে। আমাদের বন্যা নিয়ন্ত্রণ, নদী শাসন, খাদ্য উত্পাদনের জন্য সেচ এবং মাছের চাষ করা প্রয়োজন। তবে কোন অবস্থাতেই নদীর স্বাভাবিক গতি-প্রবাহকে ব্যাহত করা যাবে না। সারাদেশে বিদ্যমান স্লুুইস গেটগুলোর প্রয়োজনীয়তার ওপর সমীক্ষা পরিচালনার এবং বর্তমান সরকারের নদী ড্রেজিং ও নদী শাসন প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের নির্দেশ দেন তিনি। বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ উদ্যোগে গঙ্গা ব্যারেজ করার ওপর গুরুত্বারোপ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, যৌথ উদ্যোগে এ ব্যবস্থা নিতে হবে। কারণ এটা তো ওপর থেকে আসবে। সেজন্য সংশ্লিষ্ট দেশগুলোকে সম্পৃক্ত রাখতে হবে। যাতে ব্যারেজ বানানোর পর কোন খেলা না হয়। অবশ্য এতে উভয় দেশই লাভবান হবে। তিনি বলেন, তার সরকার গঙ্গা ব্যারেজ নির্মাণের লক্ষ্যে একটি সমীক্ষা সম্পন্ন করেছে। গঙ্গা ব্যারেজ নির্মিত হলে সংশ্লিষ্ট এলাকার নদীগুলোতে ২ হাজার ৯ শ’ মিলিয়ন ঘনমিটার পানি ধারণযোগ্য একটি বিশাল জলাধার সৃষ্টি হবে। টিপাইমুখ বাঁধ প্রকল্পের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশের অনুমতি ছাড়া টিপাইমুখে ভারত কোন প্রকল্প নিতে পারবে না। এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়ার আগে বাংলাদেশের সঙ্গে আলোচনা করবে ভারত।

শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশ, ভারত ও ভুটান এবং বাংলাদেশ, ভারত ও নেপালের মধ্যে দুটি জলবিদ্যুত্ কেন্দ্র নির্মাণের বিষয়ে আলোচনা চলছে। আমরা বিনিয়োগ করবো। আমাদেরও শেয়ার থাকবে। তিনি বলেন, মিয়ানমার থেকে তিনটি নদী এসেছে। সেখানেও যৌথ উদ্যোগে জলবিদ্যুত্ উত্পাদন করা যায় কিনা সে বিষয়ে আলোচনা হচ্ছে। নদী রক্ষার ওপর গুরুত্বারোপ করে শেখ হাসিনা বলেন, আমাদের নদীগুলো আমাদের শিরা-উপশিরা। এগুলো আমাদের বাঁচিয়ে রেখেছে। তাই এগুলো রক্ষা করা অপরিহার্য। তিনি বলেন, নদীগুলো যে সাগরে যাচ্ছে এই যাওয়ার পথ হচ্ছে বাংলাদেশ। এই নদীগুলো হিমালয়ে উত্পত্তি হয়ে ভারতের মধ্য দিয়ে আসছে। নদী ও খালে স্লুুইসগেট নির্মাণের কনসেপ্ট বাদ দেয়ার পরামর্শ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, নদী ও খালে স্লুইসগেট তৈরির ফলে নদী ও খালগুলো মরে যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা ভাটি অঞ্চলের। এখানে সম্ভাবনা এবং অসুবিধা দুটোই আছে।

আবার উজানে বাঁধ দিলে আমাদের অনেক সমস্যা তৈরি হয়। তিনি বলেন, বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে চার শতাধিক নদী প্রবাহিত হচ্ছে। এরমধ্যে ৫৭টি হচ্ছে আন্তঃসীমান্ত নদী, যার ৫৪টি ভারত এবং ৩টি মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। এসব নদ-নদীর অধিকাংশই গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা নদীর অববাহিকাভুক্ত। তিনি বলেন, ১৯৭২ সালে ভারত-বাংলাদেশ যৌথ নদী কমিশন গঠন করা হয়। ১৯৯৬ সালের ১২ ডিসেম্বর বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ৩০ বছর মেয়াদি ঐতিহাসিক গঙ্গা নদীর পানি বণ্টন চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে নদীগুলোর পানি বণ্টনের বিষয়টি দ্বিপক্ষীয়। তবে অনেকে এটা নিয়ে আন্তর্জাতিকভাবে নালিশও করেছে। তিনি বলেন, পাড়া-প্রতিবেশীদের সঙ্গে সদ্ভাব রাখা যেমন প্রয়োজন, তেমনি প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে সুসম্পর্ক রেখে আমরা সিদ্ধান্ত নিতে পারি। তিনি বলেন, দেশের প্রধান ৩০টি নদীর উপর সমীক্ষার কাজ শেষ হলে ক্যাপিটাল ড্রেজিং কার্যক্রম শুরু করা হবে। এ লক্ষ্যে ১১টি ড্রেজার ক্রয় করা হয়েছে।

