অপহরণের ভিডিওচিত্র পুলিশের হাতে

অপহরণের ভিডিওচিত্র পুলিশের হাতে

nazrul_lash1নারায়ণগঞ্জের প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলামসহ চাঞ্চল্যকর অপহরণের ভিডিওচিত্র এখন পুলিশের হাতে। নিহত আইনজীবী চন্দন সরকারের মোবাইল ফোনের মধ্যে এই ভিডিওচিত্র পাওয়া গেছে। পুলিশের তদন্ত সূত্র এ খবর জানিয়েছে। সূত্র বলছে, এ ভিডিওচিত্র কিছুটা অস্পষ্ট। তবে এটি পাওয়ার পর আসামি শনাক্ত করতে আর কোনো বেগ পেতে হবে না।  

সূত্র আরও বলছে, নজরুলসহ অন্যরা যখন অপহরণ হয়, তখন এ ঘটনা দেখে ফেলেন আইনজীবী চন্দন সরকার। তিনি তখনই মোবাইল ফোনে ভিডিও করতে শুরু করেন। অপহরণের ওই ভিডিওচিত্র ধারণ করার কারণেই চন্দন সরকার ও তার গাড়িচালককে তুলে নেয় অপহরণকারীরা। অপহরণকারীদের কোনো টার্গেটে ছিলেন না চন্দন সরকার।

তদন্ত সূত্র জানায়, কিছুটা অস্পষ্ট ওই ভিডিওচিত্রে দেখা যায়, কয়েকজন ব্যক্তি নজরুল ও তার সহযোগীদের টেনেহিঁচড়ে গাড়িতে তুলছে। তবে ভিডিও খুবই কম সময়ের। এক মিনিটের বেশি হবে না। এ বিষয়ে বিস্তারিত কিছু বলতে চায়নি ওই সূত্র।

এর আগে ৩ মে চন্দন সরকারের মোবাইল ফোন ব্যবহারে জড়িত থাকায় রতন ও শিপন নামের দু’জনকে রাজধানী ঢাকা থেকে গ্রেফতার করা হয়। তাদের কাছ থেকেই চন্দন সরকারের নকিয়া ব্র্যান্ডের মোবাইল সেট পাওয়া যায়। তারা পেশায় প্রাইভেটকারের চালক। অপহরণের পর রাজধানীর নিকেতনে চন্দন সরকারের গাড়ি পরিত্যক্ত অবস্থায় পাওয়া যায়। ওই গাড়িতে পড়ে থাকা মোবাইল সেট নিয়ে পালায় গাড়িচালক রতন। এর পর সেটি তার ভাতিজাশিপনকে দেয়। এ দু’জন ওই মোবাইল ফোনটি ব্যবহার করে। পরে তাদের গ্রেফতার করা হয়।

নারায়ণগঞ্জের প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলামসহ সাতজনকে অপহরণের পর নির্মমভাবে খুনের ঘটনাটি অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে করা হয়েছে বলে তদন্ত কর্মকর্তারা মনে করছেন। প্রাথমিকভাবে তারা মনে করছেন, যারা অপহরণ ও খুন করেছে, তারা চৌকস (স্মার্ট) এবং প্রশিক্ষিত। এ হত্যাকাণ্ডে ২০ জন অংশ নিয়েছে বলে তদন্ত সূত্রে জানা যায়।

জানা গেছে, তিন গ্রুপে ভাগ হয়ে খুনিরা নারায়ণগঞ্জে চাঞ্চল্যকর এই সাত খুনের ঘটনা ঘটিয়েছে। একটি গ্রুপ প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলাম ও আইনজীবী চন্দন সরকারসহ সাতজনকে প্রকাশ্যে অপহরণ করেছে। এর পর আরেকটি দল তাদের পরিকল্পিতভাবে খুন করে। তৃতীয় দলের সদস্যরা হত্যার পর লাশগুলো বেঁধে শীতলক্ষ্যায় ডুবিয়ে দেয়। তবে প্রতিটি গ্রুপের সদস্যরা একে অন্যের সঙ্গে সমন্বয় করে পুরো প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে। তদন্ত কর্মকর্তারা মনে করছেন, আইনজীবী চন্দন সরকার ও তার ড্রাইভার অপহরণের টার্গেটে ছিলেন না। তারা ঘটনার শিকার হয়েছেন।