ফসল উত্পাদন এবং পরিবেশ রক্ষায় দেশের নদ-নদীর গুরুত্ব তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী নিয়মিত নদী খননের তাগিদ দেন। এছাড়া বন্যার সাথে মানানসই বসতি পরিকল্পনা গড়ে তোলার নির্দেশ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য বাঁধ দিয়ে সব নদী নিয়ন্ত্রণ করলে কিন্তু আমাদের কৃষি জমি উর্বরতা হারাবে এবং ক্ষয় হয়ে যাবে। এ জন্য আমাদের পরিকল্পনা এমনভাবে হবে যেন বন্যায় মানুষের কোন ক্ষয়-ক্ষতি না হয়। শেখ হাসিনা বলেন, ঢাকার দুঃখ এখন বুড়িগঙ্গা। একদিকে বর্জ্য আর অন্যদিকে তেল পড়া। এ দুটির কারণেই কিন্তু এ নদী সবচেয়ে বেশি দূষিত হচ্ছে। বুড়িগঙ্গাকে আমাদের যেকোন মূল্যে রক্ষা করতে হবে। এ ব্যাপারে সম্প্রতি কিছু নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। ১৩৮টি পয়েন্ট থেকে এখানে বর্জ্য নামে, এগুলোর জন্য একটা বিকল্প ব্যবস্থা আমাদের করতে হবে। আমি পরিদর্শন করার পর আমার ধারণাটা দিতে চাচ্ছি। সকল বর্জ্যকে একটা পয়েন্টে নিয়ে এসে কিভাবে এটার সমাধান করা যায় সেটা দেখতে হবে। তিনি বলেন, শিল্প মালিকদের দোষ দিয়ে লাভ নেই। এটির সমাধান আমাদের নিজেদেরই করতে হবে।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের রেল ও নদী পথ কম খরচের ও সহজলভ্য। অথচ এ দুটোই সবচেয়ে বেশি অবহেলিত। তিনি বলেন, আমরা সড়ক রক্ষা করতে গিয়ে নদীতে বাঁধ দিয়ে কিংবা নদীর গতি পথ পরিবর্তন করে প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট করে ফেলেছি। আবারো সারা দেশের নৌপথ চালুর কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, অনেক জায়গায় সড়কের ফুট ব্রিজ আছে। যেগুলোর কারণে নৌকা চলাচল করতে পারে না। নৌকা চলাচলের উপযোগী করতে ব্রিজগুলোর একটা প্যাসেজ ভেঙ্গে উঁচু করতে হবে। এ লক্ষ্যে ড্রেজিং করে নদীর নাব্যতা ফিরিয়ে আনতে হবে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ধান চাষকে দেশের দক্ষিণাঞ্চলে নিতে চাই। আর উত্তরাঞ্চলে ভুট্টা, গম, ডাল, তৈল বীজসহ অন্যান্য রবি শস্য চাষ হবে। তিনি বলেন, ধান চাষে বেশি পানি লাগে। উত্তরাঞ্চলে বোরো ধান চাষ করতে মাটির নিচের পানি ব্যবহার করতে হয়। ফলে এখানকার পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে। বাংলাদেশ যেহেতু ভূমিকম্প প্রবণ এলাকা তাই পানির স্তর অস্বাভাবিকভাবে নিচে নেমে গেলে ভূমিকম্প ঝুঁকি বাড়বে। দক্ষিণাঞ্চলে ধান চাষ হলে সারফেস ওয়াটার ব্যবহার করা যাবে। তিনি বলেন, ধান চাষকে দক্ষিণাঞ্চলে নিতে লবণাক্ত সহিষ্ণু জাত উদ্বাবনের চেষ্টা করা হচ্ছে। নদীর নাব্যতা বাড়িয়ে বৃষ্টির পানি ধরে রাখার মাধ্যমে লবণাক্ততা কমানোর পরিকল্পনার কথা জানান তিনি।

মতবিনিময় সভায় পানিসম্পদ মন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা ড. মশিউর রহমান, পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব আবদুস সোবহান শিকদার, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব আবুল কালাম আজাদ, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব জাফর আহমেদ খানসহ মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

অন্যান্য অর্থ বাণিজ্য জেলা সংবাদ বাংলাদেশ রাজনীতি শীর্ষ খবর