জানা গেছে, ঘটনার দিন (২৭ এপ্রিল) আদালত চত্বর থেকে সন্দেহভাজন এক ব্যক্তিকে আটক করে নজরুলের সহযোগীরা পুলিশের কাছে সোপর্দ করেন। তার নাম মোস্তফা কামাল। পরে ওই ব্যক্তিকে ছাড়িয়ে নিতে সেখানে যান কামাল উদ্দিন নামের আরেক ব্যক্তি। সূত্র জানায়, কামাল বিজিবির হাবিলদার। তিনি র‌্যাবের সদস্য। তার পরিচয় নম্বর ৩৯৪১১। এরই মধ্যে কামাল উদ্দিনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। তিনি জানিয়েছেন, আদালত এলাকায় সব সময় র‌্যাবের গোয়েন্দা সদস্যরা দায়িত্ব পালন করে থাকেন। তাদের একজন সদস্য সন্দেহজনকভাবে আটকের কথা শুনে তিনি ছাড়িয়ে আনতে যান। নজরুলসহ অন্যদের অপহরণের ব্যাপারে তার কিছু জানা নেই।

এরই মধ্যে আলামত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা গেছে, এ খুনের ঘটনার সঙ্গে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর লোকের সম্পৃক্ততা থাকতে পারে। কারণ, যে ইট ঝুলিয়ে লাশগুলো পানিতে ডোবানো হয়, সেই ইটের গুদাম ছিল আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ক্যাম্পের কাছেই। যে বস্তায় ইট ভরা হয়, সেগুলো রেশনের বস্তা। এসব বস্তায় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা রেশন তুলে থাকেন। আরও একটি বিষয় লক্ষ্য করা গেছে, লাশগুলো বাঁধতে যে গিঁট দেওয়া হয়েছে, সেটাকে বলে ‘কমান্ডো গিঁট’। এই গিঁট সাধারণত আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর প্রশিক্ষিতরাই দিয়ে থাকেন।

তদন্ত সূত্রে জানা গেছে, অপহরণ, খুন এবং লাশগুলো নদীতে ফেলার কাজটি অত্যন্ত সুনিপুণভাবে করা হয়েছে। লাশগুলোর মধ্যে যাদের উচ্চতা বেশি ছিল, তাদের বেশি ইট দিয়ে ডুবিয়ে দেওয়া হয়েছে। কোনো লাশের সঙ্গে ছিল ২৪টি, আবার কোনো লাশের সঙ্গে ৩২টি ইট বস্তায় সুন্দরভাবে সাজিয়ে বাঁধানো ছিল। অপহৃতদের মধ্যে যার উচ্চতা বেশি ছিল, তার দেহের সঙ্গে বেশি ইট বাঁধা হয়। তদন্তসংশ্লিষ্ট ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, লাশের সঙ্গে যে গিঁট দিয়ে এমবিবিবি কোম্পানির ইটভর্তি বস্তা বাঁধা হয়, তা কোনো সাধারণ অপরাধীর পক্ষে সম্ভব নয়।

আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের কমান্ডো ট্রেনিংয়ের সময় এ ধরনের গিঁট বাঁধা শেখানো হয়। এটা তাদের প্রশিক্ষণের একটি অংশ। খুব ঠাণ্ডা মাথায় এই নির্মম কাজটি করা হয়েছে। প্রতিটি মরদেহের সঙ্গে দুটি রশিতে ইটভর্তি দুটি বস্তা ছিল। একটি বাঁধা হয় লাশের পায়ের কাছাকাছি, আরেকটি কোমরের কাছাকাছি। লাশের সুরতহাল প্রতিবেদনে এ ধরনের তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, কয়েক মাস আগে থেকেই নজরুলকে অপহরণের পরিকল্পনা চূড়ান্ত হয়। এ পরিকল্পনায় নূর হোসেনই মুখ্য ভূমিকা পালন করেছেন- এখন পর্যন্ত তদন্তে এমন তথ্য পাওয়া গেছে। সবকিছু ঠিকঠাক হওয়ার পরও অপহরণ করতে বিলম্ব হওয়ায় নূর হোসেন বিচলিত ছিলেন। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে ব্যবহার করে বিপদে ফেলার চক্রান্তের খবর টেরও পান নজরুল। এ কারণেই ২৭ এপ্রিল আদালতে সাক্ষ্য দেওয়ার আগের দিন তিনি নিরাপত্তা চেয়ে শামীম ওসমানের সঙ্গে দেখা করেছিলেন।

সূত্র বলছে, নারায়ণগঞ্জের পুলিশ প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কেউ কেউ নজরুলের অপহরণের বিষয়টি আগে থেকেই টের পান। এর পরও তারা এ পরিকল্পনা নসাৎ করতে কোনো আইনি পদক্ষেপ নেননি। নজরুলসহ সাতজনকে অপহরণের ঘটনায় র‌্যাবের তিন কর্মকর্তার সঙ্গে নারায়ণগঞ্জের সদ্য সাবেক এসপি সৈয়দ নূরুল ইসলাম জড়িত ছিলেন- এমন অভিযোগ প্রকাশ্যেই করেছেন নজরুলের শ্বশুর শহীদুল ইসলাম ওরফে শহীদ চেয়ারম্যান। তার দাবি, ছয় কোটি টাকার মধ্যে এক কোটি টাকা পেয়েছে পুলিশ।

অপরাধশাস্ত্রে একটি প্রবাদ আছে, খুনি কোনো না কোনোভাবে ক্লু রেখে যায়। তাই অপহরণকারী যতই চৌকস হোক না কেন, তারা ঠিকই ক্লু রেখে গেছে। অপহরণকারীদের ধারণা ছিল, কোনোভাবেই সাতটি মরদেহ আর ভেসে উঠবে না। লাশ যাতে ভেসে না ওঠে, সে জন্য তারা সবার নাভির কাছে ধারালো অস্ত্রের মাধ্যমে ছিদ্র করে। ইট বাঁধে শক্ত কমান্ডো গিঁট দিয়ে। তার পরও লাশ ঠিকই ভেসে উঠেছে।

দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা জানান, স্কুল-কলেজে যারা স্কাউটে ভর্তি হয়, তাদের রশি বাঁধার পদ্ধতি শেখানো হয়। তবে নারায়ণগঞ্জে যে পদ্ধতিতে লাশের সঙ্গে থাকা ইটের বস্তা বাঁধা ছিল, তা কমান্ডো ট্রেনিংয়ে শেখানো হয়।

তদন্তসংশ্লিষ্ট একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, সাতজনকে একইভাবে গলায় দড়ি পেঁচিয়ে শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়। যে ধরনের দড়ি পেঁচিয়ে তাদের হত্যা করা হয়, একই ধরনের দড়ি মৃতের শরীর বাঁধা ছিল। এ ছাড়া অপহরণের পরপরই মাথা আর বুকে আঘাত করে তাদের অচেতন করা হয়। নির্যাতনের বাইরে ইনজেকশন পুশ করে অচেতন করার কোনো আলামত নিহতদের শরীরে পাওয়া যায়নি।

নজরুলসহ নারায়ণগঞ্জের ঘটনায় সাতটি লাশের সুরতহাল করেছেন বন্দর থানার ওসি আকতার মোর্শেদ। তিনি বলেন, সব ক’টি লাশের সঙ্গে ইটভর্তি দুটি করে বস্তা পাওয়া গেছে। কোনো বস্তায় ২৪, আবার কোনো বস্তায় ৩২টি ইট ছিল। আর লাশের সঙ্গে বিসমিল্লাহ ডাল কোম্পানির সাদা প্লাস্টিকের বস্তা পাওয়া গেছে। ওই কোম্পানির অন্যতম মালিক রাজশাহীর বাসিন্দা এনামুল হক বলেন, পুলিশ-আনসার ছাড়াও তারা নারায়ণগঞ্জের বেশ কয়েকজন পাইকারি ব্যবসায়ীকে ডাল সরবরাহ করেন।

যে কোনো সময় গ্রেফতার: সূত্র জানায়, সাত খুনের প্রধান আসামি নূর হোসেন যে কোনো সময় গ্রেফতার হতে পারেন। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা তার অবস্থান সম্পর্কে মোটামুটি নিশ্চিত। এ ব্যাপারে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, দ্রুত সময়ের মধ্যে নূর হোসেনকে গ্রেফতারে সব ধরনের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। অল্প সময়ের মধ্যে তাকে গ্রেফতারের ব্যাপারে আশা প্রকাশ করেন তিনি।

বাংলাদেশ শীর্ষ খবর